এক জেনারেল ও যুক্তরাষ্ট্রের মরণ কামড়
সোলাইমানি ও ট্রাম্প - ছবি : সংগ্রহ
সারা বিশ্বে আলোচিত এক সামরিক চরিত্র ছিলেন ৬২ বছর বয়সী ইরানের জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। তিনি ছিলেন দেশটির দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তাকে তার কাজের জন্য শুধু ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়তুল্লাহ আলি খামেনির কাছে জবাবদিহি করতে হতো। ‘হাজী কাসেম’ নামে পরিচিত এই জেনারেল তার ব্যতিক্রমী সমর-কৌশলের জন্য দ্রুত পরিচিতি পেয়েছেন। আফগানিস্তান থেকে লেবানন পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে তার সামরিক কর্মকৌশল ছিল প্রায় অপ্রতিরোধ্য। তিনি বিভিন্ন ময়দানে সম্মুখসমরে যুদ্ধরত যোদ্ধাদের সাথে সরাসরি কথা বলতেন। কখনো তাদের সহযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধও করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশে তাকে মার্কিন ড্রোন হামলায় বাগদাদের বিমানবন্দরে ৩ জানুয়ারি হত্যা করা হয়েছে। তার হত্যার পর বিশ্বজুড়ে যে প্রতিক্রিয়া প্রত্যক্ষ করা গেল, নিকট অতীতে কোনো সামরিক কমান্ডারের মৃত্যুর পর এমনটি আর দেখেনি বিশ্ববাসী। শিয়া-সুন্নির বিভাজন দূরে ঠেলে তাই দেশে দেশে নির্যাতিতদের কাছে সোলাইমানি এক ‘প্রতিরোধ জনযোদ্ধা’য় পরিণত হয়েছেন। সাম্প্রতিক এক হিসাবে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে দুই কোটি ৭০ লাখ মুসলমান নিহত হয়েছেন। সেই তালিকায় সোলাইমানির নামও যুক্ত হলো। সন্দেহ নেই, তার হত্যাকাণ্ড ইরানের জন্য বড় ধাক্কা। কিন্তু অপূরণীয় ক্ষতি নয়।
পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক দুর্ধর্ষ সেনাপতি ছিলেন ইরানের সরদার কাসেম সোলাইমানি। সাম্প্রতিক সময়ে চীন, রাশিয়া, তুরস্ক, ইরাক, কাতার ইরানের সাথে অক্ষশক্তি হিসেবে কাছাকাছি হয়েছে। সোলাইমানির সামরিক নেতৃত্বের এটি বড় একটি অবদান। তার কৌশলের কাছে কেবল আইএস ইরাক ও সিরিয়াতে গুঁড়িয়ে যায়নি, ওই দেশ দুটি বর্তমানে ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র। লেবাননের হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের হামাস ও ইসলামী জিহাদকে তিনি ইরানের বলয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। ইয়েমেনে তার কৌশলেই সৌদি-মার্কিন জোট বিদ্রোহী হুতিদের সাথে পেরে উঠছিল না। সুতরাং আন্তঃদেশীয় লড়াইয়ের এক সেনাপতির মর্যাদায় আসীন হন তিনি; তাকে মুসলিম বীর গাজী সালাহুদ্দীনের সাথে অনেকে তুলনা করছেন। এই বিজয়ের জোরেই ইরান অভ্যন্তরীণ বিবাদ ও অর্থনৈতিক সঙ্কটজাত গণবিক্ষোভ সামলাতে পারছে, মোকাবেলা করতে পারছে মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি প্রধান পাঁচটি হুমকির মধ্যে একজন ছিলেন কাসেম সোলাইমানি।
প্রভাবশালী এই সামরিক কর্মকর্তার খুনের ঘটনা এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। বিশ্বগণমাধ্যম সোলাইমানির হত্যাযজ্ঞকে খুন হিসেবেই বর্ণনা করেছে। তার মৃত্যুর পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম নানা আঙ্গিকে সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের বিশ্লেষণে ব্যতিব্যস্ত। এসব আলোচনায় সবার আগে চলে এসেছে ইরান তার এই বীরের খুনের প্রতিশোধ কিভাবে নেবে। আর কী কারণে যুক্তরাষ্ট্র এই মুহূর্তে সোলাইমানিকে খুন করার ঝুঁকি নিলো? সোলাইমানিকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র এক ধরনের জুয়াখেলায় নেমেছে।
