মোবারক হোসেন খানের অসাধারণ স্মৃতি কথা

মোবারক হোসেন খান | Jan 02, 2020 05:08 pm
মোবারক হোসেন খান

মোবারক হোসেন খান - ছবি : সংগ্রহ

 

বেতারে আমার অস্তিত্বের কথা লেখার জন্য কলম নিয়ে বসেছি। সুদীর্ঘ ত্রিশ বছর বেতারে চাকরি করেছি। ১৯৬২ সালের ২২ অক্টোবর থেকে ১৯৯২ সালের ১৫ জুন। এত দীর্ঘ সময়ের কথা লেখার জন্য প্রয়োজন বিরাট কলেবর। কিন্তু লিখতে হবে সীমাবদ্ধতার মধ্যে। সুতরাং সব কথা বলার সুযোগ নেই। আর লিখতে বসলেই যেসব কথা যেভাবে ঘটেছে সময়ের পরিক্রমায় তা লেখা সম্ভবও নয়। তবে কিছু কিছু কথা তো বলতেই পারি! নাই বা হলো ধারাবাহিকভাবে। কিন্তু সে কথাগুলো তো অবশ্যই ঐতিহাসিক দলিল।

বেতারে যখন চাকরিতে প্রবেশ করি তখনো বুঝতে পারিনি সেটা কী বিরাট চ্যালেঞ্জিং কাজ। তাই অভিজ্ঞতার থলিতে বিচিত্র সব ঘটনা জমা হয়ে আছে। চাকরি জীবনে ঘটনা যেমন ঘটেছে অনেক অঘটনের মুখোমুখিও হতে হয়েছে। চাকরিটা আমি নিইনি। আমার বাবা দেশবরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আয়েত আলী খা নিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর একটি মাত্র উপদেশ ছিল, শিল্পীদের প্রতি যেন আমার শ্রদ্ধা প্রদর্শন কিঞ্চিৎ পরিমাণেও ঘাটতি না পড়ে। আমার বাবা খুব বড় সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। বেতার নিয়মিত অনুষ্ঠান করেছেন। হয়তো বেতারের অফিসারদের কাছ থেকে এমন কোনো অবাঞ্ছিত ঘটনায় মনে আঘাত পেয়েছিলেন, সেই যন্ত্রণা নিরসনের জন্য তাঁর একটি ছেলেকে অন্তত লেখাপড়া শিখিয়ে বেতারের চাকরিতে নিয়োজিত করবেন তেমনি একটা দৃঢ় প্রত্যয় তাঁর মনে জমা হয়েছিল। আমি এমএ পাস করার পর তিনি সেই মনোবাঞ্ছা পূরণ করেছিলেন। আমিও আমার বাবার উপদেশ বিন্দুমাত্র হেরফের করিনি। শুধু শিল্পী কেন, বেতারের সব শ্রেণীর কর্মীদের প্রতি আমার ব্যবহার ও আচরণ বেতারে আমাকে একজন শ্রদ্ধেয় ও জনপ্রিয় হিসেবে পরিণত করেছিল।

বেতার এমন একটা চাকরি যেখানে প্রতিক্ষণ স্নায়ুচাপে থাকতে হয়। অনুষ্ঠান ব্রডকাস্টে বিন্দুমাত্র হেরফের হলেই মহাবিপদ। সুতরাং সদাসর্বদা অত্যন্ত সতর্ক ও সচেতন থাকতে হতো। সর্বোপরি চাকরিটা হলো সেকেন্ড-টু-সেকেন্ড, মিনিট-টু মিনিটের চাকরি। ৭টার অনুষ্ঠান ঠিক ৭টাতে প্রচার করতে হবে। এক সেকেন্ড আগেও নয় পরেও নয়। নির্ধারিত সময়ের আগে প্রচার করা ক্রাইম হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। কারণ শ্রোতারা নির্ধারিত সময় রেডিও টিউন করে যদি শুনতে পায় যে অনুষ্ঠান আগেই শুরু হয়ে গেছে, তাহলে যে কোনো শ্রোতা আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। আর এমন ঘটনা ঘটেও ছিল। প্রখ্যাত একজন মহিলা শিল্পী আইনের দ্বারস্থ হয়েছিলেন এবং বেতার কর্তৃপক্ষকে ক্ষমা প্রার্থনা করে নিস্তার লাভ করতে হয়েছিল।

ঘটনা-অঘটনার দু-একটা বলছি। বেতারে জোগদানের কয়েক মাসের মধ্যেই একজন বেতারশিল্পীর সাথে আমার বিয়ের দিনক্ষণ ধার্য হয়। বিয়ের আমন্ত্রণপত্র নিয়ে আঞ্চলিক পরিচালককে দাওয়াত করতে গেলাম। আমার সঙ্গে সহকর্মী। জামান আলী খান। আমরা দুজনেই সঙ্গীত বিভাগের দায়িত্বে। আমি বিয়ে করছি। সঙ্গীত বিভাগেরই একজন বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী ফওজিয়া ইয়াসমীনকে। আঞ্চলিক পরিচালক আমন্ত্রণপত্রে সেই কণ্ঠশিল্পীর নাম দেখেই রোষে জ্বলে উঠলেন। আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে মেজাজ চড়িয়ে রাগতস্বরে ইংরেজিতে বলে উঠলেন, You can't marry a radio artist. If you want to marry her resign from the service then marry. তাঁর কথা শুনে তো আমার মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল। আমি তাঁর মুখের ওপর বললাম, I am not going to resign, but I am going to marry the artist. এই কথা বলেই দস্তুরমতো বীরদর্পে আঞ্চলিক পরিচালকের ঘর থেকে জামান আলী খানকে নিয়ে বের হয়ে এলাম। রাগের বশে তো চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে এলাম। এবার এটাকে তো সামলাতে হবে। একটা বুদ্ধি বের হয়ে গেল। তখন কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতার মন্ত্রী ছিলেন ব্যারিস্টার এ টি এ মোস্তফা। তাঁর ছোট ভাই একজন বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী। ভালো বেহালা বাজাতেন। আমরা ‘ময়না ভাই’ বলে ডাকতাম। আমি তাঁর শরণাপন্ন হলাম। একটা আমন্ত্রণপত্র তাঁর হাতে দিয়ে বললাম সেটা বেতার মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে পাঠিয়ে দিতে। সে সাথে বাবার অনুরোধ জানিয়ে আমার বৌভাত অনুষ্ঠানে যেন উপস্থিত হন সে কথাও বলে দিলাম। ময়না ভাই আমন্ত্রণপত্র আর চিঠি পাঠিয়ে দিলেন। বাবার অনুরোধ রক্ষা করতে রাওয়ালপিন্ডি থেকে তথ্য ও বেতারমন্ত্রী আমার বৌভাত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঠিক এসে গেলেন। আমার ফাঁড়া কেটে গেল। আমি তখন রেডিওতে বলতে গেলে বেশ ক্ষমতাবান অফিসারে গণ্য হয়ে গেলাম।

বেতারে চাকরি করতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন উপস্থিত বুদ্ধি আর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। তাহলে যে কোনো অঘটন থেকে রেহাই পাওয়া যায়। যেমন একটি ঘটনার কথা বলি। আমি তখন রংপুর বেতারে দায়িত্বে নিয়োজিত। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনেম খান রংপুরে গেলেন ট্যুরে। উঠলেন সার্কিট হাউসে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী রাজশাহী বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের অধিকর্তাদের উপস্থিত থাকতে হয়। বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল, জেলা প্রশাসকদের সাথে আমিও সার্কিট হাউজের একটি কক্ষে বসে গল্পগুজব করছি। এমন সময় হঠাৎ গভর্নর আমাকে দেখা করার ফরমান পাঠালেন। আকস্মিক ফরমান পেয়ে হৃৎপিণ্ডটা ঝাঁকি মেরে দৌড় শুরু করল। আমি ভীরুপদে তাঁর সামনে হাজির হলাম। দেখলাম, তাঁর চারপাশে স্থানীয় মোসাহেবের দল। আমাকে দেখেই গভর্নর সাহেব হাঁক মেরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমি আজ বিকালে পাবলিক মিটিংয়ে বক্তৃতা দেব, জানো?

