ইরাক দখলের নীলনক্সা বুমেরাং!

এম কে ভদ্রকুমার | Jan 12, 2020 09:00 pm
ইরাকে যে বিপদ ঘনিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর

ইরাকে যে বিপদ ঘনিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর - ছবি : সংগৃহীত

 

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিশ্বাসযোগ্যতা এতই কম যে কুদস বাহিনীর প্রধান কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার নির্দেশ দেয়ার মাধ্যমে ইরানের সাথে সাম্প্রতিক সঙ্ঘাতে গিয়ে তিনি ভুল করেছেন বলে প্রচলিত ধারণাটি নিয়ে বিতর্ক করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক বিশ্লেষক ট্রাম্পের অপেক্ষাকৃত ভালো সহজাতপ্রবৃত্তি বিরুদ্ধে তাকে প্ররোচিত করে কাজটি করানোর জন্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেইওর দিকে আঙুল তুলছেন।

অবশ্য, সোলাইমানির হত্যাকাণ্ডটি ছিল একটি হিসাবি পদক্ষেপ। এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে মূল যে ইঙ্গিতটি দেয়া হয়েছে তা হলো এই যে ২০০৩ সালের আক্রমণের অসমাপ্ত এজেন্ড ইরাককে নিজের কক্ষপতে টেনে আনার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ়প্রতিজ্ঞা। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পরে যে ‘নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি’র লক্ষ্য ছিল ইরাক স্থিতিশীলতা হওয়ামাত্র সরকার পরিবর্তন করা।

কিন্তু প্রকল্পটির উদ্দেশ্য বানচাল হয়ে যায়। ইরাক থেকে সৈন্য হ্রাস করার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সিদ্ধান্তে তা প্রকট হয়ে ওঠে। ২০০৩ সালের আক্রমণ-পরবর্তী পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যাওয়ার আংশিক কারণ ছিল ত্রুটিপূর্ণ মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি। তবে তা মূলত বানচাল হয়েছিল ইরাকি ময়দানে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একইসাথে সহযোগিতা ও সঙ্ঘাতে যাওয়ার দুর্দান্ত ইরানি খেলায়। আর এর মাধ্যমে আমেরিকার দখলদারিকত্বকে পরিকল্পিতভাবে নাজুক করে দিয়ে নিজেকে প্রধান খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে ইরান।
ইরাক থেকে আমেকিরান বাহিনী উচ্ছেদ করার কাজে ইরান যদি দুর্দান্তভাবে সফল হয়, তবে তার কৃতিত্ব অনেকাংশেই বর্তাবে সোলাইমানির ওপর। তিনি তার জাল বিশাল ব্যাপ্তিতে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, এবং কার্যত ইরাকি জনমতের পুরো দৃশ্যপটে (শিয়া, সুন্নি ও কুর্দি) তিনি নেটওয়ার্ক স্থাপন করেছেন, ‘মার্কিনবিরোধী’ বিশাল এক বাহিনী গড়ে তুলেছেন, যা মার্কিন সৈন্যদের রক্ষক্ষরণ করে চলেছে।

ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাবর্তন করে। ইরাকে আইএসআইএসের আবির্ভাবের ফলে ইরাকে মার্কিন সৈন্যদের ফিরে আসার অজুহাত উপহার দেয়। তবে আমেরিকান সৈন্যদের অবস্থান করার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়।
বুশ বা বারাক আমলের চেয়ে বর্তমান সময়ের অবস্থায় গুণগত পার্থক্য রয়েছে। আসলে সোলাইমানির পরিকল্পনাই যুক্তরাষ্ট্র অনুসরণ করে আসছিল। বাগদাদের অকার্যকর সরকার নিয়ে সামাজিক অসন্তোষ চলছিল, সেটাকে কাজে লাগিয়েই যুক্তরাষ্ট্র তার রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করছিল।

আর ইরাকের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য সৌদি আরবকে উৎসাহিত করছিল যুক্তরাষ্ট্য। শিয়া-প্রাধান্যবিশিষ্ট ইরাকি জাতীয় জীবনে নিজেদের বঞ্চিত অনুভবকারী সুন্নিদের টার্গেট করে সৌদি কূটনীতি।
ইরাকজুড়ে সাম্প্রতিক বিক্ষোভে (এর জের ধরে নভেম্বরে নাজাফে ইরানি কনস্যুলেট পুড়িয়ে দেয়া হয়) যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব ইন্ধন দিচ্ছে বলে ইরান যে অভিযোগ করছিল, তার কিছু ভিত্তি রয়েছে।
বাগদাদে পরবর্তী সরকার গঠন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই চলছি।

