সোলাইমানি : কৃষক সন্তান থেকে মহানায়ক
কাসেম সোলাইমানি - ছবি : সংগৃহীত
ইরানের রেভলিউশনারি গার্ডস কম্যান্ডার কাসিম সোলাইমানি, শুক্রবার ৪ জানুয়ারি যাকে বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মার্কিন হামলায় হত্যা করা হয়েছে, তিনি ইরানের কুদস (জেরুসালেম) ফোর্সের দীর্ঘদিনের শীর্ষ কর্মকর্তা ছিলেন। আমেরিকা ও তার মিত্রশক্তির তুমুল বিরোধী হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি।
ইরানের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। মধ্যপ্রাচ্যের সবচয়ে ক্ষমতাবান জেনারেল হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীও ছিলেন তিনি।
নিজের দেশে সম্মানিত ও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধক্ষেত্রে আতঙ্কবাহী নাম হলেও সোলাইমানি পশ্চিমে ছিলেন প্রায় অপরিচিত। বলা হয়, আজকের ইরানকে পুরোপুরি বুঝতে গেলে আগে কাসিম সোলাইমানিকে জানা দরকার। ওমান উপসাগর থেকে ইরাক, সিরিয়া লেবানন হয়ে ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূল পর্যন্ত এলাকা যা ইরানে প্রতিরোধের অক্ষ নামে পরিচিত, তার স্রষ্টা ছিলেন এই সোলাইমানি।
১৯৮০-র দশকে সোলাইমানি ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধে বেঁচে গিয়েছিলেন সোলাইমানি, পরে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের বৈদেশিক দায়িত্বে থাকা কুদস ফোর্সের নিয়ন্ত্রণ তুলে নেন নিজের হাতে।
২০০৩ সালে ইরানে মার্কিন অনুপ্রবেশের আগে পর্যন্ত ওই দেশেও প্রায় অপরিচিতই ছিলেন সোলাইমানি। আমেরিকা তার হত্যার জন্য ডাক দেবার পর তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। প্রায় ১৫ বছর পর সোলাইমানি ইরানের সবচেয়ে পরিচিত সামরিক কমান্ডার হয়ে ওঠেন তিনি, রাজনীতিতে প্রবেশের ব্যাপারে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন, তা সত্ত্বেও অসামরিক নেতৃত্বের সমকক্ষ হয়ে ওঠেন ক্ষমতার দিক থেকে। কেউ কেউ মনে করেন, তাদের থেকেও ক্ষমতা বেশি ছিল সোলাইমানির।
২০১৮ সালে জানাজানি হয়ে যায় যে ইরাকের সরকার গঠন নিয়ে উচ্চপর্যায়ের আলাপ আলোচনায় সরাসরি অংশ নিয়েছেন তিনি। তার পর থেকে তিনি প্রায়শই বাগদাদ যাতায়াত করতেন, গত মাসেই নয়া সরকার গঠনের ব্যাপারে বিভিন্ন দল তাকে চাইলে ফের তিনি বাগদাদ যান।
সাম্প্রতিক কয়েক বছরে ইনস্টাগ্রামে সোলাইমানির ফলোয়ারের সংখ্যা প্রচুর বেড়ে যায়। ২০১৩ সালে সিরিয়ান যুদ্ধে ইরানের ভূমিকাগ্রহণের সময়ে তিনি পাবলিক ফেস হয়ে ওঠেন। তার ইনস্টাগ্রামে যুদ্ধের ফোটো, তথ্যচিত্র ও মিউজিক ভিডিও ও অ্যানিমেটেড ফিল্মও রয়েছে।
সংবাদসংস্থা এএফপি জানিয়েছে, ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে গত অক্টোবর মাসে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ২০০৬ সালে ইসরাইল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধের সময়ে তিনি গোটা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য লেবাননে গিয়েছিলেন।
২০১৮ সালে ইরানপোল ও মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সার্ভেতে তিনি ৮৩ শতাংশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন, হারিয়ে দেন প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহম্মদ জাভেদ জারিফকে। লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ফিলিস্তিনের হামাসসহ যেসব ইসলামপন্থী গ্রুপের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক রয়েছে, তাদের কেন্দ্রীয় ভূমিকায় সোলাইমানিকে দেখতে পাচ্ছিল পশ্চিমি রাষ্ট্রগুলো।
ইরানে যেসব ইস্যুতে তিক্ত সামাজিক বিভাজন ঘটেছে, সেগুলোর মধ্যে সেতুবন্ধন ঘটানোর জন্য প্রয়াসী ছিলেন তিনি। এর মধ্যে কঠোর হিজাব পরিধান নীতি অন্যতম। ২০১৭ সালে বিশ্ব মসজিদ দিবসের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, আমরা যদি ক্রমাগত খারাপ হিজাব আর ভালো হিজাব বলতে থাকি, সে সংস্কারপন্থী হোক বা রক্ষণশীল… তাহলে কে বাদ থাকবে! সকলেই তো মানুষ। ঈমানদাদের সবার সন্তানেরাই ধার্মিক! সকলেই কি সমান? না, কিন্তু পিতা সকলকেই আবাহন করেন।
১৯৫৭ সালের ১১ মার্চ কেরমান প্রদেশের পার্বত্য গ্রামে জন্ম নেন সোলাইমানি। এ এলাকা ইরানের উত্তরপূর্বে অবস্থিত, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান সীমান্তের কাছেই। মার্কিনরা বলেছে, তার জন্ম ইরানের ধর্মীয় রাজধানী কোমে।
সোলাইমানির শৈশব সম্পর্কে বিশদে কিছু জানা যায় না, যদিও ইরানের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, সোলাইমানির বাবা ছিলেন কৃষক। তিনি শাহ মোহাম্মদ রেজা পহ্লবির কাছ থেকে এক খণ্ড জমি পেলেও পরে দেনার দায়ে জড়িয়ে পড়েন।
১৩ বছর বয়সে সোলাইমানি নির্মাণকাজে যুক্ত হন, এর পর কেরমান ওয়াটার অর্গানাইজেশনে চাকরি পান। ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লব শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে। রেভুলিউশনারি গার্ড যখন তৈরি হচ্ছিল, তখন সোলাইমানি তাতে যোগ দেন। ইরানের উত্তর-পশ্চিমে বিপ্লবের পর কুর্দিশ বিদ্রোহ মাথা তুলেছিল যেখানে, সোলামানের বাহিনীকে সেখানে পাঠানো হয়। এর পরেই ইরানে আক্রমণ করে ইরাক। দু দেশের মধ্যে ৮ বছর ধরে দীর্ঘ, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে ১০ লাখ মানুষ মারা যান। ইরান যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠায় কিশোর বয়সীদেরও। সোলাইমানির ইউনিট ইরাকি রাসায়নিক অস্ত্রের আক্রমণের মুখেও পড়েছিল।
সূত্র : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস