আমলার সততা!
আমলার সততা! - ছবি : সংগ্রহ
আভিধানিক অর্থে ‘আমলা’ বলতে সরকারি অফিসের করণিক এবং সরকারি কর্মকর্তাকে বুঝায়। সরকারি অফিসের করণিক ও সরকারি কর্মকর্তা উভয়কে আইনের ভাষায় বলা হয়, গণকর্মচারী। কিন্তু সাধারণ অর্থে আমরা ‘আমলা’ বলতে বুঝি সামরিক বা বেসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, বিচারিক পদে আসীন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও সাংবিধানিক পদধারী ব্যক্তি এবং সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, মহাপরিচালক, পরিচালক প্রমুখকে।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত আমলাদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন ও কার্যকর হওয়ার কারণে তারা সব সরকারের আমলেই ক্ষমতাধর হয়ে থাকেন। এ ছাড়া আমলারা মাঠপর্যায়ের সরকারি কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে থাকেন এবং সরকারের বিভিন্ন পদে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে সরকারের পরিবর্তন হলেও আমলাদের ক্ষেত্রে এক মন্ত্রণালয় থেকে অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি অথবা কিছু সময়ের জন্য বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হওয়া ব্যতীত খুব একটা পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না।
আমলারা বিভিন্ন সময় সরকারি ও বেসরকারি সফরে বিভিন্ন জেলায় গিয়ে থাকেন। জেলা সফরের সময় সচরাচর আমলাদের জন্য সার্কিট হাউজ বা রেস্ট হাউজে আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়। অনেক সময় তাদের সফরসঙ্গী হিসেবে স্ত্রী-পুত্র, কন্যা-জামাতা ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধব অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকেন। অল্প কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ব্যতীত আমলাদের জেলা শহর সফরের সময় দেখা যায়, তাদের জন্য ব্যাপক আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। আপ্যায়নের মধ্যে দুপুর বা রাতের খাবারে পোলাও বা চিকন চালের ভাত, মুরগির রোস্ট বা রেজালা, রুই মাছ ভাজি বা দোপেঁয়াজা প্রভৃতির পাশাপাশি অন্তর্ভুক্ত থাকে সফররত জেলার ঐতিহ্যবাহী খাবার। যেমন- কক্সবাজারের ক্ষেত্রে রূপচাঁদা ও চিংড়ি মাছ; চাঁদপুর ও বরিশালের ক্ষেত্রে ইলিশ ও পাঙ্গাশ; সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জে কৈ, মাগুর ও পাবদা মাছ, প্রভৃতি। এ ছাড়া সকাল-বিকালের নাশতা পরিবেশনের সময় স্বাভাবিক খাদ্যতালিকার বাইরে জেলার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন সামগ্রী ও ফলমূল থাকে অন্তর্ভুক্ত। দেশীয় ফলমূলের পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় অনেক সময় দেখা যায়, দেয়া হয় উন্নতমানের আপেল ও আঙ্গুর।
একজন আমলা তার পুত্র-কন্যা-জামাতা বা আত্মীয়স্বজনসমেত অথবা একাকী কোনো জেলায় যখন সরকারি বা বেসরকারি সফরে যান, তখন দেখা যায় মাঠপর্যায়ের অধীনস্থ কর্মকর্তারা চাকরির দ্রুত পদোন্নতি, আকর্ষণীয় ও লোভনীয় পোস্টিং, বিদেশ সফরে অন্তর্ভুক্তি প্রভৃতি চরিতার্থ করার মানসে তাদের তুষ্ট করার জন্য সর্বতোভাবে সচেষ্ট থাকেন।
একজন আমলা যখন স্ত্রী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে জেলা সফরে যান, তখন দেখা যায় তার স্ত্রী জেলাপর্যায়ের অধীনস্থ কর্মকর্তাদের কাছে ওই জেলার ঐতিহ্যবাহী পণ্য ও বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রীর বাজারদর সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছেন। এই ক্ষেত্রে আমলার স্ত্রীর অন্তর্নিহিত কী উদ্দেশ্য, তা বুঝতে সাধারণ বুদ্ধিজ্ঞানসম্পন্ন একজন অধস্তন কর্মকর্তার খুব একটা অসুবিধা হয় না। তাই দেখা যায়, সফর শেষে আমলার বিদায়ের প্রাক্কালে বিভিন্ন ধরনের দ্রব্যসামগ্রী তার ব্যক্তিগত মালামালের পাশে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য ঠাঁই পায়।
সচরাচর দেখা যায়, একজন আমলা জেলায় মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থার অনুষ্ঠানে প্রধান বা বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে থাকেন। এ ধরনের আমন্ত্রণ সরকারি কার্যক্রমের অংশ বিধায়, সরকারি সফর হিসেবে ভ্রমণ সংশ্লেষে ওই জেলায় অবস্থানসংক্রান্ত সম্পূর্ণ ব্যয়ভার সরকারি নিয়ম অনুযায়ী সফর শেষে বিলের মাধ্যমে আমলারা তুলে থাকেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, আমলার করিতকর্মা ব্যক্তিগত সচিব বা ব্যক্তিগত সহকারীর ‘দক্ষতা’র কারণে বিমান, রেল বা স্টিমারে ভ্রমণের ক্ষেত্রে ভ্রমণের টিকিটের ব্যবস্থা করছে আয়োজক সংস্থা। ভ্রমণ সড়কপথে হয়ে থাকলে গাড়ির তেলের ব্যবস্থা করছে মাঠপর্যায়ের অধীনস্থ সংস্থা। এভাবে দেখা যায়, একজন আমলা সরকারি সফরে জেলায় গেলে তিনি সরকার থেকে ভ্রমণ ভাতা ও দৈনন্দিন ভাতা হিসেবে যে অর্থ পান, তা সম্পূর্ণ সাশ্রয় হয়ে ‘অত্যন্ত সুন্দরভাবে’ তার সঞ্চিত অর্থকে স্ফীত করে।
প্রায়ই দেখা যায়, একজন আমলা তার ভাই-বোন, ভাতিজা-ভাতিজি, ভাগিনা-ভাগ্নি অথবা কোনো নিকটাত্মীয় বা বন্ধুবান্ধবের কোনো পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদানের উদ্দেশে রাজধানী ত্যাগ করে কোনো জেলা শহরে গিয়ে থাকেন। কিন্তু তিনি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, তার এ আগমন জেলা শহরে সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত সবাই যেন ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারে, সে বিবেচনায় এটিকে সরকারি সফরে রূপান্তর করা হয়। এর দ্বারা ‘রথ দেখা ও কলা বেচা’র মতো আমলার সরকারি সফর ও পারিবারিক অনুষ্ঠানে উপস্থিতি- দু’টিই রাষ্ট্রীয় খরচে ‘সার্থকভাবে’ সম্পন্ন হওয়ার অনেক কাহিনী রয়েছে। এ ছাড়া আমলার বেসরকারি সফরের সময় তার জন্য গাড়ি ও তেল সরবরাহ করতে জেলাপর্যায়ের কর্মকর্তাদের অনেক ধরনের অন্যায়ের আশ্রয় নিতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
আমরা চিরকাল শুনে এসেছি- মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও জ্যেষ্ঠতা কোনো সরকারি চাকুরের পদোন্নতির মাপকাঠি। কিন্তু মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে সেটি আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন পদোন্নতি ও ভালো পদায়নের মাপকাঠি যেন আমলা, তার স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজনের বন্দনা ও সেবা শুশ্রƒষা। আমলারা বিশেষ ক্ষমতাধর ও সুবিধাভোগী হওয়ায় তাদের বিবেচনায়, যেকোনো অনুষ্ঠানে তাদের উপস্থিতি অনুষ্ঠানের মর্যাদাকে বাড়িয়ে দেয়। অনেক আমলাই আকাক্সক্ষা পোষণ করে থাকেন যাতে মাসের বেশির ভাগ দিন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোনো অনুষ্ঠানের সংশ্লেষে বাসার বাইরে তার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এ ধরনের আমলা একই দিনে একাধিক সামাজিক বা পারিবারিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে থাকলে দেখা যায়, আমলার অনুরোধে সামাজিক বা পারিবারিক অনুষ্ঠানের তারিখ পরিবর্তন করা হয়। সচরাচর দেখা যায়, পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার সময় আমন্ত্রিত অতিথি উপঢৌকন, মিষ্টান্ন, ফলমূল বা ফুল নিয়ে উপস্থিত হয়ে আয়োজকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। কিন্তু অনেক আমলা মনে করেন, তার উপস্থিতিতেই অনুষ্ঠানটি আলোকিত; সুতরাং উপঢৌকন, মিষ্টান্ন, ফলমূল বা ফুল নেয়া দরকার কী?