আমি কোনোমতে বললাম, জানি’। মোসাহেবদের দেখিয়ে বললেন, তাঁরা বলছে রেডিওতে নাকি আমার বক্তৃতা দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হচ্ছে না। অতি সত্য কথা। আমি তো মহাবিপদে। পরিত্রাণের পথ খুঁজছি। হঠাৎ আমার চোখ পড়ল গভর্নর সাহেবের পেছনে দেয়ালে ঝুলানো বিরাট ঘড়িটার দিকে। বারোটা বাজতে তখনো পাঁচ মিনিট বাকি। হঠাৎ বুদ্ধিটা মাথায় খেলে গেল। আমি বললাম, আমাদের ট্রান্সমিশন শুরু হতে আরো পাঁচ মিনিট দেরি। বেলা বারোটায় শুরু হবে। ট্রান্সমিশন শুরু হলেই অগ্রিম ঘোষণা প্রচার করা হবে। আমার কথা শুনে গভর্নর সাহেবের তেতে ওঠা মেজাজটা ঠাণ্ডা হয়ে গেল বলে মনে হলো। শুধু বললেন, ‘তাই নাকি? তাহলে যাও অগ্রিম ঘোষণার ব্যবস্থা করো গিয়ে। আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ঘাম দিয়ে যেন জ্বর সারলো। কিন্তু গভর্নর সাহেবের হাত থেকে রক্ষা পেলেই তো হবে না। তখন রংপুর বেতার স্টেশন থেকে দুপুরের কোনো অনুষ্ঠান প্রচার করা হতো না। কিংবা ঢাকা স্টেশনের অনুষ্ঠানও সম্প্রচার করি না। কিন্তু ব্যতিক্রম তো আছেই। আর বিপদকালে তো বটেই। আমি সার্কিট হাউজ থেকেই টেলিফোন করে অফিসে বলে দিলাম ঢাকা কেন্দ্রের অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু করতে এবং গভর্নর সাহেবের মিটিংয়ের অগ্রিম ঘোষণা দিতে।

এমনি ধরনের কত না ঘটনার যে বেতার-জীবনে মুখোমুখি হতে হয়েছিল তা লিখতে গেলে হয়তো মহাগ্রন্থ হয়ে যাবে।

