জেএনইউ : ভারতীয় গণতন্ত্রের মহাপরীক্ষা হচ্ছে যেখানে
জেএনইউ : ভারতীয় গণতন্ত্রের মহাপরীক্ষা হচ্ছে যেখানে - ছবি : সংগৃহীত
জওহেরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) অনিবার্য বিষয় হলো স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক ভিন্নমতের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা, পড়াশোনা ও সংগ্রাম এর মূলমন্ত্র। কিন্তু জেএনইউ কেন ভিন্নমতালম্বপ্রবণ? জেএনইউ ছাত্র সংসদের সাবেক সভাপতি কানহাইয়া কুমারের ভুখমারি সে আজাদি, সামান্তওয়াড় সে আজাদি (ক্ষুধা থেকে সংগ্রাম, সামন্তবাদ থেকে স্বাধীনতা) স্লোগানটি ৫ জানুয়ারি ক্যাম্পাসে মুখোশধারীদের সহিংসতার বিরুদ্ধে জেএনইউ’র ছাত্রদের সংগ্রামের সঙ্গীতে পরিণত হওয়ার কী ব্যাখ্যা থাকতে পারে?
একেবারে শুরু থেকেই জেএনইউ গণতান্ত্রিক ভিন্নমতাবলম্বীদের জন্য মহাপরীক্ষা হয়ে আছে। ১৯৬৯ সালে পার্লামেন্টে এক আইনের অধীনে (ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহেরলাল নেহরুর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য) বিশ্ববিদ্যালয়টি জন্মলাভ করে। ১৯৬৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উত্তাল বিক্ষোভের এক বছর পর বিশ্ববিদ্যালয়টি আত্মপ্রকাশ করেছিল। ওই সময় পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতেও বিক্ষোভ ফেটে পড়েছিল। ওই সময় দিনের বেলার সাধারণ ক্লাসের মতোই ডিনারের পর গভীর রাতে ডাইনিং হলে বক্তৃতাও হয়ে পড়েছিল নিয়মিত ব্যাপার।
কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ভিন্নমত প্রকাশ ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা হয়ে পড়ে প্রতিষ্ঠানটির লালিত মূল্যবোধ। ছাত্রদের মধ্যে স্টুডেন্টস ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া (এসএফআই)সহ বামপন্থী ইউনিয়ন, অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস ফেডারেশন (এআইএসএফ) ও ফ্রি থিঙ্কার্স (উদার ও রক্ষণশীলদের শিথিল জোট) ইত্যাদি নামে বিভক্তি ও আবেগপ্রবণ মতানৈক্য থাকলে কখনো সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েনি। তারা পোস্টার, উদ্ভাবনমুখী স্লোগান দিয়ে সৃষ্টিশীলতার আশ্রয় নিত। মিডিয়ায় নিয়মিতভাবে একে ‘শ্বেত হস্তি’ হিসেবে অভিহিত করলেও এর শিক্ষাগত উদ্দীপনা ও ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে ও যুক্তরাজ্যের সাসেক্সের মতো বাম ধারার প্রতিষ্ঠানের সাথে সমান তালে ছোটার কারণে অরাভালি হিলসের পাদদেশে থাকা প্রতিষ্ঠানটি অনেকটাই অগোচরেই থেকে যায়।
১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার আগে ও এরপর ১৯৮৩ সাল ছাড়া কর্তৃপক্ষ কখনোই এই কেন্দ্রটির ওপর চড়াও হয়নি। নির্মম পরিহাসের বিষয় হলো, উভয় ঘটনাই ঘটে ইন্দিরা গান্ধীর আমলে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়টি তার বাবার নামেই।
জরুরি আইন জারি ছিল এই কেন্দ্রের জন্য প্রথম রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। ১৯৭৫ সালে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ছাত্র সংগঠনগুলো রেসিস্ট্যান্স নামে একটি গোপন দল গঠন করে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নিয়মিত বুলেটিন প্রকাশ করতে থাকে। এর জের ধরে ওই বছরের ৮ জুলাই ভোর ৫টায় ভিন্নমতালম্বী ৬০ ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়, পুলিশ আইকনিক ছাত্রনেতা দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠিকে (ডিপিটি, তিনি ২০২০ সালের ২ জানুয়ারি পরলোকগমন করেন) খুঁজতে শুরু করে। তার খুঁজতে গিয়ে পুলিশ এমফিলের ছাত্র প্রবীর পুরকায়স্থ নামে একজনকে গ্রেফতার করে। তিনি ছিলেন একেবারে নির্দোষ। তাকে প্রায় এক বছর আটক করে রাখা হয়।