বাংলাদেশের যেসব জেলা পর্যটনের দৃষ্টিকোণ থেকে আকর্ষণীয়, সবসময় ওইসব জেলায় ভ্রমণে যেতে আমলা, তার পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবরা আগ্রহী হয়ে থাকেন। জেলাপর্যায়ে কর্মরত বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তাদের প্রায়ই আমলার পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের ভ্রমণসংক্রান্ত সামগ্রিক ব্যবস্থা সম্পন্ন করতে হয়। এর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সার্কিট হাউজ বা রেস্ট হাইজে ভ্রমণকালীন সময়ের জন্য থাকার ব্যবস্থা, ভ্রমণকালীন সময়ের জন্য আহারের ব্যবস্থা, এ সময়ে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা এবং ভ্রমণ শেষে নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তনের সময় বিভিন্ন উপঢৌকন, দ্রব্যসামগ্রী দেয়ার ব্যবস্থা। এ ধরনের কোনো কোনো ভ্রমণে সদস্য থাকে দুই থেকে ছয়জনের মধ্যে, কোনো কোনটিতে সাত থেকে ১২ জন; আবার কোনো কোনোটিতে ১৩ থেকে ২০ জন। জেলাপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বলতে শোনা যায়, মাসে এ ধরনের একটি ভ্রমণ হয়ে থাকলে তাদের ভ্রমণের ব্যাপ্তি বিবেচনায় পাঁচ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়। একাধিক ভ্রমণ হয়ে থাকলে ব্যয়ের পরিমাণ আনুপাতিক হারে বাড়তে থাকে।
আমলাদের স্ত্রীরা অনেক সময় দেখা যায়, স্বামীর ক্ষমতার প্রভাব দেখানোর জন্য বান্ধবীদের নিয়ে বিভিন্ন জেলায় ভ্রমণে যান। স্বাভাবিকভাবেই জেলায় কর্মরত কর্মকর্তারা ভ্রমণকে সার্থক ও পরিপূর্ণ করার জন্য তাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেন না। জেলাপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ধারণা, আমলার স্ত্রী সন্তুষ্ট হলে স্ত্রীর মাধ্যমে তিনি তার আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে সক্ষম হবেন। অপর দিকে, আমলার স্ত্রীরা বান্ধবীদের নিয়ে ভ্রমণে গিয়ে বিশেষ মর্যাদা ও সযোগ-সুবিধা পাওয়ায় তার স্বামী যে প্রকৃতই প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান, এটি বান্ধবীরা উপলব্ধি করতে পারায় পুলকিত বোধ করেন। আমলার জেলা ভ্রমণের শেষে যখন বিদায়ের পালা, তখন দেখা যায় সার্কিট হাউজ বা রেস্ট হাউজের বিল পরিশোধের জন্য আমলা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
জেলাপর্যায়ের কর্মকর্তা ভাবেন, আমলার সফরকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য যেখানে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা খরচ পরিশোধ কিভাবে হবে, এ ব্যাপারে আমলার কোনো মাথাব্যথা নেই তখন সার্কিট হাউজ বা রেস্ট হাউজে অবস্থানের বিল বাবদ ১০০ টাকা কি না নিলেই নয়। কিন্তু আমলার নিজ বিবেচনায়, একজন সৎ কর্মচারী সার্কিট হাউজ বা রেস্ট হাউজের ১০০ টাকা বিল পরিশোধ না করলে তার সততা ভূলষ্ঠিত হবে। অগত্যা জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাকে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা ব্যয়ের বিপরীতে ওই ১০০ টাকা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। অনেক আমলার স্ত্রীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, আমলার মতোই সফরসংক্রান্ত আনুষঙ্গিক সব ব্যয়ের ক্ষেত্রে নিরুদ্বেগ। কিন্তু সার্কিট হাউজ বা রেস্ট হাউজের বিল পরিশোধ না করলে আমলার সততা প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং আমলা তার সাথে রাগারাগি করবেন- এ অজুহাতে অনেকটা বাধ্য হয়েই জেলাপর্যায়ের অধস্তন কর্মকর্তাকে বিশাল অঙ্কের ব্যয়ের বিপরীতে সামান্য ১০০ টাকার কাছাকাছি কোনো অঙ্কের টাকা গ্রহণ করতে হয়। এত কিছুর পরও আমলা নিজ বিবেচনায় সৎ এবং অসততার কোনো কালিমাই তাকে ‘স্পর্শ করতে পারেনি।’ অপর দিকে, আমলার স্ত্রী গর্ব করে বান্ধবীদের বলেন, ‘সততায় তার স্বামীর কোনো জুড়ি নেই।’
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com