হিস্টিরিয়া বনাম জিনের আছর

ডা: রুমানা চৌধুরী | Jan 14, 2020 05:18 pm
হিস্টিরিয়া বনাম জিনের আছর

হিস্টিরিয়া বনাম জিনের আছর - ছবি : সংগ্রহ

 

হিস্টিরিয়া। নামটি শুনে নিশ্চয়ই ভয় লাগছে! এতে ভয়ের কিছু নেই। এটি নিছক একটি মানসিক রোগ এবং এর যথেষ্ট ভালো চিকিৎসাও আছে। হিস্টিরিয়া জিন ভূতের আছর, পাগলামি এসব কিছু নয়, নিউরোসিস জাতীয় মানসিক রোগ।

মানসিক রোগ দুই প্রকারের হয়ে থাকে। একটি মৃদুমাত্রায়- তাকে নিউরোসিস বলা হয়, অপরটি জটিল মাত্রায়- একে সাইকোসিস বলা হয়। নিউরোসিস জাতীয় রোগগুলা যেমন অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার, অবশেসন, হিস্টিরিয়া, ফোবিয়া ইত্যাদি। সাইকোসিস জাতীয় রোগগুলো যেমন বিষণ্নতা, ম্যানিয়া, সিজোফ্রেনিয়া ইত্যাদি। হিস্টিরিয়া একটি নিউরোসিস রোগ। এ রোগটি শারীরিক সমস্যা বা মানসিক সমস্যা নিয়ে প্রকাশ পেতে পারে।

মনোসমীক্ষার মতামতই মোটামুটি বেশির ভাগ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মেনে নেন। মনোসমীক্ষার তথ্যানুযায়ী নিজের মনের অজান্তে অবদমিত মানসিক দ্বন্দ্ব থেকেই হিস্টিরিয়ার লক্ষণ সৃষ্টি হয়। সহজাত আচরণ বাইরের জগতে প্রকাশ হতে গেলেই রোগীর মনে দারুণ উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তার সৃষ্টি হয়। সেই উৎণ্ঠাকে দীর্ঘ দিন সহ্য করা মানুষের পক্ষে অসম্ভব। ফলে আমাদের অজান্তেই মানসিক ক্রিয়া এই বৃত্তিগুলোকে অবদমন করে।

এ অবদমনের অর্থে এই নয় যে, বৃত্তিগুলো চিরতরে নির্বাসিত হলো। মানসিক ক্রিয়াকে সব সময়ই সক্রিয়ভাবে অবদমিত রাখতে হয় বৃত্তগুলোকে। অবদমনকারী শক্তিগুলো যখনই কোনো কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে, অবদমিত বৃত্তিগুলো তখনই উঠে আসতে চায় চেতনায়। এ অবস্থা উপস্থিত হলে অবদমন ছাড়া মানসিক প্রক্রিয়ার সাহায্য নিতে হয় নিউরোসিসের লক্ষণ প্রকাশের সুযোগ ঘটে তখনই। এ ধরনের মানসিক প্রক্রিয়া সাহায্য নিতে হয় যখন নিউরোসিসের লক্ষণ প্রকাশের সুযোগ ঘটে তখনই। এ ধরনের মানসিক প্রক্রিয়া অনুসারে নিউরোসিসের লক্ষণও ভিন্ন হয়। কানভারশন হিস্টিরিয়াতেও কনভারশন নামক প্রক্রিয়া এবং ডিসোসিয়েটিভ হিস্টিরিয়ার ক্ষেত্রে ডিসোসিয়েটিভ প্রক্রিয়া কাজ করে। যে হিস্টিরিয়াতে শারীরিক লক্ষণ দেখা যায় তাকে বলা হয় কনভারশন হিস্টিরিয়া। যেমন- হঠাৎ করে হাত কিংবা পা প্যারালাইসিস হয়ে যাওয়া, হঠাৎ করে কথা বন্ধ হয়ে যাওয়া, চোখে দেখতে না পাওয়া ইত্যাদি। আর যে হিস্টিরিয়াতে মানসিক লক্ষণ দেখা যায় তাকে বলা হয় ডিসোসিয়েটিভ হিস্টিরিয়া। যেমন- এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো, খিঁচুনি রোগ, ঘুমের মধ্যে হাঁটা ইত্যাদি।

একটি কেস স্টাডি বর্ণনা করা যাক। লায়লা (কাল্পনিক নাম) বিয়ের দিন তার স্বামীর সাথে শ্বশুরবাড়িতে চলে আসে। আসার কয়েক ঘণ্টা পরই তার কথা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর কেটে গেছে দুই-তিন দিন। মেয়েটির মুখে আর কথা ফুটছে না। শত চেষ্টা করেও তাকে কেউ কথা বলাতে পারছে না। খবর পেয়ে বাপের বাড়ির লোকজন এলো। তারা দোষ দিচ্ছে এই বলে যে, মেয়ে তো ভালোই ছিল, শ্বশুরবাড়িতে ঢুকতেই তার এ অবস্থা হলো কেন? নিশ্চিত এ বাড়ির লোক কিছু করেছে। হতবাক হয়ে পড়ে শ্বশুরবাড়ি লোকজন। কিছুতেই বুঝতে পারছে না কী করে এমন হলো। তারা দেখেছে বউ যখন বাড়িতে পা দিয়েছে তখন মুখে ঠিকই কথা ফুটেছে। তবে কি কারো নজর লেগেছে নতুন বউয়ের ওপর। এ ভেবেই ডাকা হলো নামকরা ওঝাকে। ঝাড়ফুঁক, তুক তাক ইত্যাদি ভৌতিক ক্রিয়াকলাপও কিছু করা হলো। কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না।

