দুনিয়ার সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্রপ্রধান
সানা মারিন - ছবি : সংগ্রহ
সোশ্যাল মিডিয়ায় ভীষণ সক্রিয়। ইনস্টাগ্রামে অনবরত আপডেট দিতে থাকেন। কাজ হোক বা ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি, সবের উঁকিঝুঁকি থাকে তাতে। এই যেমন ডিনারে নতুন কী রাঁধলেন, পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে হঠাৎ দেখা করে কী করলেন। এই ক’দিন আগে এক মাসের শিশুকন্যাকে দিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন হল্যান্ড আর নরওয়ে। বেড়ানোর একটা অ্যালবাম দিব্যি পোস্ট করে দিয়েছেন ইনস্টাগ্রামে। আবার তেমনই মেয়েকে আদর করার আদুরে কিছু ছবি, তা–ও আছে তার ‘ইনস্টাস্টোরি’–তে। বছর চৌত্রিশের সাধারণ উচ্ছ্বল তরুণী যেমন হন, তেমনই।
তবে তফাত একটা আছে। জোরাল তফাত। বছর চৌত্রিশের সানা মারিন সদ্য ফিনল্যান্ডের নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে কমবয়সী রাষ্ট্রনেতাও তিনিই!
জয় নিশ্চিত হওয়ার পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে তার সোশ্যাল মিডিয়া প্রীতি নিয়ে অবশ্যম্ভাবী প্রশ্ন ছিল। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সানা বুঝিয়ে দেন, তিনি এমনই। তাকে ঠিকঠাক উদ্ধৃত করলে যা দাঁড়ায়, তা এইরকম : ‘আমি যুব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করি। আমার নিজস্ব কিছু ব্যক্তিস্বত্তা আছে। আর আমার কোনো ভানভনিতা নেই। প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তা পাল্টাবে না। সুতরাং আমি আমার আচার–আচরণ বদলাব না। তবে অবশ্যই কী বলছি, কী করছি, তা নিয়ে সতর্ক থাকব।’
দেশের শীর্ষপদে আসীন সানার গল্প ঠিক ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’ গোছের নয়। পুরোদস্তুর লড়ে এই পদাধিকারী হয়েছেন ফিনল্যান্ডের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নেত্রী। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে ছিলেন দেশের পরিবহণমন্ত্রী। সক্রিয় রাজনীতিতে আসা ২০১২–এ। তখন মাত্র ২৭ বছর বয়সেই। তখনই নিজের এলাকার কাউন্সিলর হয়েছিলেন সানা। এমপি হন ২০১৫ সালে।
তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ডিসেম্বরের গোঁড়াতেও ফিনল্যান্ড সরকারের রাশ ধরে ছিলেন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নেতা অ্যান্টি রিনে। শ্রমিকবিক্ষোভ ও আন্দোলনে অবরুদ্ধ দেশে তখন সঙ্কট তুঙ্গে। শরিক সেন্টার পার্টি সরকার থেকে সমর্থন তুলে নেয়ায় পদত্যাগ করেন রিনে। তার বদলে নতুন প্রধানমন্ত্রী হন সানা মারিন।
যদিও রাজনীতিতে আসবেন, কস্মিনকালে ভাবেননি। অথবা ভাববার অবকাশ পাননি। তার কথায়, ‘হাইস্কুলে পড়ার সময় মনে হয়েছিল, যারা রাজনীতি করেন, তারা অন্যরকম। মানে অন্য ধরনের পরিবার থেকে আসেন।’
রাজনীতির মাধ্যমে জনসেবার ভাবনা মাথায় আসে অনেক পরে। তখন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে একের পর চাকরিতে থিতু হওয়ার চেষ্টায় সানা। রাজনীতির আসার কারণ? তাঁর জবাব, ‘নাগরিক অধিকারকে সমাজ যেভাবে দেখে, তাতে প্রভাব ফেলতেই আমার রাজনীতিতে যোগ দেয়া।’
দুনিয়ার সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাতারাতি বেশ কিছু চমক দেখেছে ফিনল্যান্ড। যেমন সানার মন্ত্রিসভায় মোট ১৯ জন মন্ত্রীর ১২ জনই মহিলা। এবং তাদের অধিকাংশই তিরিশের কোঠায়। পাঁচ দলের জোটে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের সরকার। অন্য চারটি দলের শীর্ষেও নেতা নন, নেত্রীরা। এমন মন্ত্রিসভাকে স্বাগত জানিয়ে উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারেননি ফিনল্যান্ডের রাশভারী প্রেসিডেন্ট সাওলি নিনিস্তো। বিশ্বে ষাট বা সত্তরোর্ধ পুরুষ রাষ্ট্রনেতাদের দাপটের যুগে এই ছবি অবশ্যই স্মরণীয়।
মহিলা–প্রধান সরকার গড়া কি নেহাতই কাকতালীয়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত?
