সোলাইমানিকে হত্যা : আসল টার্গেট চীন?
কাসেম সোলাইমানি - ছবি : সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের ইরানি মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার কারণ হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইরানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বদলা ও ভীতি প্রদর্শনের কথা বলা যেতে পারে, বাস্তবে এটি হতে পারে চীনের বিরুদ্ধে কৌশলগত প্ররোচনা। এটিই কেন আসল কথা এবং এই বিশেষ পদক্ষেপটি স্রেফ বিরাট একটি ধাঁধার একটি অংশ মাত্র তা বুঝতে হলে আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির সব পদক্ষেপ আমলে আনতে হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি আচ্ছন্ন রয়েছে কিভাবে তাদের পরাশক্তির মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখা যাবে তা নিয়ে। ওই কৌশলের অংশ হিসেবেই দেশটি ন্যাটোর মতো শক্তিশালী জোট রক্ষা করে চলেছে এবং কার্যত বিশ্বের সব প্রান্তেই তার সামরিক উপস্থিতি বজায় রেখেছে।
অনেক বছর ধরেই জিগনিউ ব্রেজজিনস্কির মতো প্রভাবশালী নীতিনির্ধারকেরা যুক্তি দিয়ে আসছেন যে যুক্তরাষ্ট্র তার শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখার জন্য অবশ্যই আরো অগ্রসর হবে। অনেকে মনে করেন, ইরান, রাশিয়া ও চীনকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার কারণ, এসব দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্র পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি এবং ইসলামি চরমপন্থীদের উস্কে দিচ্ছে, কারণ এই তিন দেশেরই বিপুলসংখ্যক মুসলিম জনসংখ্যা রয়েছে, যা তাদের নিজের দেশের বিরুদ্ধেই সন্ত্রাসীতে পরিণত হতে পারে।
এসব ভূখণ্ডে ইসলামি চরমপন্থা সৃষ্টি করার মাধ্যমে দেশে তৈরী এসব সন্ত্রাসী যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ নিয়ে বিদেশী সরকারগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবে। এতে করে আমেকিরান সৈন্যদের আত্মত্যাগের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পাবে।
এর ফলে বিশ্বপর্যায়ে এ ধরনের প্রক্সি যুদ্ধ স্থায়ী বিষয়ে পরিণত হবে। ইরাকে আক্রমণ, সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ, লিবিয়ায় বোমা হামলা, এবং এ ধরনের আরো কিছু পদক্ষেপের ফলে ইসলামিক স্টেটের মতো চরমপন্থী গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে যা ইরান, রাশিয়া ও এমনকি চীনের প্রতি সরাসরি হুমকি।
চীনের ক্ষেত্রে উইঘুর গ্রুপের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে চীনের উত্তর-পূর্বের মুসলিম সংখ্যালঘুদের মধ্য থেকে। তারা অস্ত্র পাচ্ছে বাইরের শক্তিগুলোর কাছ থেকে। উইঘুর বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বোমা হামলা, ছুরিকাঘাত ও অন্যান্য ধরনের সহিংস উপায়ে পশ্চিম চীনের অংশবিশেষকে সন্ত্রস্ত্র করে রেখেছে। আর বিবিসির মতো পাশ্চাত্যের সংবাদ সংস্থাগুলো এসব খবর ফলাও করে প্রচার করে।
চীনা সরকার সহিংসতা বন্ধ করা ও সিরিয়ার মতো গৃহযুদ্ধ প্রতিরোধ করার চেষ্টায় ১০ লাখ উইঘুরকে আটকে রেখেছে। কিন্তু এ ধরনের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রায়ই মার্কিন হুমকি ও বৈরিতা দেখা যায়।
যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যভাবেই বলছে যে তারা চীনকে ‘কৌশলগত প্রতিযোগী’ বিবেচনা করে। এই পরিভাষাটি আসলে শত্রুর বিনীত প্রতিশব্ধ। যুক্তরাষ্ট্র ২০১৩ সাল থেকেই সক্রিয়ভাবে চীনের বিরুদ্ধে সামরিক উস্কানি দিয়ে যাচ্ছে। ওই সময় ওবামা প্রশাসন কয়েক দশক ধরে শান্ত থাকা দক্ষিণ চীন ও পূর্ব চীনকে হঠাৎ করে উত্তপ্ত ক্ষেত্রে পরিণত করেন।
তবে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ওই ফাঁদে পা না দিলে তাওয়ান, উত্তর কোরিয়া ও জিনজিয়াংকে ব্যবহার করে চীনকে আরো বড় সমস্যায় ফেলার চেষ্টা করছে ট্রাম্প প্রশাসন। এই কৌশলের অংশই হচ্ছে হংকংয়ের ব্যাপারে চীনা পদক্ষেপ।
