প্রযুক্তির ব্যবহার : ইসলামের নির্দেশনা
প্রযুক্তির ব্যবহার : ইসলামের নির্দেশনা - প্রযুক্তির ব্যবহার : ইসলামের নির্দেশনা
ইসলাম সর্বকালের সর্বজনীন জীবনব্যবস্থা। পবিত্র কুরআন সর্বশেষ আসমানি কিতাব। সে কারণে কেয়ামত পর্যন্ত মানুষের জীবনবিধানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এই পবিত্র কালামে পাকে বিধৃত। আমাদের মাঝে এক শ্রেণীর চিন্তাবিদ দ্বিমুখী কথাবার্তা বলে থাকেন।
যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একদিকে তারা বলছেন কুরআনুল কারিম সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব। কিয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির যাবতীয় সমস্যার সমাধান কোরআনে রয়েছে। কালামে পাকে আল্লাহ পাক বলছেন, ‘আমি এই কিতাবে কোনো কিছু বাদ দেইনি। অতঃপর তোমাদের প্রভুর নিকট প্রত্যাবর্তন করতে হবে’ (সূরা আল আনাম, আয়াত নং ৩৮)।
অপর দিকে, এ চিন্তাবিদদের অনেকে বলছেন, ইসলামে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিকনির্দেশনা নেই। বিশেষত আধুনিক সমরাস্ত্র উদ্ভাবনের বিষয়ে কোনো বিধিবিধান নেই।’ বাস্তবে এ ধরনের বক্তব্য অজ্ঞতাপ্রসূত ও মেধাহীনতার পরিচায়ক। সূরা ইয়াসিনের প্রথম আয়াতেই ঘোষণা করা হয়েছে, কোরআন বিজ্ঞানময় ও প্রজ্ঞাময় কিতাব। হাদিস শরিফের ভাষ্যানুযায়ী মহানবী সা: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে নিজের কর্মের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেছেন।
যেমন- খন্দকের যুদ্ধে তিনি পৃথিবীতে সর্বপ্রথম পরিখা খননের কৌশল অবলম্বন করে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে শত্রুদের পরিকল্পনা ও আক্রমণ নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন। প্রযুক্তির ব্যবহারের গুরুত্ব হিসেবে হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, হজরত উকবা ইবনে আমের রা: হতে বর্ণিত; তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সা:কে বলতে শুনেছি, তিনি মিম্বারে দাঁড়িয়ে বলছেন, তোমরা তোমাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে যথাসাধ্য শক্তি অর্জন করো। জেনে রেখো, প্রকৃত শক্তি হলো তীর নিক্ষেপ, প্রকৃত শক্তি হলো তীর নিক্ষেপ, প্রকৃত শক্তি হলো তীর নিক্ষেপ (মুসলিম)।
হাদিস শরিফে আরো বর্ণিত হয়েছে, হজরত উকবা ইবনে আমের রা: হতে বর্ণিত; তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সা:-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি তীর পরিচালনার কাজ শিক্ষার পর তা পরিত্যাগ করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। তিনি আরো বলেছেন, সে নাফরমানি করল (মুসলিম)। হাদিস শরিফে হজরত আনাস রা: হতে বর্ণিত; তিনি বলেছেন, ওহুদ যুদ্ধে হজরত আবু তালহা রা: নবী করিম সা:-এর একই ঢালের আড়ালে থেকে আত্মরক্ষা করছিলেন। আর আবু তালহা একজন দক্ষ তীরন্দাজ ছিলেন। যখন তিনি তীর নিক্ষেপ করতেন, তখন রাসূলুল্লাহ সা: উঁকি দিয়ে নিক্ষিপ্ত তীর পতিত হওয়ার স্থানটি লক্ষ্য করতেন (বোখারি)।
এ সব হাদিসের আলোকে বলা যায়, আগের যুগে যুদ্ধক্ষেত্রে তীরের ব্যবহার ছিল সুবিদিত। বর্তমানে তিরন্দাজীর আধুনিকায়ন বা দূরপাল্লার শত্রুকে ঘায়েল করার আধুনিক প্রযুক্তি হচ্ছে, মিসাইল বা ক্ষেপণাস্ত্র। মিসাইলের আরবি নাম মানযানিক। মুসলমানেরা বহুপূর্ব হতে এর ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত ছিল। বীর সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু জয়ের সময় রাজা দাহিরের দুর্গে মানযানিকের মাধ্যমে গোলা নিক্ষেপ করেছিলেন।
