চামড়া শিল্পে চরম হতাশা : আড়ালে যা ঘটছে
কোরবানির চামড়া - ছবি : সংগৃহীত
দেশের সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্পে চরম হতাশা দেখা দিয়েছে। ধারাবাহিক রফতানি ধসে মুষড়ে পড়েছেন এ শিল্পের উদ্যোক্তারা। টানা পাঁচ বছর উল্টো পথে চলছে তৃতীয় বৃহত্তম এ রফতানি খাত। প্রতি বছরই কমছে আয়। বেকার হচ্ছেন শ্রমিকরা। রফতানিকারক হারাচ্ছেন বিশ্ববাজার। অথচ বিশ্বসেরা চামড়া রফতানি হয় বাংলাদেশ থেকে। সাভারের চামড়া শিল্পনগরীর কাজ পরিপূর্ণরূপে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা এবং কেন্দ্রীয় বর্র্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) চালু করতে ব্যর্থতার কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, টানা পাঁচ বছর ধরে কমে চলেছে রফতানি। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছে ৪৭ কোটি ৫৮ লাখ ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে রফতানি আয় থেকে ১০ দশমিক ৬১ শতাংশ কম। অর্থবছরের ষষ্ঠ মাস তথা ডিসেম্বরে রফতানি কমেছে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ কম। এ সময়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কম হয়েছে ১২ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ২০১৮ সালের শেষ ছয় মাসে রফতানি কমেছে ১৪ দশমিক ১৮ শতাংশ।
সংশ্লিষ্ট রফতানিকারকদের অভিযোগ, কেবল সিইটিপি চালু করতে না পারার কারণে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ফ্রান্সসহ অনেক দেশ আমাদের থেকে চামড়া আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। ২০০৩ সালে হাজারীবাগ থেকে সাভারে চামড়া শিল্পনগরী স্থানান্তরের উদ্যোগ নেয়ার পর থেকেই সঙ্কটে পড়ে এ শিল্প। প্রায় দুই দশক ধরে রফতানি আয় ঘুরপাক খাচ্ছে একই বৃত্তে। এ সময়ে উদ্যোক্তারা চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পাননি, সময়মতো সরবরাহ করতে পারেননি রফতানি আদেশের পণ্য। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাতটি মুখ থুবড়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
ইপিবি জানায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে যেখানে রফতানি আয় হয়েছিল ১২৩ কোটি ডলার সেখানে দুই বছরের মাথায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রফতানি কমে দাঁড়ায় ৮১ কোটি ৬২ লাখ ডলার। সেবার এক বছরেই রফতানি কমেছে ২০ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ১৩৮ কোটি ডলারের বিপরীতে আয় হয়েছে ১০৮ কোটি ডলার; যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২১.৩৪ শতাংশ কম। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় ১২.০৩ শতাংশ কম। চামড়া রফতানিতে ২৪ কোটি ডলারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও ২৩.৭১ শতাংশ কমে রফতানি হয়েছে ১৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার; যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ২৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। চামড়াজাত পণ্য থেকে ৫৪ কোটি ডলারের রফতানি লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয়েছে ৩৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার; যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ৪৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। আর জুতা ও অন্যান্য পণ্যে গত অর্থবছরে ৬০ কোটি ডলারের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয়েছে ৫৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ খাত থেকে আয় হয় ৫৩ কোটি ডলার।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রায় ১৭ বছরে আগে হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি সরানোর উদ্যোগ নেয় সরকার। গত দুই বছরে সরকারের শক্ত অবস্থানে ট্যানারি সাভারে সরিয়ে নেন উদ্যোক্তারা। কিন্তু পরিবেশগত কারণ দেখিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেন ক্রেতারা। এ দিকে ছয় দশক আগে গড়ে ওঠা চামড়াশিল্পে কয়েক বছর আগে সচল কারখানার সংখ্যা ছিল প্রায় আড়াই শ’। কিন্তু বর্তমানে পুরোদমে উৎপাদন চলছে শ’খানেক কারখানায়। মূলধন ঘাটতি ও বন্ড সুবিধা না থাকায় উৎপাদন বন্ধ আছে অনেক কারখানার। প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ বর্জ্য ফেলা হচ্ছে যেখানে সেখানে। রাসায়নিকযুক্ত বিষাক্ত পানি সরাসরি মিশছে ধলেশ্বরীতে।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, চামড়া শিল্পনগরী স্থানান্তরের দুই বছর পার হলেও এখনো অনেক কারখানা চালুই হয়নি। এ ছাড়া রয়ে গেছে নানা অব্যবস্থাপনা। ফলে রফতানিতে পিছিয়ে পড়ছে চামড়া শিল্প। তারা জানান, ট্যানারিশিল্প সাভারে স্থানান্তর, সেখানে যথাযথ অবকাঠামো গড়ে না ওঠা, কাঁচামাল সংগ্রহে জটিলতা ও নতুন বিনিয়োগ না হওয়াসহ নানা কারণে বাজার হারাচ্ছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। এ অবস্থায় ২০২১ সালের মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকা রফতানি আয়ের লক্ষ্য শুধু কল্পনাতেই থেকে যাবে বলে মনে করছেন তারা।
ইপিবি সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে প্রক্রিয়াজাত চামড়ার পাশাপাশি চামড়া থেকে তৈরি জুতা, ব্যাগ, জ্যাকেট, হাতমোজা, ওয়ালেট, বেল্ট, মানিব্যাগসহ চামড়ার তৈরি হস্তশিল্প পণ্য বিদেশে রফতানি হচ্ছে। বাংলাদেশী চামড়ার বড় বাজারগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ ইতালি, যুক্তরাজ্য, জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, ব্রাজিল, রাশিয়া, চীন, সিংগাপুর, স্পেন, পোল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ভারত, নেপাল, অস্ট্রেলিয়া ও তাইওয়ান। তবে বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা জাপান। শুরু থেকেই এ দেশটি বাংলাদেশে তৈরি চামড়ার জুতায় ‘ডিউটি ও কোটা ফ্রি’ সুবিধা চালু রেখেছে। চামড়াজাত পণ্যের মোট রফতানি পণ্যের ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশই যায় জাপানে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ৩৫টি মাঝারি ও ২৫টি ক্ষুদ্র ট্যানারি নিয়ে চামড়া শিল্পের যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশে। এর মধ্যে ৩৫টি মাঝারি ট্যানারির মধ্যে অবাঙালি মালিকানাধীন ৩০টি ট্যানারি সরকার অধিগ্রহণ করে। কিন্তু রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে এসব ট্যানারি লাভজনক শিল্পে রূপ নিতে পারেনি। ফলে বিরাষ্ট্রীয়করণ প্রক্রিয়ায় এসব ট্যানারি পরে ব্যক্তিমালিকানায় চলে যায়। বর্তমানে দেশে ট্যানারির সংখ্যা প্রায় ২০০। বর্তমানে চামড়া শিল্প থেকে বাংলাদেশের রফতানি আয় ১১৬ কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বৈশ্বিক বাজারের পরিমাণ ২১ হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার। হিসাব অনুযায়ী, বৈশ্বিক বাজারের মাত্র ০.৫ ভাগ রফতানি করে বাংলাদেশ।
লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মহিন নয়া দিগন্তকে বলেন, সম্ভাবনার বিচারে পাদুকাশিল্পে বাংলাদেশের অবস্থান আরো শক্তিশালী করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু হচ্ছে না। এর মানে হলো পরিকল্পনার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা না হলে এ খাত থেকে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়।