তাকে হত্যার পেছনে মার্কিন প্রশাসনে ইসরাইল-সৌদি লবি কাজ করেছে বলে অনেকের ধারণা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এই মুহূর্তে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কোণঠাসা। এটা থেকে উত্তরণে উভয়ে সোলাইমানির হত্যার ঘটনাকে নিজ নিজ দেশে কাজে লাগাতে চাচ্ছেন। এটি হলো এক দিক। অন্য দিকটি হলো, দীর্ঘ দিন ধরে ইরানকে যুদ্ধে জড়ানোর চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরাইল। জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যা করা সেই চেষ্টারই অংশ। ইরান যুদ্ধে জড়ালে তেহরানের ‘মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে’ যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে চায়। একই সাথে ইসরাইলসহ মিত্রদের নিরাপদ করার দায়ও রয়েছে ওয়াশিংটনের কাঁধে। এ কারণেই সোলাইমানিকে হত্যা করা হয়েছে বলা চলে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের প্রাধান্য বিস্তারে প্রতিবন্ধক ছিল সোলাইমানির চৌকশ সমরকৌশল।
ইরান নিয়ে যাদের জানাশোনা রয়েছে তাদের অভিমত, পারস্য বা ইরান দুনিয়ার প্রাচীন সভ্যতাগুলোর অন্যতম পাদপীঠ। ইরানিরা তার ধারক-বাহক। তাদের ইতিহাস বর্ণাঢ্য ও ঘটনাবহুল। এটি সবার জানা, ইরানিরা মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করতে অভ্যস্ত। তাদের উত্তেজিত করে ফাঁদে ফেলা সহজ নয়। ইরানি জাতি প্রতিটি কদম ফেলে ভেবে-চিন্তে। যাবতীয় পদক্ষেপ নেয় সুচিন্তিতভাবে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের ফাঁদে তেহরান পা দেবে, এমন মনে হয় না।
ইরানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এই উসকানি অনেক দিনের। ১৯৮৮ সালেও ইরানের যাত্রীবাহী বিমানে হামলা চালিয়ে ২৯০ জনকে হত্যা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ইরান সেবারও ফাঁদে পা দেয়নি। তদুপরি এ কথাও ঠিক, ইরান সমকালে তার এক বীর যোদ্ধার নির্মম হত্যা এমনিতেই ছেড়ে দেবে, প্রতিশোধ নেবে না; এটি মনে করার কোনো কারণ নেই।
ইরানিরা বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন জাতি। তেহরানের নিজের সম্পর্কে মূল্যায়ন স্বপ্নবিলাসী নয়। বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে পথ চলতেই বর্তমান ইরান অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ১৯৭৯ সালে ক্ষমতায় আসা বিপ্লবী সরকারের বৈশিষ্ট্যই এটি। স্বৈরশাসক রেজা শাহ পাহলবিকে বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুতির পর ‘ইসলামী শাসনব্যবস্থা’ প্রবর্তনের প্রথম থেকেই ইরানকে শায়েস্তা করতে ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি উঠেপড়ে লাগে। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৮০ সালে শাতিল আরব নিয়ে ইরান-ইরাক দ্বন্দ্ব রূপ নেয় ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে। মার্কিন মদদে ইরাকি শাসক সাদ্দাম হোসেন ইরানের ওপর অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দেন। দীর্ঘ প্রায় এক দশক পর ওই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৮৮ সালে। মূলত তা ছিল মধ্যপ্রাচ্যে পাশ্চাত্যের ছায়াযুদ্ধ। অন্য দিকে, ইরানের বিপ্লবী সরকারকে সৌদি রাজপরিবার সব সময়ই দেখছে নিজেদের প্রতি বড় হুমকি হিসেবে। তাই তারা সব সময় ইরানের বিপ্লবী সরকারের পতন কামনা করে আসছে। এখন সেই চাওয়া তীব্রতর হয়েছে। দুঃখজনক হলো, দেশটি মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাববলয় রুখতে ইসরাইলের সাথেও আঁতাত করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। যা নিকট অতীতে ছিল পর্দার আড়ালে, এখন তা রাখঢাকহীনভাবে প্রকাশ্যে।
যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ইরান যেহেতু সমরাস্ত্রে এবং অর্থনীতিতে দুর্বল, তাই তেহরান কোনো অবস্থাতেই এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে চায় না। তবে সোলাইমানি হত্যার প্রতিশোধ নিতে মধ্যপ্রাচ্যে ছায়াযুদ্ধের আরো বিস্তৃতি ঘটাবে তা অনেকটাই নিশ্চিত। এ ক্ষেত্রে ইয়েমেনে হুতিদের দিয়ে সৌদি আরবে হামলার মাত্রা বাড়াতে পারে। ইসরাইলি অবস্থানে মিত্রদের দিয়ে হামলা করাতে হয়তো কসুর করবে না। এদিকে ইরাকে নিজেদের সমর্থিত সরকার থাকা সত্ত্বেও দেশটির পার্লামেন্টে মার্কিন সৈন্য না রাখার বিল পাস করা হয়েছে। এতে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্রদের প্রভাববলয় সঙ্কুচিত হতে পারে। ইরান তাই যুদ্ধ ঘোষণা না করেও আঞ্চলিক গেরিলা প্রতিরোধে সফল হতে পারে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাবেদ জারিফের ভাষায়, প্রতিরোধের বৃক্ষ আরো শাখা ছড়াবে। ইরাক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ঘণ্টা, সিরিয়ায় বাসার আল আসাদের টিকে যাওয়া, ইয়েমেনে সৌদিদের মার খাওয়া এবং বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ সয়েও ইরানে ক্ষমতাসীনদের টিকে যাওয়াই বাস্তবতা। যুদ্ধে যে মার খেয়েও শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে, তাকে পরাজিত বলা যায় না। আরো মৃত্যু ও ধ্বংসের পরেও ইরানের টিকে থাকা মানে যুক্তরাষ্ট্রের পিছু হটা।
যুক্তরাষ্ট্রের শুরু করা ‘সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই’ নিজেই এখন সন্ত্রাসী রূপ নিয়েছে। আল কায়েদা এবং আইএসকে হটিয়ে নিজে যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসীদের খাতায় নাম লিখিয়েছে। জেনারেল সোলাইমানি ছিলেন সেই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে প্রতিরোধ লড়াইয়ের অগ্রসেনানী। প্রতিরোধ যুদ্ধের অন্যতম বড় বৈশিষ্ট্য- নেতৃত্বের আসন কখনো শূন্য থাকে না। তাই সোলাইমানির অনুপস্থিতি মার্কিনবিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধকে খুব বেশি দুর্বল করবে বলে মনে হয় না, ক্ষেত্রবিশেষে আরো শক্তি জোগাবে। সোলাইমানির মৃত্যুতে মনে হতে পারে ‘ইরানের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে’। আসলে সুবিধা না করতে পেরে যুক্তরাষ্ট্র মরণ কামড় দেয়ার চেষ্টা করছে। ইরান ও তার মিত্রদের ওপর এ ধরনের আরো হামলা ও হত্যা হতে পারে। পশ্চিমা শক্তির নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে দেখানোর চেষ্টা করছে, যুদ্ধ লাগতে আর কত দেরি। কিন্তু এর বিপরীতে ইরানের প্রতিক্রিয়া কৌশলী ও সংযত। কিছুটা হুমকি-ধমকির সাথে প্রথাগত কূটনৈতিক বক্তব্য দিয়ে ইরান প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এটি ইরানের বিচক্ষণতা, এ কথা স্বীকার করতেই হয়। ইরানকে যুদ্ধে জড়ানোর মার্কিন প্রচেষ্টা এবারো অপূর্ণ থেকে যাবে বলে মনে করা যায়।
E-mail : camirhamza@yahoo.com