যেকোনো মুহূর্তে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ?
যেকোনো মুহূর্তে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ? - ছবি : সংগ্রহ
নতুন বছরের তৃতীয় দিন ৩ জানুয়ারি দেশ-বিদেশের নিউজ ফিডগুলোতে লিড নিউজ হিসেবে ভাসতে থাকে একটি খবর- মার্কিন ড্রোন হামলায় ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাসেম সোলাইমানি নিহত। ঠিক তার পর থেকেই বিশ্বজুড়ে সার্চ ইঞ্জিনগুলোতে যে বিষয়টি মানুষের খোঁজার তালিকায় শীর্ষে উঠে আসে তা হলো- তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যারা জেনারেল কাসেম সোলাইমানি সম্পর্কে জানতেন না, এ ঘটনাতে তারা হতবাক হয়ে পড়েন। প্রশ্ন জাগে, কে এই সোলাইমানি?
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির পর দেশটির সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে আলোচিত নাম মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি ছিলেন বিপ্লবী গার্ডস বাহিনীর এলিট ইউনিট কুদস ফোর্সের প্রধান। দেশের বাইরে ইরানের সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় সোলাইমানি ছিলেন এককভাবে মূল ব্যক্তি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণেও তার ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। বিগত দুই দশক ধরে ইরাক, ইয়েমেন, সিরিয়া ও লেবাননের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোতে শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর শক্তিশালী হয়ে ওঠার পেছনে কাসেম সোলাইমানির অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। ফলে অনেক দিন ধরেই তিনি ছিলেন আঞ্চলিক শত্রু সৌদি আরব, ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেটে। তবে এ-ও শোনা গিয়েছিল যে, আইএস ও দায়েশ গোষ্ঠীকে খতম করার মিশন শেষ হওয়ার জন্যই সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র তাকে টার্গেট বানায়নি।
লেবানন বা সিরিয়া থেকে গত শুক্রবার ভোরের দিকে বাগদাদে পৌঁছেছিলেন সোলাইমানি ও তার কয়েকজন সঙ্গী। বাগদাদ বিমানবন্দর থেকে দুটি গাড়িতে করে রওনা হন তারা। বিমানবন্দরের কার্গো টার্মিনালের কাছে পৌঁছামাত্র একটি মার্কিন ড্রোন থেকে ওই দুই গাড়িতে ছোড়া হয় ক্ষেপণাস্ত্র। তাতে সোলাইমানি ও ইরাকি মিলিশিয়া কমান্ডার আবু মাহদি আল-মুহান্দিসসহ অন্তত সাতজন নিহত হন।
কাসেম সোলাইমানি তার দেশে একজন রহস্যময় পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত হলেও ইরান-ইরাক উভয়ে দেশেই দেখা গেছে অদেখা এ জেনারেলের প্রতি তাদের ভালোবাসার সীমাহীন বহিঃপ্রকাশ। গত সোমবার তেহরানে তার এক জানাজাতেই জড়ো হয়েছিল ৭০ লক্ষাধিক মানুষ। এটি ছাড়াও ইরাক ও ইরানের আরো কয়েকটি স্থানে তার লাশ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, যার প্রত্যেকটিতেই লোক সমাগম হয়েছিল অভূতপূর্ব।
কাসেম সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই উদ্বেগ বেড়েছে পুরো বিশ্বে। বিশ্লেষকদের ধারণা, এর ফলে নতুন করে আরেকটি বড় মাপের যুদ্ধ দেখতে যাচ্ছে বিশ্ববাসী। এ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিকরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। নিজ দেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে মুখে পড়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাট দলের নেতারা এ হত্যাকাণ্ডকে ট্রাম্পের বোকামি বলে ‘আখ্যা’ দিয়েছেন। অন্যদিকে মার্কিন সিনেটররা দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধের নির্দেশ দেয়ার ক্ষমতা প্রত্যাহার করে নিতে মার্কিন কংগ্রেসের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
তবে শুধু এটিই নয়, ট্রাম্প বিগত তিন বছরে এমন অনেক কাজই করেছেন, যা আগের মার্কিন প্রেসিডেন্টরা করতে অনেকবার ভাবতেন। তারপর এক সময় পিছিয়ে যেতেন। জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানীর স্বীকৃতি দেয়া, ফিলিস্তিনের সাহায্য বন্ধ করা, গোলান হাইটসকে ইসরাইলের বলে ঘোষণা দেয়া, ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তি থেকে সরে আসা, বিভিন্ন দেশের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধের সূত্রপাত করা, আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলো থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করাসহ নানা বিষয় বারবারই ব্যাপক সমালোচনার মুখে ফেলেছে তাকে।
