মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে মোদির পররাষ্ট্রনীতি
নরেন্দ্র মোদি - ছবি : সংগৃহীত
নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে ভারতের পররাষ্ট্র সম্পর্কের দিকে বেশ নজর দিয়েছেন। যদিও তিনি কতটুকু অর্জন করতে পেরেছেন তা নিয়ে দ্ব্যর্থবোধকতা আছে, কিন্তু তিনি যে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে অনেক শক্তি ব্যয় করেছেন, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশই নেই।
গত গ্রীস্মে তার পুনঃনির্বাচনের পর থেকে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির চ্যালেঞ্জগুলো বাড়ছেই। কেন এমনটা হয়েছে তা নিয়ে ভিন্নতা থাকলেও এর আংশিক কারণ যে বিজেপির নিজের ভুল, তা নিশ্চিত।
প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার কৌশলগত কাছে যাওয়ার জন্য মোদি বেশ চেষ্টা করেছিলেন। কোয়াড পুনর্জীবন ছিল ভারতের বর্তমানের কূটনৈতিক বিচক্ষণতার বিরাট সূচক। কিছু বিপর্যয় থাকলেও ভারত মহাসাগরের দুই গুরুত্বপূর্ণ দেশ শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপে নিজের অবস্থান সুসংহত করতে পেরেছে ভারত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অ্যাক্ট ইস্ট নীতির মাধ্যমে কার্যকর কিছু করার জন্যও কৃতিত্ব পেতে পারেন মোদি।
কিন্তু ক্রমবর্ধমান জটিলতাও আছে। ভারতের সবচেয়ে গুরুতর চ্যালেঞ্জ চীনকে ব্যবস্থাপনা করার কাজে কিছুটা সাফল্য এলেও তা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবেই রয়ে গেছে। কোয়াডে ভারতের আরো সক্রিয় ভূমিকা আরেকটি ইতিবাচক দিক। কোয়াডকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী পর্যায়ে উন্নীত করার ফলে কোয়াডের চার দেশের মধ্যেই এই ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে চীন সত্যিই একটি সমস্যা এবং সেজন্য কৌশলগত সমন্বয়ের মাধ্যমে চার দেশকে কাজ করতে হবে।
কিন্তু চীন সমস্যা ব্যবস্থাপনা করার ক্ষেত্রে ভারতের কঠিন সামর্থ্যে কিছু মারাত্মক সমস্যাও রয়ে গেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল ভি পি মালিক কার্গিল যুদ্ধের সময় বলেছিলেন যে আমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে আমরা যুদ্ধ করব, কিন্তু চীনের অনেক বড় ও শক্তিশালী বাহিনীর মোকাবিলা করার সময় এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি হবে ভারতের জন্য বিপজ্জনক।
জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে কথার ফুলঝুড়ি ফোটানো হলেও মোদি সরকারের প্রতিরক্ষা বাজেট বরাদ্দ ভয়াবহ খারাপ। বছরের পর বছর ধরে এই খাতে বরাদ্দ হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমানে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের আগেরকার সময়ের পর থেকে এখনই বরাদ্দ সর্বনিম্ন।
আবার বরাদ্দের মধ্যেও একটি বড় অংশ ব্যয় হয় বেতন ও পেনশন বাবদ। এর ফলে ক্যাপিটাল এক্সেন্ডেচার থাকে খুবই কম। ফলে ক্রয়ের ইস্যুগুলো অমীমাংসিতই থাকে। তিন বাহিনীর প্রতিটিতেই বিপুল ব্যবধান রয়েছে এবং তা চীনের বিরুদ্ধে সফলভাবে আত্মরক্ষায় ভারতের সামর্থ্যকে পরীক্ষা করতে যাচ্ছে। ভারত সম্ভবত কূটনীতির মাধ্যমে চীনের সাথে মোকাবিলা করতে চায়,কিন্তু কেবল একটি হাতিয়ারের ওপর নির্ভর করাটা বিপজ্জনক হতে পারে।
আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রতিবেশীদের নিয়ে। আর ভারতের অভ্যন্তরীণ ঘটনাপ্রবাহের কারণে এখানকার সমস্যাগুলো জটিল হচ্ছে। বর্তমানে ভারতের প্রতিবেশীত্ব নীতি মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ও দেশব্যাপী প্রস্তাবিত জাতীয় নাগরিকপুঞ্জির (এনআরসি) কারণে। এ দুটি ব্যবস্থা বিশেষ করে আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সিএএ তিন ইসলামি প্রতিবেশী- আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে টার্গেট করায় ভারতের তিন প্রতিবেশীর কূটনীতিতে নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কে ব্যাপক উন্নতি হলেও সিএএ ও এনআরসি বাংলাদেশ সরকারকে কঠিন অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। আরেক বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী আফগানিস্তানও এতে আক্রান্ত হয়েছে। অধিকন্তু সিএএ মুসলিমদের টার্গেট করায় বিশ্বজুড়েই প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি ভারতের অংশীদারেরা পর্যন্ত ভারতের বহুসংস্কৃতি, বহুত্ববাদী সমাজের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ নিয়ে ভারতের ভাবমূর্তিতে মারাত্মক আঘাত হেনেছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করও এগুলো ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে বৈশ্বিক উদ্বেগ অগ্রাহ্য করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই যে এতে ভারতের নৈতিক মান নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে জয়শঙ্করকে নিয়োগ দিয়ে দুর্দান্ত কাজ করেছিলেন মোদি। সাবেক পররাষ্ট্রসচিব জয়শঙ্কর বিশ্বজুড়ে শ্রদ্ধাভাজন হওয়ার কারণে মোদির প্রথম মেয়াদের পররাষ্ট্রনীতিতে সাফল্য পেতে সহায়ক হয়েছিল। কিন্তু বাজে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতির অবসান জয়শঙ্করের মতো অভিজ্ঞ টেকনোক্র্যাট করতে পারেন কিনা তা অস্পষ্ট। তিনি কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার পর বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ প্রশমিত করতে সফল হয়েছিলেন।
কিন্তু, সিএএ নিয়ে সাফল্য আসেনি। বিশেষ করে ইউএস হাউস ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির সাথে জয়শঙ্করের বৈঠক বাতিল করায়। কারণ ওই কমিটিতে মিজ প্রামিলা জয়পালও ছিলেন। জয়পাল কাশ্মিরে যতটা সম্ভব দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে বলেছিলেন। ভারত এখনো আগের মতো যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ভোগ করে কিনা তা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
আবার ভারত-জাপান সম্পর্কও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিনা তাও অস্পষ্ট। গত ডিসেম্বরে গৌহাটিতে দুই দেশের মধ্যে যে দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠক হওয়ার কথা ছিল তা সিএএবিরোধী বিক্ষোভের কারণে স্থগিত হয়ে গেছে। প্রায় এক দশকের মধ্যে এই প্রথম এ ধরনের শীর্ষ বৈঠক হতে পারল না।
ভারতের গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতা ভারতের অংশীদারিত্বে অন্তত সহায়ক ভূমিকা পালন করে, এবং এমনকি অনিশ্চয়তাও এসব সম্পর্ককে প্রভাবিত করতে পারে। অতীতেও ভারত নানা বৈদেশিক সমস্যায় পড়েছে, তবে খুব কমই অভ্যন্তরীণ কারণে সেগুলোর সৃষ্টি হয়েছিল। এসব নতুন চ্যালেঞ্জ সামাল দেয়াটা ভারত সরকার যতটা মনে করছে, তার চেয়ে কঠিন হতে পারে।
দি ডিপ্লোম্যাট