সিটি নির্বাচনের নতুন হিসাব
সিটি নির্বাচনের নতুন হিসাব - ছবি : সংগৃহীত
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে সন্দেহ সংশয় দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে বিরোধীদলগুলো ও প্রার্থীরা এ আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রার্থীদের নানাভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে। নির্বাচনে ইভিএমের মাধ্যমে ডিজিটাল কারচুপির ষড়যন্ত্র চলছে বলেও দলগুলো অভিযোগ করেছে। এ ছাড়া সরকারি দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণ বিধি ভঙ্গেরও অভিযোগ করা হয়েছে। তবে সরকারি দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মূলত নির্বাচনকে বিতর্কিত করতেই এসব অভিযোগ করা হচ্ছে।
দুই সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঢাকার রাজনীতি সরগরম হয়ে উঠেছে। সিটি নির্বাচন দলীয় পরিচয়ে হওয়ায় বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। আগামী ১০ জানুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু হবে। এর আগে নানামুখী প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছেন প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকরা। তবে বিগত নির্বাচনগুলোর পরিবেশের কারণে আসন্ন সিটি নির্বাচন নিয়েও সন্দেহ-সংশয় দানা বেঁধে উঠেছে। ২০১৫ সালে ঢাকার দুই সিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নির্বাচনে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি দুপুরের আগেই ভোট প্রত্যাখান করতে বাধ্য হয়। নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ করেন তারা। জাতীয় পার্টি, ইসলামী আন্দোলন, গণসংহতি আন্দোলনও ভোট প্রত্যাখান করে। এ বছর নির্বাচন কমিশন প্রথমে সব দল না চাইলে ইভিএম ব্যবহার করবেন না বলে জানালেও দু’দিন পরই একচেটিয়াভাবে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করার ঘোষণা দেন। এ ঘটনায় সন্দেহ আরো দানা বেঁধে উঠেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, একদিকে ভয়-ভীতি গ্রেফতার আতঙ্ক চলছে, অন্য দিকে নির্বাচনী প্রচারণা চলছে। এগুলো লোক দেখানো। এই নির্বাচন গণতন্ত্রের প্রহসন ছাড়া কিছু নয়। হই চই হবে, মিছিল হবে, নির্বাচনের দুই দিন আগে দেখবেন সব ঠাণ্ডা। তিনি আরো বলেন, এই নির্বাচনে আমরা অংশগ্রহণ করছি। কারণ আমরা জনগণের একটি রাজনৈতিক দল। আমরা মনে করি, যদি দেশের মানুষ ভোট দিতে পারে, এই সিটি নির্বাচনে ধানের শীষের প্রার্থীরা বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের পরাজিত করবে। কিন্তু সেটা তারা করতে দেবে না, এটা আমরা জানি। গণতন্ত্রের যে মৃত্যু ঘটেছে এই দেশে, এটা সরকার এই নির্বাচনের মাধ্যমে আবারো প্রমাণ করবে।
ঢাকা দক্ষিণে বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী প্রকৌশলী ইশরাক হোসেন বলেন, বিএনপির অনেক কাউন্সিলরপ্রার্থীকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দেয়া হচ্ছে। সরকারদলীয় কাউন্সিলরদের যোগসাজশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় অসাধু সদস্যের মাধ্যমে প্রার্থিতা প্রত্যাহারে নানাভাবে চাপ দেয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে গতকাল ডিএসসিসি নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা আমাদের অভিযোগ লিখিত আকারে জানিয়েছি, রিটার্নিং কর্মকর্তা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, তিনি এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন। এর আগে মনোনয়ন যাচাই-বাছাই শেষে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ের সামনে থেকে আমাদের কাউন্সিলর প্রার্থীকে গ্রেফতার করা হয়। অথচ আমরা প্রার্থীরা যখন কাগজপত্র জমা দেই, তখন প্রতিটি মামলার কথা উল্লেখ করি। তাহলে মনোনয়ন বৈধ ঘোষণা করার পর ওই প্রার্থী যখন বের হন তখন তাকে গ্রেফতার করা হলো কেন?