এই প্রেক্ষাপটে ইরাকের ইরানি তারকা কিংমেকার দূর করতেই সোলাইমানিকে হত্যা করা হয়। মজার ব্যাপার হলো, বৃহস্পতিবার ইরাকের প্রধানমন্ত্রী আদিল আবদেল-মাহদিকে টেলিফোন করে পম্পেইও বলেন যে আমেরিকান ও ইরাকি জনগণকে রক্ষা করতে ও আমাদের সম্মিলিত স্বার্থ রক্ষা যুক্তরাষ্ট্র সম্ভব সবকিছুই করবে।
পম্পেইও বাগদাদ ও তেহরানকে ইঙ্গিত দেন যে সোলাইমানির হত্যার ফলে যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে ফায়দা নেবে ওয়াশিংটন।

কাকতালীয়ভাবে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় সোলাইমানির সাথে আবু মাহদি আল-মুহান্দিসও নিহত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ইরান-সমর্থিত পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সের আক্ষরিক অর্থেই প্রধান ব্যক্তি। এই গ্রুপটি আসলে ছিল ইরাকে সক্রিয় মার্কিনবিরোধী মিলিশিয়া গ্রুপগুলোর একটি সম্মিলিত শক্তি।
পম্পেইওর উল্লাসপ্রবণ বার্তা ইঙ্গিত দেয় যে যুক্তরাষ্ট্র এখন ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়া গ্রুপগুলোতে মাথাহীন মুরগি মনে করে।
গত ৮ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্যে চারটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল। প্রথমত, ইরানি সরকারকে পেছনে ঠেলতে যুক্তরাষ্ট্র আরো চাপ সৃষ্টি করবে।
দ্বিতীয়ত, ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তিটি নস্যাৎ করতে যুক্তরাষ্ট্র আরো জোরালো ভূমিকা নেবে।
তৃতীয়ত, অচলাবস্থা কেবল যুক্তরাষ্ট্র-ইরানে সীমিত না থেকে আরো অগ্রসর হয়ে ন্যাটোকেও তাতে সামিল করার ইঙ্গিত দিয়েছেন ট্রাম্প।

চতুর্থত, যুক্তরাষ্ট্রের সামে অনেক বিকল্প হাজির হবে। কারণ ট্রাম্পের ভাষায় যুক্তরাষ্ট্র এখন তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনে বিশ্বে এক নম্বর। মধ্যপ্রাচ্যের তেলের আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন নেই। ট্রাম্প বলেন, মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে মার্কিন কৌশল এগিয়ে নিতে সামরিক শক্তি ব্যয় করতে যুক্তরাষ্ট্র ইতস্তত করবে না।

ট্রাম্পের এই বাগাড়ম্বড়তা কতটুকু বাস্তব? ইউরোপের সমর্থন জোগাড় করতে কঠিন অবস্থায় পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। চুক্তিটি ত্যাগ করার জন্য ইউরোপিয়ানদের প্রতি ট্রাম্পের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সাথে যোগ দিয়ে জানায় যে তারা ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তিটি রক্ষা করতে চায়। ইতোমধ্যেই ওয়াশিংটনে প্রতিনিধি সভায় ইরানের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের যুদ্ধ করার ক্ষমতা সীমিত করার চেষ্টায় শুক্রবার একটি চুক্তি পাস করেছে।
তেহরান মার্কিন সেনাবাহিনীর সুনামের ওপর মারাত্মক আঘাত হেনেছেন। মার্কিন ঘাঁটি কতবার ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের হামলার মুখে পড়েছে? উপগ্রহের ছবিতে আইন আল আসাদ বিমান ঘাঁটিতে ব্যাপক ক্ষতির দৃশ্য দেখা যায়।
ট্রাম্পের হুমকিতে ইরানিরা ভীত হবে না। প্রতিশোধ অবশ্যই আসছে।

আগামীতে যা আসছে তা হলো তৃতীয় দেশে, বিশেষ করে ইরাকে প্রক্সি যুদ্ধ। ইরাকে বিপুল প্রভাব রয়েছে তেহরানের। ইরাকি প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে শুক্রবার প্রকাশিত বিবৃতিতে (বৃহস্পতিবার রাতে পম্পেইওর সাথে ফোনালাপের পর) বলা হয় যে, ইরাক থেকে মার্কিন প্রত্যাহারের যে প্রস্তাব ইরাকি পার্লামেন্টে পাস হয়েছে, তা বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধিদল ইরাকে পাঠানো হবে।
আর শুক্রবারই ইরাকি ধর্মনেতা মুক্তাদা আল-সদর স্থানীয় ও বিদেশী প্রতিরোধ গ্রুপগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে করা নিরাপত্তা চুক্তি শিগগিরই বাতিল করতে হবে, মার্কিন দূতাবাস বন্ধ করতে হবে, আর মার্কিন সৈন্যদের লজ্জাজনকভাবে অবশ্যই বহিষ্কার করতে হবে।

ইন্ডিয়ান পাঞ্চলাইন


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us