শ্রীলঙ্কায় বিয়ে আইন নিয়ে জটিলতা
শ্রীলঙ্কায় একটি মুসলিম বিয়ের অনুষ্ঠান - ছবি : সংগৃহীত
শ্রীলঙ্কায় বিয়ে আইন নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। দেশটিতে ১৯৫১ সালের বিতর্কিত মুসলিম বিয়ে ও তালাক আইন (এমএমডিএ) বাতিলের জন্য পার্লামেন্টে যে বিল উত্থাপন করা হয়েছে, সেটি নিয়ে সেখানে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
নতুন বছরের শুরুতে তথা ৩ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসা পার্লামেন্টে যে সরকারের নীতি বিবৃতি দেন, সেটি নিয়ে পার্লামেন্টে সমাপনী বিতর্কের দ্বিতীয় দিনে বৌদ্ধ ভিক্ষু ও পার্লামেন্ট সদস্য ভেনারেবল আথুরালিয়ে রত্না থেরা এই বিল উত্থাপন করেন।
১৯৫২ সালের কান্ডিয়ান বিয়ে ও তালাকা আইন বাতিলের প্রস্তাবের সাথে এই বিলটিও পার্লামেন্টে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু শ্রীলঙ্কাতে আলোচনা চলছে মূলত এমএমডিএ নিয়ে, কান্ডিয়ান আইন নিয়ে নয়, কারণ এটা বিতর্কিত হয় এবং এই আইনটি কার্যত অকার্যকর হয়ে গেছে।
কিছু মুসলিম এমএমডিএ বদলে দেয়াকে ভালো পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন, অন্যরা বলছেন এটা পুরোপুরি বাতিল করার প্রয়োজন নেই। যেটা করা উচিত, সেটা হলো বিলটি সংশোধন করা যাতে নারীদের অধিকার আরো ভালোভাবে সুরক্ষিত হয়।
শ্রীলঙ্কান মুসলিমদের ক্ষেত্রে এমনকি ১২ বছর বয়সী শিশুর বিয়েও বৈধ, যেহেতু এমএমডিএ’র অধীনে সেটার অনুমোদন রয়েছে, যেটা মুসলিম পার্সোনাল আইনের অধীনে রয়েছে। কিন্তু বৈধ হওয়া সত্বেও দ্বীপে মুসলিমদের ১২ বছর বয়সে বিয়ে হওয়ার ঘটনা বিরল।
যেটার অস্তিত্ব রয়েছে, সেটা হলো বিয়ের পর নারীদের উপর নির্যাতনের বিষয়টি। কিন্তু, এটা শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমিত নয়। সিংহলি ও তামিলদের মধ্যেও এটা ঘটে।
বহু বছর ধরে মুসলিম অধিকার কর্মীরা নিজেরাই নারীদের অপব্যবহার প্রতিরোধের জন্য এমএমডিএ আইন পরিবর্তনের জন্য লড়াই করে আসছে, যেটা মূলত মনোযোগের বাইরেই রয়ে গেছে। তবে কিছু কট্টর মুসলিম এবং কিছু ওলামা ও পুরুষ মুসলিম রাজনীতিবিদ এর বিরোধিতা করে আসছেন।
এমএমডিএ’র বিষয়টি ব্যাপকভাবে মানুষের মনোযোগে আসে ২০০৯ সালে আগের মাহিন্দা রাজাপাকসা আমলে, যখন আইনটি পুনঃপর্যালোচনা করে পরামর্শ দেয়ার জন্য একটা কমিটি গঠন করা হয়। এমএমডিএ বাতিলের জন্য কমিটি করা হয়নি, বরং নারীদের বিরুদ্ধে যে সব জায়গায় সমস্যা রয়েছে, সেগুলো সংশোধনের জন্য এই কমিটি করা হয়েছিল।
শ্রীলঙ্কার বিশিষ্ট মানবাধিকার ও মুসলিম অধিকার কর্মী দেশাবান্দু জেজিমা ইসমাইল – যিনি ২০০৯ সালের কমিটিতে ছিলেন – তিনি সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বলেন যে, আসল উদ্দেশ্য ছিল পবিত্র কোরান অনুযায়ী নারীদের অধিকার সুরক্ষার জন্য এমএমডিএর নীতিমালাগুলোকে সংশোধন করা।
ইসমাইল উল্লেখ করেন, “আমরা এর জন্য বহু বছর ধরে লড়াই করছি। পিতৃতন্ত্র এই আইনে প্রাধান্য পেয়েছে। এখন আমাদের পরামর্শ হলো এমএমডিএ পুরোপুরি বাতিল করে দেয়া হোক। আমি জানি যে এই আইনের পক্ষে ও বিপক্ষে বহু যুক্তিতর্ক রয়েছে। একটি যুক্তি হলো এমএমডিএ যদিও ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশরা চালু করেছিল, কিন্তু এখানে আমাদের দেশের মুসলিমদের জন্য এক ধরনের পরিচয় নিশ্চিত করা হয়েছে”।
তবে, এমএমডিএ বাতিল করে সেই জায়গায় নতুন ও আধুনিক একটি আইন সংযোজিত হলে ‘এক হিসেবে সবকিছু সহজ হয়ে যাবে’। এমএমডিএ সংশোধনের বিষয়টি জটিল ও বিতর্কিত বিষয়। তিনি বলেন, যেহেতু বহু বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখতে হবে, সে কারণেই যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত ইসলামিক আইনের বিশেষজ্ঞদেরকে এই প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
পুনর্গঠনের জন্য বহু প্রস্তাব থাকলেও কোন সুনির্দিষ্ট পরিবর্তন এ যাবত হয়নি। একটি বিতর্কিত প্রস্তাব ছিল ইসলামিক আদালতে নারীদের কাজি বা বিচারপতি নিয়োগ দেয়া। পুরুষ ধর্মনেতা এবং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ লঙ্কান ইসলামি সংস্থা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন কারণ কাজি সাধারণত পুরুষরাই হয়ে থাকেন।
কমিটি অব মুসলিম পার্সোনাল ল রিফর্মসের সদস্য রিজওয়ে মুফতি – যিনি দেশের সবচেয়ে প্রধান ইসলামিক গভর্নিং বডি – অল সিলন জমিয়াতুল উলামার (এসিজেইউ) প্রেসিডেন্টও বটে – তিনি ঘোষণা দিয়েছেন যে, এমএমডিএ ‘বর্তমান পরিস্থিতির জন্য একেবারে যথার্থ’ এবং এতে কোন পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। শ্রীলঙ্কার নারী গ্রুপগুলো তার বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে এবং তাকে শাস্তি দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছে।
যে সব আইনের সংশোধনকে সমর্থন করেছেন, তাদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে নারীদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর করা, তালাকের ক্ষেত্রে সন্তানের ব্যাপারে পুরুষের দায়দায়িত্ব নিশ্চিত করা, নারীদের যৌতুক বিলুপ্ত করা, বিয়ের আগে কাজী বোর্ড কর্তৃক পুরুষের আর্থিক অবস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা যথাযথভাবে যাচাই করা, এবং কাজী বোর্ডে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা।
এমএমডিএ বাতিলের জন্য যে অধিকার কর্মীরা লড়াই করছেন, তারা বলছেন শ্রীলঙ্কায় বাল্যবিয়েকে সামাজিক সমস্যা হিসেবে দেখতে হবে, ধর্মীয় সমস্যা হিসেবে নয়।
পার্লামেন্ট সদস্য বৌদ্ধ ভিক্ষু আথুরুলিয়ে রত্না যে প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছেন, কেউ কেউ সেটিকে দেখছেন ইসলামকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা হিসেবে। এর আগে মুসলিম অধিকার কর্মীরা তাদের সম্প্রদায়ের কট্টর ও রক্ষণশীল সহ-নাগরিকদের কাছ থেকে জোরালো চাপের মধ্যে ছিলেন যাতে তারা এ বিষয়টি নিয়ে কথা না বলেন কারণ এটা দেশে মুসলিম-বিরোধী মনোভাব বাড়িয়ে দিতে পারে। এরপরও যারা কথা বলেছিলেন, তাদেরকে প্রায়ই পশ্চিমাপন্থী এবং ইসলামকে অবজ্ঞা করার জন্য পশ্চিমাদের সহযোগী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
জেজিমা ইসমাইল বলেন, “একটা ভয় ছিল যে, ইসলামকে নেতিবাচক ধর্ম হিসেবে চিত্রিত করা হচ্ছে। অনেকেই অতীতটা ঘেঁটে দেখতে চান না, যখন সত্যিকার অর্থেই এটা নারীদের জন্য খুবই প্রগতিশীল ধর্ম ছিল এবং নারীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য যে সব বিষয়ের সুপারিশ করা হয়েছিল, সেগুলোকেও এখন প্রেক্ষাপটের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে”।
শ্রীলঙ্কার ত্রিণকোমালির বাসিন্দা ও বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক আমির আলী বলেন, “এই প্রস্তাবটি শ্রীলঙ্কার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যকে বিলীণ করে দেয়ার একটা অশুভ চক্রান্তের অংশ”।
তিনি বলেন, এতে কোন বিতর্ক নেই যে এমএমডিএ পুনর্গঠন করতে হবে কিন্তু এর উদ্দেশ্যগুলো পুরোপুরি নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। আলী সেই সব ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম যারা আগের সরকারের সমালোচনা করেছেন এবং মুসলিম নারীদের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ইসলামের সীমার মধ্যে এমএমডিএর সংশোধনে বারবার ব্যর্থ হয়েছে।
আলী অভিযোগ করেন, তার বদলে এমএমডিএকে এখন রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে এবং মুসলিম-বিরোধীদের অস্ত্র হিসেবে এটাকে এখন ব্যবহার করা হচ্ছে যারা দেশের ভেতরে মুসলিম-বিরোধী মনোভাব ছড়িয়ে দিতে চায়। আলী কানদিয়ান আইন এবং এমএমডিএ উভয় আইনকেই বহুত্ববাদী সমাজের অংশ হিসেবে দেখেন।