কিন্তু নিজ জেদ থেকে করা এই কাজগুলোর কোনোটি থেকেই সরে যাননি তিনি। তিন বছরের মেয়াদে দুই-তিনবার অভিশংসনের মুখে পড়া সত্ত্বেও ড্যাম কেয়ারভাবেই করে গেছেন এসব কাজ। এতে শত্রু দেশ ক্ষিপ্ত হলো, না মিত্র দেশ নারাজ হলো, তা নিয়ে তিনি মাথা ঘামাননি কোনো সময়েই। বরং এসবের জন্য জনগণের মুখোমুখি না হয়ে উল্টো টুইটারে নিজের পদক্ষেপের যৌক্তিকতা বর্ণনা করেছেন। সেই সাথে তার মতো সাহস দেখাতে না পারায় অক্ষমতার জন্য ভর্ৎসনা করেছেন পূর্বসূরিদের।
এদিকে এ হত্যাকাণ্ডের বিশ্বের বড় বড় শক্তিগুলোতে দেখা দিয়েছে ব্যাপক উদ্বেগ। সোলাইমানিকে হত্যার নিন্দা জানিয়েছে রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, সিরিয়া, চীন ও ইউরোপিয়ান কাউন্সিল। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির সভাপতিত্বে দেশটির শীর্ষ নিরাপত্তা কাউন্সিল বলেছে, ‘সঠিক সময়ে ও সঠিক জায়গায়’ এ হত্যার প্রতিশোধ নেয়া হবে।
বিবিসির বিশ্লেষক জেরেমি বোওয়েন বলছেন, ইরানের হাতে আধুনিক রকেট ও মিসাইল আছে। কিন্তু এসব অস্ত্র যদি তারা মার্কিন বাহিনীর ওপর প্রতিশোধমূলক হামলার জন্য ব্যবহার করে তাহলে পরিস্থিতি বরং খারাপ হতে পারে। তারা যদি উপসাগরে মার্কিন জাহাজে আক্রমণ চালায় সেটাও প্রচণ্ড পাল্টা হামলা ডেকে আনতে পারে। কারণ ইরানের তেল শোধনাগারগুলো পারস্য উপসাগরে উপকূলের পাশেই। যুক্তরাষ্ট্রের যে বিপুল সামরিক ক্ষমতা, তাতে এগুলো খুব সহজেই তাদের টার্গেটে পরিণত হবে।
আবার ইরানের হুমকির পর পর ট্রাম্পও ঘোষণা করেছেন, তেহরান আমেরিকানদের ওপর বা মার্কিন সম্পদের ওপর হামলা চালালে ইরানের ৫২টি লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র ‘খুব দ্রুত ও অত্যন্ত কঠিন’ হামলা চালাবে। ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ৫২টি লক্ষ্যস্থল নির্ধারণ করেছে, এগুলোর মধ্যে কিছু ইরান ও ইরানের সংস্কৃতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও উঁচু স্তরের। আর ওই লক্ষ্যস্থলগুলোতে ও ইরানে খুব দ্রুত এবং অত্যন্ত কঠিন আঘাত হানা হবে।
এ অবস্থায় ইরান হয়তো প্রতিশোধ নিতে ভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিতে পারে। সীমিত সামরিক শক্তির কারণে ইরানকে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় কম শক্তিধর মনে হতেই পারে। কিন্তু ইরানের মানবঅস্ত্র যেকোনো বিচারেই মার্কিনিদের থেকে অনেক দুর্ধর্ষ। বিশেষ করে ইরানের লক্ষ্য কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রকে লড়াইয়ে হারিয়ে দেয়া নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের স্বার্থ এবং মার্কিনিদের মিত্রদের সর্বোচ্চ ক্ষতি সাধনই তাদের মূল লক্ষ্য। ফলে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে, নির্দিষ্ট কোনো স্থান বা কাল নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রকে এর জের টানতে হতে পারে অনন্তকাল। ইরান যুক্তরাষ্ট্রকে এ উপলব্ধি এনে দেবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মার্কিনিরা কোথাও এবং কোনো সময়েই নিরাপদ নয়।
এক্ষেত্রে বিবিসির বিশ্লেষক জেরেমি বোওয়েন বলেছেন, কূটকৌশল বা পরিকল্পনাকারী হিসেবে সোলেইমানি ছিলেন খুবই ক্ষুরধার মেধার অধিকারী। সুতরাং তাকে কখনো হত্যা করা হলে, কী করতে হবে তেমন পরিকল্পনাও হয়তো তিনিই করে গেছেন। সব মিলিয়ে ইরান যে তার হত্যার একটা জবাব দেবে, তা নিশ্চিত। ইরানিরাও মর্মন্তুদ এই ঘটনায় কেবল শোক পালন করেই বসে থাকেনি। তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী যুদ্ধের হুমকি যেমন দিয়েছে, তেমনি আট কোটি ডলারের পুরস্কারও ঘোষণা করেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মাথার জন্য।
বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ইতোমধ্যেই এ পরিস্থিতির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বেড়ে গেছে তেল ও স্বর্ণের দাম। এছাড়া অস্ত্রের বাজারেও লেগেছে এ যুদ্ধোন্মাদনার ধাক্কা। পরিশেষে ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ শেষ পর্যন্ত যদি যুদ্ধে রূপ নেয়, তাহলে তা কি কেবল মধ্যপ্রাচ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, না বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেবে- তা নিয়ে আতঙ্কে আছে বিশ্ববাসী। তবে ইরানের সীমিত শক্তিমত্তার কারণে যদি তা মধ্যপ্রাচ্যেই সীমিত থাকে, তাহলেও বিশ্ব অর্থনীতিতে যে ভয়াবহ প্রভাব পড়বে তা বলাই বাহুল্য।