দেড় মণি বাঘাইড়ের দাম দেড় লাখ!
দেড় মণি বাঘাইড়ের দাম দেড় লাখ! - ছবি : সংগ্রহ
পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে মৌলভীবাজারের শেরপুরে দুই দিনব্যাপী দেশীয় মাছের মেলা হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী এই মেলা ১৩ জানুয়ারি রাত থেকে শুরু হয়ে ১৪ জানয়ারি সকালে শেষ হয়েছে। মেলায় নানান জাতের বড় আকৃতির মাছের পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। প্রায় দুই শ’ বছর ধরে চলে আসছে ঐতিহ্যবাহী এ মাছের মেলা। হাজার হাজার ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগমে মেলা প্রাঙ্গন পরিণত হয়েছে মিলন মেলায় ।
ঢাকা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের শেরপুর-মৌলভীবাজার সড়কের পাশে এই মেলার আয়োজন করা হয়েছে। কুশিয়ারা, সুরমা, মনু নদ, হাকালুকি, কাউয়াদীঘি, হাইল হাওরসহ সিলেট বিভাগের বিভিন্ন এলাকা থেকে বাঘাইড়,রুই, কাতলা, বোয়াল, চিতলসহ দেশী জাতের মাছ উঠেছে মেলায়। প্রায় দুইশত বছরের ঐতিহ্যবাহী এই মেলা যুগ যুগ ধরে মৌলভীবাজারসহ আশপাশের এলাকার মানুষদের অন্যতম উৎসবে পরিণত হয়েছে। মেলাটি বসে পৌষ সংক্রান্তির একদিন আগে।
মেলা উপলক্ষে আশেপাশের গ্রাম উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। মাছের মেলায় বাঘাইড়, আইড়, বোয়াল, বাউশ, কালি বাউশ, পাবদা, গুলসা, গলদা চিংড়ি ইত্যাদি মাছ স্থান পেয়েছে। এবছর শতাধিক জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ী মাছ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসেছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, শিশু-কিশোরসহ নানা বয়সের হাজারো মানুষের ঢল মেলায়। মাছের মেলা বলেই মাছের দিকে জনতার স্রোত। বিভিন্ন দোকানে নানা আকারের বোয়াল, রুই, কাতলা, চিতল, বাঘাইড় (বাঘমাছ) নিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। স্থানীয় ব্যাবসায়ি আব্দুর রশীদ মেলায় সবচেয়ে বড় বাগাইড় মাছটি নিয়ে আসেন। প্রায় দেড় মন ওজনের মাছের দাম হেঁকেছেন ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা বিক্রি করেছেন ৪৮ হাজার টাকা। বিক্রেতা মো. সামছুল ইসলাম জানান, এবার মেলায় বড় মাছ কম। আগের মতো স্থানীয় নদী, হাওর ও খাল-বিল মাছ নেই। তাছাড়া এবছর এখনও সব হাওর বিল শুকায়নি তাই মাছ ধরা পড়েছে কম। তবে মেলায় ক্রেতা আছেন। দামও ভালো।
মাছের মেলার আয়োজক কমিটির সভাপতি অলিউর রহমান বাংলা বলেন, মাছ, আসবাবপত্র, খেলনা, মিষ্টি ও অন্যান্য খাবার-দাবারের আয়োজন মিলে এই মেলায় ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার বেচাকেনা হবে।
মৌলভীবাজার জেলার হাকালুকি, কাওয়াদিঘি, হাইলহাওর, হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের হাওর, মনু, কুশিয়ারাসহ হাওর নদী থেকে মেলা উপলক্ষে এই মাছ ধরা হয়েছে। এছাড়া দেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকেও মেলায় মাছ আসে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেলাটি স্থানীয়দের সার্বজনীন উৎসবে রুপ নেয়। সব ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ এই মেলাকে ঘিরে উৎসবে আনন্দে মেতে ওঠে। এছাড়া মেলা উপলক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসীরাও দেশে এসে থাকেন। সৌখিন ক্রেতারা মেলায় এসে বড় বড় বাঘাইড়, বোয়াল, আইড়, বাউশ ও দেশি বিলুপ্তপ্রায় মাছ কিনে থাকেন।
শেরপুর মাছের মেলা পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপতি আশরাফ আলী খান বলেন, দূর দূরান্ত থেকে ব্যাসবায়িরা মাছ নিয়ে মেলায় আসেন। এবার কয়েক কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়েছে।’
এদিকে মাছের মেলাকে ঘিরে অন্যান্য সামগ্রিও ওঠেছে। বিশাল এলাকায় বিভিন্ন ধরণের খাদ্যের হোটেল, তিলুয়া-বাতাসা, খৈ-মুড়ি, নানারকম মৌসুমী ফল, শিশুদের খেলনা, কিশোরী-তরুণীদের প্রসাধনী। শীতের কাপড়চোপড়। বাঁশ-বেত ও কাঠের তৈরি আসবাবপত্র। ঘর-সংসারের নানারকম মাটির বাসন-কোসন, কাঠের জিনিস, লোহালক্কড়ের সামগ্রী, কৃষি যন্ত্রপাতি। হরেকরকম চোখ ধাঁধানো পণ্যের দোকান বসেছে। সবকিছুই কেনাবেচা হচ্ছে। মৎস্য ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে বড় মাছের মেলা এটি। এটি যদিও মাছের মেলা নামে পরিচিত। তবে মাছ ছাড়াও বিভিন্ন পসরার কয়েক হাজার দোকান বসে। মেলায় এখন মাছ ছাড়াও ফার্নিচার, গৃহস্থালী সামগ্রী, খেলনা, নানা জাতের দেশীয় খাবারের দোকানসহ গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী পণ্যের দোকান স্থান পায়। এছাড়া শিশুসহ সব শ্রেণির মানুষকে মাতিয়ে তোলার জন্য রয়েছে বায়োস্কোপ ও চরকি খেলা।
এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা মো. সামাদ মিয়াসহ অনেকেই মেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, সেই ছোটবেলা থেকে এই মাছের মেলা দেখে আসছি। তবে কিভাবে মেলা শুরু হয়েছিল কেউই তার সঠিক ইতিহাস জানে না।’ সিলেটের কুশিয়ারা নদী, সুরমা নদী, মনু নদী, হাকালুকি হাওর, টাংগুয়ার হাওর, কাওয়াদিঘি হাওর, হাইল হাওরসহ দেশের বিভিন্নস্থান থেকে মৎস্য ব্যবসায়ীরা বাঘাইড়, রুই, কাতলা, বোয়াল, গজার, আইড়সহ বিশাল বিশাল মাছ নিয়ে আসেন। মূলত এই মেলা অগ্রাহায়ণের ধান কাটা শেষে পৌষ সংক্রান্তি ও নবান্ন উৎসবে আয়োজন করা হতো। গৃহস্থ পরিবারের লোকজন নতুন বিরইন চালের পিঠার সঙ্গে ভাজা মাছ দিয়ে নিজে খেতো এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের আপ্যায়ন করা হতো। তারপর প্রায় ৮০ বছর আগে মেলাটি জায়গা স্থানান্তর হয়ে শেরপুর এলাকায় চলে আসে।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার, শরিফুল ইসলাম বলেন, শেরপুরের মেলায় এবার জুয়া ও অশ্লীলনৃত্য চলবে না। গত বছরও জুয়া ও যাত্রার কার্যক্রম বন্ধ ছিল। মেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে।
জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন বলেন, মাছে ভাতে বাঙালি আনায় এমন মাছের মেলা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মাছে সাথে পরিচয় করাতে সহায়ক হবে। মাছের মেলার জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থানে ব্যাপারে তিনি আশ্বাস প্রদান করেন।