সবশেষে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য চুক্তি থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যেই অর্থনীতির ব্যাপারে চীনের প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করে যাচ্ছে। মার্কিন কোম্পানিগুলোতে চীনা বিনিয়োগে বিধিনিষেধ আরোপ করা, হুওয়াইয়ের মতো চীনা কোম্পানির সাথে ব্যবসা করতে আমেরিকান উচ্চপ্রযুক্তির সরবরাহকারীদের বাধা দেয়া, চীনা ছাত্র ও বিজ্ঞানীদের গুপ্তচর হিসেবে অভিযুক্ত করার মতো কাজের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টভাবেই বলছে যে তাদের প্রধান টার্গেট হলো চীন।
এই চিত্রে সোলাইমানি কিভাবে খাপ খায়? ইরানি তেলের প্রধান আমদানিকারক হলো চীন। চীন হলো সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার সদস্য এবং এর মাধ্যমে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ অংশীদার।
অন্যান্য মঞ্চে সামরিকভাবে চীনকে প্ররোচিত করতে তেমন সফলতা না পেয়ে যুক্তরাষ্ট্র খুব সম্ভবত অন্যান্য দেশে সামরিক সঙ্ঘাতে যেতে চীনকে প্ররোচিত করছে। কাজটি করতে যাচ্ছে অ
স্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্ডিন্যান্ডের হত্যার ফলে জার্মানি যেভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল, ঠিক সেভাবে।
ফলে গুগলে ফ্রাঞ্জ ফার্ডিন্যান্ড সার্চ দিলে সোলাইমানির হত্যাকাণ্ডের খবর ভেসে আসাটা কাকতালীয় কোনো ঘটনা নয়। আর মনে রাখতে হবে, এসব অনুসন্ধানের বড় অংশটি হচ্ছে ওয়াশিংটনে।
স্বাভাবিকভাবেই চীন শান্ত থাকার আহ্বান জানাচ্ছে। কারণ ইরান যদি সামরিক প্রতিশোধ ত্বরান্বিত করে, তবে রাশিয়া তাতে জড়িয়ে পড়বে। আর সেক্ষেত্রে চীনও দূরে থাকতে পারবে না। যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে চীনের কোনো স্বার্থ নেই। কারণ সে জানে, পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই হয় এর শিকার।
চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নির্ভর করে স্থিতিশীল বৈশ্বিক পরিবেশের ওপর। অন্যদিকে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র চায় বিশৃঙ্খলা, কারণ এতে করে সে একক পরাশক্তি হিসেবে বিরাজ করতে পারবে।
ইরান ও রাশিয়ার প্রতি যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে বৈরী হলেও আমেরিকার আসল বিষয় হলো চীন। কারণ ইরান বা রাশিয়া কেউই অদূর ভবিষ্যতে পরাশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে টলাতে পারবে না। পেন্টাগনের সব যুদ্ধ খেলা চীনের বিরুদ্ধে। এই খেলা কখনো ইরান বা রাশিয়ার বিরুদ্ধে হয় না।
চীনকে ‘সমমর্যাদার প্রতিপক্ষ’ হিসেবে স্বীকার করা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র সামরিক বাহিনী তার ক্রমবর্ধমান সামরিক বাজেটকে যৌক্তিক করতে পারে না। চীন যদি অন্তত ‘হুমকি’ না হয়, তবে সামরিক-শিল্প কমপ্লেক্স মারাত্মকভাবে ছোট হয়ে যাবে।
বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রকে স্থানচ্যুত করে ফেলবে চীন। আর এর পর স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক শক্তির আবির্ভাব ঘটবে। এই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের পদক্ষেপ আসলে চীনকে প্ররোচিত করার জন্য সতর্কভাবে প্রণীত হিসাবি চাল, যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র উটের পিঠ ভেঙে ফেলার কাছাকাছি নিয়ে এসেছে আমাদেরকে।
লেখক : চীনা অর্থনৈতিক সম্পর্কবিষয়ক আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব এবং গ্রন্থকার, হোয়াট দি ইউএস ক্যান লার্ন ফ্রম চায়না, ও উইল চায়নাস ইকোনমি কলাপস? তিনি ইতোপূর্বে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর ও অ্যাডজাক্ট প্রফেসর, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি ও প্যাস ইউনিভার্সিটি ছিলেন।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট