মেকিভাবে কমানো হলো ব্যাংকের খেলাপি ঋণ
মেকিভাবে কমানো হলো ব্যাংকের খেলাপি ঋণ - ছবি : সংগ্রহ
বিকল্প মেকি উপায়ে কমানো হলো খেলাপি ঋণ। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ কমেছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে যেখানে ছিল এক লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে এসে তা কমে নেমেছে প্রায় ৯৫ হাজার কোটি টাকায়। তবে এ হিসাব একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ের। চূড়ান্ত হিসাবের জন্য আরো মাসখানেক অপেক্ষা করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
জানা গেছে, বিদায়ী বছরের জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেয়ার পরই অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল ঘোষণা করেছিলেন খেলাপি ঋণ আর এক টাকাও বাড়বে না। যখন তিনি এ ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখন (ডিসেম্বর প্রান্তিকে ) ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার কোটি টাকা। তখন অনেকেই নানা সমালোচনা করেছিলেন যে বড় বড় ব্যবসায়ীদের একটি অংশ ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না। এতে পাগলা ঘোড়ার মতো খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এমনি পরিস্থিতিতে অর্থমন্ত্রী এমন কী যাদুর কাঠি এনেছেন যে যার স্পর্শে খেলাপি ঋণ এক টাকাও বাড়বে না। কিন্তু খেলাপি ঋণ ঠিকই কমেছে তবে বিশেষ ব্যবস্থায় ঋণ নবায়নের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। তারই সুবাদে খেলাপি ঋণের পাগলা ঘোড়ার লাগাম টানা গেছে। এতে ব্যাংকগুলোর আয়েও ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে খেলাপি ঋণের সর্বশেষ তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ওই দিনই তথ্য দেয়া হয়। এর ফলে বছরের শেষ সময়ে খেলাপি ঋণ কমার সফলতা অর্থমন্ত্রীকে নতুন বছরে স্বস্তি দেবে বলে মনে করা হচ্ছে।
জানা গেছে, ডিসেম্বরের খেলাপি ঋণের তথ্য ফেব্রুয়ারিতে চূড়ান্ত হবে। চলতি মাসে ব্যাংকগুলো তাদের খেলাপি ঋণের প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক তা সমন্বয় করে ফেব্রুয়ারিতে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার কথা। তাই অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো খেলাপি ঋণের তথ্য একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ের। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে কিছু বাড়তেও পারে, আবার কমতেও পারে। তবে, ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ নবায়নের হিসাব অনেক ব্যাংকই চূড়ান্ত করতে পারেনি। ফলে ডিসেম্বরের খেলাপি ঋণ চূড়ান্ত আরো কমে যাবে বলে ব্যাংকাররা জানান।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, বছরের শুরুতেই ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের জন্য খেলাপি ঋণ নবায়নের ঘোষণা দেয়া হয়। সুদহারেও ছাড় দেয়া হয়। অর্থাৎ ৯ শতাংশ সুদে ঋণ নবায়নের অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু উচ্চ আদালতে এর ওপর কয়েক দফা রিট হওয়ায় কার্যকরের সময় পিছিয়ে যায়। গত ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের আগের মন্দমানের খেলাপি ঋণ বিশেষ এ সুবিধায় নবায়ন করা শুরু হয়। এ বিশেষ সুবিধায় ঋণ নবায়ন করতে ব্যবসায়ীদের মধ্যেও বেশ সাড়া পড়ে। বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকগুলোতে দীর্ঘ দিনের মন্দমানের খেলাপি ঋণ নবায়ন করতে বেশি আগ্রহী হন ব্যবসায়ীরা। বিশেষ সুবিধায় ঋণ নবায়ন হওয়ায় সেপ্টেম্বরের পর থেকে খেলাপি ঋণ কমতে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঋণ অবলোপন বাদে গত জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে এসে তা আরো বেড়ে হয় এক লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। কিন্তু বিশেষ সুবিধায় ব্যাপক ভিত্তিতে নবায়ন হওয়ায় খেলাপি ঋণ এখন এক লাখ কোটি টাকার নিচে নেমেছে। তবে ব্যাংকাররা জানান, অতীতেও বিকল্প উপায়ে খেলাপি ঋণ কমানো হয়েছিল। কিন্তু তার সুফল ব্যবসায়ীরা পেলেও ব্যাংকগুলো পায়নি। যেমন, ২০১৪ সালে টানা দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করার পর বর্তমান সরকারের তৎকালীন গভর্নর খেলাপি ঋণ কমানোর বিশেষ উদ্যোগ নেন। ওই বারের নির্বাচনের আগে টানা হরতাল ও অবরোধের কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন।
ব্যবসায়ীদের ক্ষতি পুষাতে খেলাপি ঋণ নবায়নের বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়। এ সময় ৫০০ ও এক হাজার কোটি টাকার ওপরের ঋণ খেলাপিদের জন্য এ ছাড় দেয়া হয়। ৫০০ কোটি টাকার ওপরে খেলাপি ঋণের ২ শতাংশ এবং এক হাজার কোটি টাকার ওপরে খেলাপি ঋণের বিপরীতে মাত্র ১ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে খেলাপি ঋণ নবায়নের সুযোগ দেয়া হয়। তখন এর নাম দেয়া হয়েছিল ‘ঋণ পুনর্গঠন’। এ ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা নিয়ে ১৪টি ব্যবসায়ী গ্রুপ ১৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করে। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের হিসাব থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা কমে যায়। কিন্তু এর কিছু দিন পরেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় আবার তা খেলাপি ঋণে পরিণত হয়। কিন্তু মাঝখান থেকে উদ্যোক্তারা এ সুবিধা নিয়ে ব্যাংক থেকে আবার নতুন করে ঋণ নেন। তেমনিভাবে এবারো নবায়নের সুফল ব্যাংকের চেয়ে ব্যবসায়ীরাই বেশি পাবেন। কারণ, এবার এক বছরের গ্রেস পিরিয়ড দিয়ে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টের বিপরীতে খেলাপি ঋণ নবায়নের সুযোগ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ এই এক বছরে ঋণখেলাপিদেরকে কিস্তি পরিশোধ করতে হবে না। কিন্তু গ্রেস পিরিয়ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর থেকে আবারো এসব ঋণ খেলাপিতে পরিণত হবে। ফলে ব্যাংক খুব লাভবান হবে না, বরং এক বছরে ঋণ আদায় কমে যাবে।