তখন প্রায় দু’দিন পর শহরের হাসপাতালে হাজির হয়েছে সবাই। প্রাথমিক পর্যায়ে ঘটনার বিস্তৃত বিবরণ সংগ্রহ করলাম। তারপর আত্মীয় স্বজনকে বাইরে বসিয়ে মেয়েটিকে আলাদা করে তার প্রতি মনোচিকিৎসার বিধিবিধান অনুযায়ী চিকিৎসা প্রয়োগ করলাম।

নাটকীয়ভাবে মেয়েটির মুখে কথা ফুটল। খুব কম সময়ের মধ্যে সেদিন যতটা সহজে সুফল পেয়েছিলাম, সাধারণত এত সহজে ফল পাওয়া যায় না। মেয়েটির মুখে কথা ফুটতে দেখে আশ্বস্ত হলো বাপের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন। দূর হলো উভয় পক্ষের লোকজনের মনোমালিন্য, দোষারোপ। এখন বিদ্বেষ ভুলে নিবিড় করে তুলল আত্মীয়তার বন্ধন। হাসিমুখে মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার আগে অবশ্য তাদের কিছু পরামর্শ দিয়েছিলাম। এই পরামর্শ দেয়া চলছিল চার-পাঁচ মাস। চিকিৎসা শেষে পরামর্শ দিলাম- ভবিষ্যতে যদি আবার এরকম ঘটে, তখনি যেন জানানো হয় আমাদের।

পাঁচ বছর পর জানতে পারলাম, ওরা এখন সুখে শান্তিতে ঘর করছে। কয়েক মাস আগে তাদের একটি মেয়েও হয়েছে।

এবার দেখা যায় লায়লার রোগটি কী ছিল। আসলে এমন কী হয়েছিল যে তার কথা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের পরের দিন শ্বশুরবাড়িতে পা দিতে না দিতেই আত্মীয় স্বজন পাড়া পড়শিরা তার বাপের বাড়ি সম্পর্কে বেশ কিছু আপত্তিকর মন্তব্য করেছিল। সেসব মন্তব্যের বেশির ভাগই মেয়েটির বাবাকে কেন্দ্র করে। যেমন- মেয়ের বাবা সুবিধার মানুষ নন, নানাভাবে তারা জামাইকে ঠকিয়েছে, গয়না, জিনিসপত্র ঠিকমতো দেয়নি, ওরা প্রতারক ইত্যাদি। এরপর কী হলো মেয়েটির পুরোপুরি মনে নেই। লায়লা বরাবর ছিল জেদি আর ডানপিটে ধরনের। বিয়ের আগে ওর বাবা-মা এবং আত্মীয় স্বজন বারবার বলে দিয়েছিল শ্বশুরবাড়ির লোকজন যে যাই বলুক, এমনকি কোনো কটুক্তি করলেও তাকে সবই সহ্য করতে হবে মুখবুজে, মা তার গা ছুঁয়ে বলেছিলেন, এ আমার দিব্যি রইল। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে প্রবেশ করেই সে শুনল তার বাবা সম্পর্কে বিশ্রি কটুক্তি। শুনেই তার প্রবল ইচ্ছা হয়েছিল প্রতিবাদ করতে। কিন্তু তা কী করে হয়? সে যে মায়ের কাছে শপথ করে এসেছে। কিন্তু সে প্রতিবাদ করতে না পারায় তার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠছিল প্রবল যন্ত্রণায়। মনে হচ্ছিল যেন এক্ষুণি অজ্ঞান হয়ে যাবে। আর ঠিক তখন থেকেই লোপ পেল তার কথা বলার শক্তি। কথা বন্ধ হওয়া যে মেয়েটির ইচ্ছাকৃত ব্যাপার তা নয়। মানসিক জটিল প্রক্রিয়ার ফলে তার বাক রহিত হয়েছিল। এই প্রক্রিয়াকেই বলা হয় কনভারশন অর্থাৎ দ্বন্দ্বজনিত মানসিক যন্ত্রণা যা শারীরিক অক্ষমতায় রূপান্তরিত হয়েছে। এই রূপান্তরিত অবস্থাকেই বলে কনভারশন হিস্টিরিয়া।

হিস্টিরিয়া রোগের চিকিৎসা
এটি মৃদুমাত্রার মানসিক রোগ। তাই এ রোগের চিকিৎসায় ওষুধের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের কাউন্সেলিং বা সাইকোলজিক্যাল চিকিৎসা প্রয়োগ করা প্রয়োজন। প্রথমে রোগীকে মৃদুমাত্রার দুশ্চিন্তানাশক ওষুধ দেয়া হয়। পরে তার সাথে গভীর সাক্ষাৎকার নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সাইকোলজিক্যাল চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us