পুলিশ যদিও জানত যে তারা ভুল লোককে আটক করে রেখেছে, কিন্তু কেউ তাকে মুক্ত করতে উদ্যোগী হতে সাহস করেনি। পরে প্রধানমন্ত্রীর অফিসের নির্দেশে তাকে ছাড়া হয়। আর ত্রিপাঠি জেএনইউর পিএইচডি কর্মসূচিতে ভর্তি হতে পারেননি। অন্যদিকে জনপ্রিয় সমাজবাদী ছাত্রনেতা আনন্দ কুমারকে পিএইচডি করতে হয়েছে শিকাগো থেকে।
১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশক ছিল বিশ্বজুড়ে বুদ্ধিবৃত্তিক উদ্দীপনার সময়কাল। এ সময় সাহিত্য, সঙ্গীত, সংস্কৃতি, মঞ্চ ও সিনেমায় সৃষ্টিশীলতার জোয়ার বয়ে গিয়েছিল। এটি জেএনইউর ছাত্রদের প্রভাবিত করেছিল।
দ্বিতীয় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ এসেছিল ১৯৮৩ সালে। নতুন ভর্তিনীতি নিয়ে ছাত্র ও ফ্যাকাল্টির মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হয়। এক ফ্যাকাল্টি সদস্য জনৈক ছাত্রকে বর্ণগত ইস্যুতে অপমান করলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে জেএনইউ এসসি/এসটি ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন মামলা দায়ের করে। ছাত্র সংসদ সমর্থন করে এসোয়েশনকে। এ সময় আরেক ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে বিরোধকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা আরো বেড়ে যায়। উত্তেজনার একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়, বেশ কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়, এক বছরের জন্য কোনো ভর্তি হয়নি। পরে যখন বিশ্ববিদ্যালয় খোলে, তখন হোস্টেল ও রাজনীতি নিয়ে বেশ কিছু নিয়মে পরিবর্তন আনা হয়।
গত চার বছরে জেএনইউ ছাত্ররা আবারো বিপুলভাবে আন্দোলনে নামে। বৈরী প্রশাসন ও পেশীশক্তির হিন্দুত্ববাদী সরকারের বিরুদ্ধে তারা এই পথ বেছে নেই। প্রেসিডেন্ট কানহাইয়া কুমার যখন জেএনইউর ছাত্র সংসদের নেতা ছিলেন, তখন বিজেপির উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়টি ভিন্নমতের প্রতীকে পরিণত হয়। এখন এনডিএ সরকারের রিবুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিবাদের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে এটি। ৫ জানুয়ারি মুখোশধারী গুণ্ডাদের হামলার পর উত্তেজনা তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। ওই হামলায় ছাত্র ও ফ্যাকাল্টি সদস্যসহ ৩০ জনের বেশি আহত হয়।
আগের আন্দোলনগুলো থেকে বর্তমানেরটি চারটি কারণে ভিন্ন। প্রথমত, বহিরাগতদের মাধ্যমে বড় মাত্রায় সহিংসতা সৃষ্টি, দ্বিতীয়ত, বিক্ষোভরত ছাত্রদের আড়াই মাস ধরে ক্লাস বর্জন, তৃতীয়ত, হিন্দুত্ববাদী শক্তি বামপন্থী ছাত্রদের ওপর বিনা প্ররোচনায় বেশ কয়েকবার পাশবিক শক্তি প্রয়োগ করা ও চতুর্থত, মিডিয়ার অনেক বেশি কভারেজ। এমনটা হওয়ার কারণ জেএনইউ এলিট প্রতিষ্ঠান ও তা ভিন্নমতের মহাপরীক্ষা হওয়া।
জেএনইউকে অবশ্যই এই সঙ্কট নিরসন করতে হবে। অবশ্য আলোচনার সুযোগ এখনো রয়েছে। কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই ছাত্রদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা তুলে নিতে হবে, ভর্তি ফি হ্রাস করতে হবে, সুষ্ঠুভাবে নির্বাচিত ছাত্র ইউনিয়নকে স্বীকৃতি দিতে হবে। আর ছাত্রদেরকেও ক্লাস বর্জন থেকে সরে আসতে হবে। আর জেএনইউর গৌরব রক্ষার জন্য শীর্ষ নেতৃত্বকে অবশ্যই ছাত্রদের প্রিয়ভাজন জি পার্থসারথীর মতো ভিশনারি কাউকে ভিসি হিসেবে নিয়োগ করতে হবে।
ইন্ডিয়া টুডে