ফিনল্যান্ডের রাজনৈতিক মহল তা নিয়ে কাটাছেঁড়া করছে। তবে মহিলা মহলের এই আধিপত্যের পেছনে সম্ভবত সানার বেড়ে ওঠার পরিসরও বিচার্য। একা মায়ের সন্তান সানা। বাবার সঙ্গে সেভাবে পরিচয়ই হয়নি। জ্ঞান হওয়া ইস্তক জেনেছেন তার পরিবার বলতে মা ও মায়ের বান্ধবী।
পশ্চিমের বহু দেশের মতো ফিনল্যান্ডও সম্প্রতি দক্ষিণপন্থার উত্থান দেখেছে। জাতীয়তাবাদী ‘ফিন্স পার্টি’ এপ্রিলের সাধারণ নির্বাচনে বেশ ভালো ফল করেছে। যদিও শেষমেশ সরকার গড়েছে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নেতৃত্বাধীন জোট। সেক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার মতো ‘জাতীয়তাবাদীদের’ আমলে ফিনল্যান্ড সরকার দৃষ্টান্তই বটে। স্লোভাকিয়ার প্রেসিডেন্ট জুজানা কাপুতোভার মতো বিশ্বের জনাকয়েক নেত্রী বহমান উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। সানাও তাদেরই একজন হলেন।
ফিনল্যান্ডের নতুন প্রধানমন্ত্রীর চলার পথ অবশ্য বড় একটা মসৃণ হবে না। শ্রমিক অসন্তোষ এখনো বড় সমস্যা। তবু তরুণী প্রধানমন্ত্রীর ওপর আস্থা রাখছে ফিনল্যান্ডের প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক মহল। ২০১০ থেকে নাগাড়ে নানা অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত ফিনল্যান্ড অভ্যস্ত হয়েছে অরাজকতায়। তাবৎ ফিনল্যান্ডবাসীর আশা, নতুন দশকে দেশে নতুন দিন আনবেন সানা। সংবেদনশীল রাজনীতি নিয়ে আসবেন। যা ইদানীং বিরল।
এর আগেও মহিলা প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে ফিনল্যান্ড। তবে এত কমবয়সী নয়। তা নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বেশ হইচই ফেলে দিয়েছে। নতুন প্রধানমন্ত্রী অবশ্য তাকে একেবারেই আমল দিচ্ছেন না। তার কথায়, ‘বিদেশ কী, দেশের সংবাদপত্রেও আমাকে নিয়ে যা যা প্রতিবেদন বেরিয়েছে, উল্টেও দেখিনি। ওসবে গুরুত্ব দিই না। পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতিতে সরকারে এসেছি। এবার তার জন্য উঠেপড়ে লাগতে হবে। আমার বিশ্বাস, কাজের মাধ্যমেই মানুষের বিশ্বাস ফিরে পাব।’
প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসে একটা বড় দাবিও করেছেন তিনি। নিন্দুকদের প্রতি যা তার জবাবও বটে। প্রধানমন্ত্রী সানা বলেছেন, ‘ফিনল্যান্ড চার বছরে শেষ হয়ে যাবে না। বরং আরও বড়, আরো শক্তিধর হবে। তার জন্যই আমরা কাজ করে যাব। এমন একটা সমাজ গড়তে চাই, যেখানে মানুষ মাথা উঁচু করে বাঁচবেন। কোনো স্বপ্নকেই বেশি বড় বা সাধ্যের বাইরে বলে ভাববেন না। ফিনল্যান্ডের প্রতিটি শিশু যা হতে চাইবে, বড় হয়ে তারা তা–ই হবে। সে তার পরিবারের বিত্তের নিরিখে উচ্চ, মধ্য বা নিম্ন— যা–ই হোক।’
সমাজতন্ত্রী। তাই মানবাধিকার আর সাম্যকে শীর্ষে রাখেন।
ফিনল্যান্ডের রাজনীতিতে বয়স আর অভিজ্ঞতার সমন্বয়ই সব নয়। বয়স আর অভিজ্ঞতা সবসময় সমার্থকও নয়। তার প্রমাণ দিতেই দৃপ্ত পদক্ষেপে ভবিষ্যতের দিকে চলেছেন সানা মারিন।
সূত্র : আজকাল