ফলে দাহিরের দুর্গ ধ্বংস হয়েছিল। সে যুদ্ধে মুসলমানেরা জয়ী হয়েছিল। ভারতের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আবদুল কালাম তার আত্মজীবনী গ্রন্থে লিখেছেন যে, আধুনিক মিসাইলের জন্মদাতা ভারতের মহান বীর ও মহীশুর অধিপতি টিপু সুলতান। এ কারণে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান গবেষণাগার, যুক্তরাষ্ট্রের নাসার দেয়ালে টিপু সুলতান ও তার সৈন্যবাহিনীর ছবি অঙ্কিত আছে অদ্যাবধি। হাদিস শরিফে আরো বর্ণিত হয়েছে হজরত আনাস রা: হতে। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সা: এরশাদ করেছেন, অশ্বের ললাটে বরকত রয়েছে (বোখারী ও মুসলিম)। হাদিস শরিফে আছে। হজরত জারির ইবনে আবদুল্লাহ রা: হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, একদা রাসূলুল্লাহ সা:কে দেখলাম, তিনি তাঁর হাতের আঙুল দ্বারা অশ্বের ললাটের কেশরাজি মোড়াচ্ছেন এবং বলছেন, অশ্বের ললাটে কল্যাণ কিয়ামত পর্যন্ত বাঁধা রয়েছে (মুসলিম)।
হজরত আবু হুরাইরা রা: হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সা: এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ঈমান এবং তার ওয়াদার প্রতি দৃঢ় আস্থা রেখে আল্লাহর পথে জিহাদের উদ্দেশে অশ্ব পালন করে, কিয়ামত দিবসে ওই অশ্বের তৃপ্তিকর খাবার এবং তার গোবর ও প্রস্রাব ওই ব্যক্তির আমলের পাল্লায় ওজন করা হবে (বোখারি)। এই হাদিসগুলোর দ্বারা প্রমাণিত, মহানবী সা:-এর সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রে দ্রুতগামী বাহন হিসেবে ঘোড়া বা অশ্বের ব্যবহারকে মহানবী উৎসাহিত করেছেন। বর্তমানে যুদ্ধক্ষেত্রে দ্রুতগামী বাহন হিসেবে ঘোড়ার পরিবর্তে যুদ্ধবিমান ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে সর্বাধুনিক যুদ্ধ বিমান তৈরি এবং যুদ্ধ ক্ষেত্রে তার ব্যবহারকে উৎসাহিত করা ইসলামী চিন্তাবিদদের একান্ত প্রয়োজন। কিছু বুদ্ধিজীবী কুরআন ও হাদিসের যথাযথ ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন না। এভাবে তারা কুরআন ও হাদিসের অবমাননা করে চলেছেন।
বলা যায়, মহানবী সা:-এর মিরাজ গমন সংক্রান্ত কালামে পাকের আয়াত এবং হাদিস পর্যালোচনা করলে আমরা বলতে পারি, যে গতিময় বাহনে চড়ে মহানবী স: সপ্ত আকাশ ও আরশে আজিমে ভ্রমণ করেছিলেন তা মহাকাশ গবেষণার এক বিরাট বিস্ময়। মানুষের পক্ষে কোনো দিন এ ধরনের তীব্র গতিসম্পন্ন বাহন তৈরি করা সম্ভব হবে না। সে কারণে বলা যায়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ মাত্রার জ্ঞান আমরা কুরআন ও হাদিসের মাধ্যমে পেতে পারি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উদ্ভাবনে নিজেরা সচেষ্ট না হয়ে মুসলমানদের উচিত নয় অন্য জাতি গোষ্ঠীর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় যুদ্ধাস্ত্র সরঞ্জাম ক্রয় করা। কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তি শত্রুর কাছে উন্নত যুদ্ধাস্ত্র ও প্রযুক্তি হস্তান্তর করে না। বরং মেয়াদোত্তীর্ণ ও অচল সমরাস্ত্র অধিক মূল্যে বিক্রি করে অধিক মুনাফা লাভ করে থাকে। বর্তমান মুসলিম বিশ্বের সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করলে বিষয়টি সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে। সময়ের আলোকে এ সম্পর্কে বিশেষ গবেষণা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই সময়ের দাবি।