তারাও বিপদে!
তারাও বিপদে! - ছবি : সংগৃহীত
এ ধরনের সফর হেইদি শতাধিকবার করেছেন।
অন্তত গত ১০ বছর ধরে মাসে অন্তত একবার করে করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিনকার্ডধারী ইরানি নাগরিক হেইদি কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে মায়ের সাথে সাক্ষাত করতে এসেছিলেন। এখন তিনি বাড়ি ফিরছেন।
হেইদি ও তার বান্ধবী উভয়েই দ্রুত নাগরিকত্ব পাওয়ার মতো অবস্থায় ছিলেন। তারা শনিবার বিকেলে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার পথে তাদেরকে কমলা স্লিপ ধরিয়ে দিয়ে বলা হয়, তাদের গাড়িটি আরো পরীক্ষা প্রয়োজন। মার্কিন কর্মকর্তারা তাদের পাসপোর্ট নিয়ে নিলেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকলেন।
ক্ষতির শঙ্কায় হেইদি এই কাহিনীতে ছদ্মনাম ব্যবহার করছেন। তাকে তার জন্মস্থান, বর্তমান পেশা, কখনো বন্দুক ধরেছেন কিনা, কোথায় পড়াশোনা করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সর্বশেষ উত্তেজনা সম্পর্কে তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন করা হয় বলে তিনি হাফপোস্টকে জানিয়েছেন।
এই ঘটনার মাত্র কয়েক দিন আগে ইরানি জেনারেল, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব জেনারেল কাসেম সোলাইমানি বাগদাদ বিমানবন্দরে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে ও বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বেড়ে যায়।
সোলাইমানি নিহত হওয়ার খবর প্রচারিত হওয়ার আগে তার সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না হেইদির।
ব্লেইন সীমান্ত ক্রসিংয়ে কোনো কারণ ছাড়াই যে শতাধিক ইরানি বংশোদ্ভূতকে আটক করা হয়েছে, হেইদি ও তার বান্ধবী তাদের দুজন মাত্র। অনেককে ১১ ঘণ্টা পর্যন্ত আটক রাখা হয়।
তবে কাস্টমস অ্যান্ড বোর্ডার প্রটেকশন (সিবিপি) এসব অভিযোগ অস্বীকার করে হাফপোস্টকে ই-মেইলে জানিয়েছে যে জন্মগত ঠিকানার জন্য ইরানি-আমেরিকানদের আটক রাখার যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তা ভ্রান্ত।
সিবিপির এক কর্মকর্তা হাফপোস্টকে বলেন, বর্তমান হুমকিমূলক পরিস্থিতির কারণে দেশে প্রবেশের পথগুলোতে বাড়তি নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
এদিকে ইরানিদের আটক করা হচ্ছে বলে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর আইনপ্রণেতা ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারা এর নিন্দা করেছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ও ওয়াশিংটনের গভর্নর জে ইন্সলি (ডি) টুইট করে বলেছেন, সিবিপির এসব অভিযোগ অস্বীকার স্রেফ বিশ্বাসযোগ্য নয়। রিপাবলিকান প্রমীলা জয়পাল (ডি-ওয়াশ) বলেছেন, এগুলো হচ্ছে ওপরের নির্দেশে।
যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা সীমান্তের এসব ঘটনায় নাগরিক অধিকার আন্দোলনকারীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইরানিদের টার্গেট করে করা এসব ঘটনা বিপজ্জনক নজির।
তবে এ ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছে। যখনই ইরান, ইরাক বা আফগানিস্তানে কোনো সামরিক সঙ্ঘাত লাগে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রান্তিক সম্প্রদায়গুলো দুর্ভোগে পড়ে, তাদের নাগরিক অধিকারগুলো খর্ব হয়।
যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা সীমান্তের ওই খবর প্রকাশিত হওয়ার মাত্র কয়েক দিন আগে লস অ্যাঞ্জেলসসহ (এখানেই বিশ্বে ইরানের বাইরে সবচেয়ে বেশি ইরানির বাস) যুক্তরাষ্ট্রের সব নগরীতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সন্দেহজনক কিছু হলেও তাদের কাছে যেন খবর পৌঁছানো হয়, তা জানিয়ে দেয়া হয়। এ ধরনের পদক্ষেপ ইতোমধ্যেই নাজুক অবস্থায় থাকা লোকদের জন্য আরো বৈষম্যমূলক পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়।
আমেরিকান-আরব বৈষম্যবিরোধী কমিটির লিগ্যাল অ্যান্ড পলিসি ডিরেক্টর আবেদ আইয়ুব হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ফেডারেল সংস্থাগুলোর বর্ধিত হয়রানিমূলক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
অবশ্য ইরানিরা এ ধরনের পরিস্থিতিতে আগেও পড়েছে। ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক অচলাবস্থার সময় ইরানের নথিহীন ছাত্রদের বহিষ্কার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন ওই সময়ের প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সৃষ্টি করেছিলেন ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ট্রি-এক্সিট রেজিস্ট্রশেন সিস্টেম। এতে ৯/১১ ও ইরাক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ২৫টি দেশের নাগরিকদের টার্গেট করা হয়েছিল। আরো সাম্প্রতিক সময়ের কথা বলা যায়। ট্রাম্প ২০১৭ সালে নির্বাহী আদেশে ইরানসহ বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশের নগারিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেন।
তবে আইয়ুব বলেন, আমার অনুমান, এবার পরিস্থিতি হবে ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ। তিনি বলেন, ইরানি, মুসলিম, আরব ও দক্ষিণ এশিয়ান নাগরিকদের জন্য বৈষম্যমূলক আইন প্রণয়ন করা হতে পারে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন যে ইরান ও ইরাকে ধর্মীয় পর্যটনে থাকা শিয়া মুসলিমরা যখন যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার চেষ্টা করবেন, তখন তাদেরকে বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে।
ইরানি-আমেরিকান মেডিক্যাল ছাত্রী ক্রিস্টাল (২৪) কানাডা থেকে আমেরিকা ফেরার পথে হেইদির মতো পরিস্থিতির শিকার হন। তিনি জানান, তাকে ও তার পরিবারকে ১১ ঘণ্টা ধরে আটক রাখা হয়েছিল। হেইদির মতো তার পরিবারকেও পাসপোর্ট জমা রাখতে বাধ্য করা হয়েছিল এবং নানা প্রশ্নবানে জর্জরিত করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, যা ঘটেছে বলে প্রচার করা হচ্ছে তা সত্য। তাকে আরো অন্তত অন্য ৬০ ইরানির সাথে এক কক্ষে থাকতে বাধ্য করা হয়। এই আটক থাকার কারণে তিনি কানেকটিং ফ্লাইটও মিস করেছেন।
ক্রিস্টাল ও তার পরিবারকে পরদিন ভোর ১.৩০-এ ছেড়ে দেয়া হয়। আর হেইদি ও তার বান্ধবী ছাড়া ৪.৪৫-এ। তিনি যখন শুনতে পারলেন যে তিনি এখন যেতে পারেন, তখন তিনি কান্না চেপে রাখতে পারেননি। রাগে, ক্ষোভে তিনি নিঃশেষ হয়ে পড়েছিলেন। তিনি সাথে সাথে ভ্যাঙ্কুভারে তার মাকে ফোন করে পরিস্থিতি অবগত করেন।
তিনি তার মাকে বলেন, তুমি যদি ইরান ছাড়া অন্য কোথাও আমাদের জন্ম দিতে, তবেই ভালো হতো।
এই ঘটনার পর হেইদি একটি পারসি প্রবাদবাক্যেই সান্ত্বনা পেয়েছিলেন : ‘আগুন যখন লাগে, তখন ভেজা আর শুকনা- সব কাঠই একসাথে পুড়ে যায়।‘ এরপর কী হতে পারে তা নিয়েই তিনি চিন্তিত।
তিনি বরেন, আমরা কথা বলার স্বাধীনতা পেতাম না বলেই ইরান ছেড়েছিলাম। কিন্তু এখন খারাপ কিছুর আশঙ্কায় মিডিয়াতেও নাম বলতে ভয় পাচ্ছি। এই ঘটনার পর প্রশাসনের কাছ থেকে যেকোনো কিছুই ঘটা সম্ভব। তারা একবার একটি গ্রুপের কাছ থেকে তাদের অধিকার কেড়ে নিলে আমরা বাকিরাও নিরাপদে থাকব না।
হাফপোস্ট