আসন্ন নির্বাচনে ঢাকা উত্তর সিটিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র প্রার্থী হাফেজ মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ নয়া দিগন্তকে বলেন, নানা কারসাজি, ত্রুটি, শঙ্কা ও আস্থাহীনতার পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনদের মতামত অগ্রাহ্য করে নির্বাচন কমিশন ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন- ইভিএম দ্বারা ডিজিটাল কারচুপির ষড়যন্ত্র করছে। সারা বিশ্বে ইভিএমের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ। বাংলাদেশে যে ইভিএম ব্যবহার করা হয়, তাতে নানা কারিগরি ত্রুটি রয়েছে। বায়োমেট্রিকস পদ্ধতিতে ভোটারের আঙ্গুলের ছাপ না মিললে সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা নিজের আঙ্গুলের ছাপে ২৫ শতাংশ ভোটারের ভোট দিতে পারেন। এতে ব্যাপক কারচুপির আশংকা রয়েছে। তিনি আরো বলেন, ইভিএমের বড় দুর্বলতা হলোÑ এতে ভেরিয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল না থাকায় প্রদত্ত ভোট কাগজে রেকর্ড হওয়ার ব্যবস্থা নেই। ফলে ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তা নিরীক্ষার সুযোগ নেই। ইভিএমে আস্থাহীনতার বড় কারণ হলোÑ তা আগে থেকেই এমনভাবে প্রস্তুত করা যায়, যাতে ভোটার কোনো প্রার্থীকে ভোট দিলেই তা পূর্বনির্ধারিত প্রার্থীর পক্ষে রেকর্ড হয়ে যাবে। তিনি বলেন, এত সব দুর্বলতা ও নগরবাসীসহ অংশীজনদের প্রবল আপত্তি ও আশঙ্কা সত্ত্বেও ইসির অতি উৎসাহ আমাদেরকে বিস্মিত ও অবাক করেছে।
ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মাওলানা আব্দুর রকিব বলেন, আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। রাতের বেলায় নির্বাচন, ভোট দেয় প্রশাসন। এ রকম ভোট আর জনগণ দেখতে চায় না। জনগণ একটি সুষ্ঠু ভোটগ্রহণ দেখতে চায়।
সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ঢাকা দক্ষিণের মেয়র প্রাথী হাজী মো: সাইফুদ্দিন আহম্মেদ মিলন নয়া দিগন্তকে বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নির্ভর করছে সরকারের সদিচ্ছার ওপর। এখানে ইভিএম কোনো বিষয় নয়। সরকার ইচ্ছা করলে প্রচলিত ব্যবস্থা ও ইভিএম দু’টি পদ্ধতিতেই নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে।
এ দিকে ঢাকা উত্তর সিটিতে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচারণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ করেছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল। এ ব্যাপারে গতকাল রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে দেয়া অভিযোগে তিনি বলেছেন, নির্বাচনী তফসিল অনুযায়ী আগামী ১০ জানুয়ারির আগে কোনো প্রার্থী নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারবে না। কিন্তু আতিকুল ইসলাম গতকাল ৪ জানুয়ারি সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে গুলশান-১ এর গুলশান পার্কে দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের নিয়ে নির্বাচনী মঞ্চ করে মাইক এবং সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করে নিজের পক্ষে ভোট চান এবং ভোটারদের কাছে যাওয়ার জন্য দিকনির্দেশনা দেন। যা আচরণবিধির স্পষ্ট লঙ্ঘন এবং গর্হিত অপরাধ। এ সময় অভিযোগের পক্ষে কিছু স্থিরচিত্রও জমা দেন তিনি।
তবে সিটি নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। গতকাল এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, বিএনপি সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছে, এটা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। তারা সব সময়ই নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে এবং মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির লক্ষেই নির্বাচনে অংশ নেয়। বিএনপির অভিযোগগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। তিনি আরো বলেন, বিএনপি জয়লাভ করার উদ্দেশ্যে নয়, নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই নির্বাচনে অংশ নেয়। ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভের জন্য অংশ নেয়নি। তারা নির্বাচনটিকে বিতর্কিত করতে চেয়েছিল। এখনো তারা তাই করছে।
তফসিল অনুযায়ী, দুই সিটির মনোনয়নপত্র জমা ও যাচাই-বাছাই শেষ হয়েছে। ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রার্থিতা প্রত্যাহার করা যাবে। আর ১০ জানুয়ারি থেকে প্রার্থীরা প্রচারণা শুরু করতে পারবেন। ভোটগ্রহণ করা হবে ৩০ জানুয়ারি। ডিএনসিসিতে ভোটার সংখ্যা ৩০ লাখ ৩৫ হাজার ৬২১। সাধারণ ওয়ার্ড ৫৪টি এবং সংরক্ষিত ১৮টি। সম্ভাব্য ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা এক হাজার ৩৪৯ এবং ভোটকক্ষ সাত হাজার ৫১৬টি। ডিএসসিসিতে ভোটার সংখ্যা ২৩ লাখ ৬৭ হাজার ৪৮৮। সাধারণ ওয়ার্ড ৭৫টি এবং সংরক্ষিত ২৫টি। সম্ভাব্য ভোটকেন্দ্র এক হাজার ১২৪ এবং ভোটকক্ষ পাঁচ হাজার ৯৯৮টি।