বেতারে আমি যখন চাকরি নিই তখন আমাদের সহকর্মী ছিলেন জামান আলী খান, নূরন্নবী খান, সৈয়দ ইকবাল আহমেদ, মোহাম্মদ তাহের, মবজুলুল হোসেন, আতিকুল হক চৌধুরী, হেমায়েত হোসেন। আমরা সবাই ছিলাম অনুষ্ঠান প্রযোজক। তখনকার দিনে অনুষ্ঠান প্রযোজকরাই ছিল বেতারের মূল চালিকাশক্তি। অবসর জীবনে যখন সেই আলোকিত দিনগুলোর কথা ভাবি তখন যেন স্বপ্নের মতো মনে হয়। সেদিনের যাদের সঙ্গে কাজ করেছি, সেই সহকর্মীরা সবাই ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান, কর্মনিষ্ঠ ও দক্ষ। তাদের কথা পৃথক পৃথক বলতে গেলে অধ্যায়ের পর অধ্যায় লিখতে হবে। তাঁর চেয়ে বেতারের বাইরের যে সকল শিল্পীসাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীর সাথে বেতারের মাধ্যমে সান্নিধ্যে এসেছি তাদের কিছু কথা নিয়েই বেতার স্মৃতি লিখলাম।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কোর্টের কাছেই ছিল আমার বাবার বাদ্যযন্ত্রের কারখানা। কারখানার দুটো ভাগ। সামনের ভাগে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সারি। আলমারির ভেতর সুন্দর করে সাজানো। আমাদের কারখানার তৈরি। আলমারির পেছনে কারখানা। কারখানার এক পাশে সঙ্গীত-শিক্ষার্থীদের তালিমের ব্যবস্থা। লেখাপড়ার পাশাপাশি আমি বাদ্যযন্ত্র বাজাবার জন্য বেহালা হাতে তুলে নিই। প্রতিদিন বিকালে বেহালা সাধতে হতো। আমার যন্ত্র শেখাটা ছিল অনেকটা শখের। প্রতিদিন স্কুল থেকে এসে কারখানায় যেতে হতো। খেলাধুলা করতে সময় যাওয়ার আগে কিছুক্ষণ বেহালায় সরগম সাধতাম। আমাদের কারখানায় বাবা পাশ্চাত্য যন্ত্র চেলোর অনুকরণে একটা যন্ত্র তৈরি করেন। এই যন্ত্রের পরামর্শ দিয়েছিলেন আমার পিতৃব্য ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। বাবা যন্ত্রটির নাম রেখেছিলেন ‘মন্দ্রনাদ’। বেশ গুরুগম্ভীর আওয়াজ। বেহালার আকার। কিন্তু বিরাট। বেহালার মতো উল্টো করে বাজাতে হয় না। সোজাভাবেই দুহাঁটুর ভাজে চেপে ধরে বাজাতে হয়। বেহালার পর বেশ কয়েক বছর অভ্যাস করলাম মন্দ্রনাদ। বেশ হাতও হয়ে গিয়েছিল। ঢাকা রেডিওতে বেশ কয়েক মাস মন্দ্রনাদ বাজিয়েছিলাম। সে সময়ের অনুষ্ঠান প্রযোজক এহিয়া খান (পরবর্তীকালে বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক) আমাকে এই সুযোগটা করে দিয়েছিলেন।

তখনকার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে। একদিন ফেরদৌসী বেগম গাইতে এসেছেন রেডিওতে। তাঁর সাথে এসেছেন তাঁর বাবা আব্বাসউদ্দীন আহমেদ। পল্লী সঙ্গীতের সম্রাট হিসেবে তখন তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য। ফেরদৌসী স্টুডিওতে ঢুকে গেল। আব্বাস উদ্দিন সাহেব বারান্দায় দাঁড়িয়ে রেডিওর শিল্পীদের সাথে গল্পগুজব করতে লাগলেন। রেডিও অফিস তখন নাজিমুদ্দিন রোডে। এখন যেটা শেখ বোরহানউদ্দিন কলেজ। তখন রেডিও অফিসে সর্বসাকুল্যে তিনটে স্টুডিও ছিল। দোতলায় দুটো আর এক তলায় একটা বড় স্টুডিও। ফেরদৌসীর নিচের তলায় স্টুডিওতে অনুষ্ঠান শিডিউল ছিল। আব্বাসউদ্দীন সাহেবের পেছনে দাঁড়িয়ে আমি তাদের গল্প শুনছিলাম। তাঁর মুখে একটা আত্মগর্বের হাসি। গল্পচ্ছলে ফেরদৌসীর কৃতিত্বের কথা বলছিলেন। সেবারই ফেরদৌসী ম্যাট্রিক পাস করে। মেধা তালিকায় সম্মিলিতভাবে সপ্তম ও মেয়েদের মধ্যে প্রথম। শ্রোতারা আব্বাসউদ্দীন সাহেবের কথা শুনে ফেরদৌসীর তারিফ করলেন। এমন সময় লাউড স্পিকারে ফেরদৌসীর কণ্ঠের গান ভেসে এলো। রেডিওর প্রতিটি কক্ষে তখন লাউড স্পিকার থাকত। অফিসাররা কক্ষে বসেই শিল্পীদের গান বাজনা বা নাটক শুনতে পারতেন। আমি এই প্রথম ফেরদৌসীর গান শুনলাম। বেশ দরাজ কণ্ঠ মনে হলো।

মেয়েটি সত্যি খুব সুন্দর গান গায়। ফেরদৌসীর সাথে চাকরি সূত্রে পরে পরিচয় হয়েছিল। ফেরদৌসী বেগম পরবর্তীতে পরিণয় সূত্রে ফেরদৌসী রহমান। আব্বাসউদ্দীন সাহেবের বড় ছেলে মোস্তফা কামাল সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এবং ছোট ছেলে মুস্তাফা জামান আব্বাসী ইতিহাস শাস্ত্রে এমএ।

আব্বাসউদ্দীন সাহেবকে কিন্তু শৈশবকালে আরেকবার দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তখন প্রতি বছর শীতকালে মেলা হতো। মৌড়াইলের ফুটবল খেলার মাঠে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হতো। আব্বাসউদ্দীন সাহেব তখন সরকারের সংগীত পাবলিসিটি বিভাগে চাকরি করেন। সেই প্রদর্শনীতে তাঁর দলবলেও গানের আসরের আয়োজন করা হয়েছিল। তিনি তাঁর দলবল নিয়ে আমাদের বাসায় এসে হাজির হলেন। আব্বাসউদ্দীন সাহেব আগেই বাবার কাছে খবর পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বাবা তাঁদের জন্য দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। বাবা তাকে ও তাঁর দলবলকে আদর-আপ্যায়ন করে খাওয়ালেন। আব্বাসউদ্দীনের সেই গানের দলে ছিলেন বেদার উদ্দিন আহমেদ, সোহরাব হোসেন, মো: ওসমান খানের মতো সব নামীদামি শিল্পী।

আব্বাসউদ্দীন সাহেবকে শেষবারের মতো দেখেছিলাম তাঁর পুরানা পল্টনের বাড়িতে। একদিন বিকেলে গিয়েছিলাম তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। বাবার পরিচয় পেয়ে তিনি বড় আদর-যত্ন করলেন আমাকে। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। ঘরের ভেতর তখন ফেরদৌসী খেয়াল রেয়াজ করছিল। মেয়ের গানের খুব প্রশংসা করলেন। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রতি ফেরদৌসীর প্রীতির কথা বললেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, বাবা! আমি ভাওয়াইয়া গান গাইলে কি হবে, আমার মেয়েকে আমি ঠিক ক্ল্যাসিকাল গান শিখিয়েছি। কারণ কি জানো? ক্ল্যাসিকাল গান না জানলে তো গান শেখাই হলো না। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রতি আব্বাসউদ্দীনের এমনি ছিল একটা প্রগাঢ় শ্রদ্ধা।

জীবন চলার পথে কত না বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয় তাঁর হিসেবও বুঝি রাখা যায় না। কত না মজার ঘটনা ঘটে তাঁর ইয়ত্তাও যেন নেই। জীবন মানেই বুঝি বাঁচার সংগ্রাম। এই সংগ্রাম যে কতটা অ্যাডভেঞ্চারপূর্ণ তাঁর ইতিহাস বয়ান করেও শেষ করা যায় না। কখনো আনন্দ, আবার কখনো বিষাদ, নানান ধরনের অভিজ্ঞতা জীবনকে করে তুলে বৈচিত্র্যময়। এই বিচিত্র জীবনের মাঝে বাস করে যখন অতীতের রোমন্থন করি তখন অদ্ভুত এক রসে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে মন। যে রসের রূপ প্রকাশ করা যায় না। ভাব ভাষার আখরে ধরা দিতে চায় না। মেঘের মতো লুকোচুরি খেলা করে। তবু অতীতকে স্মরণ করতে ভালো লাগে।

কুমিল্লা কলেজ থেকে বিএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছি। বন্ধু-বান্ধবদের অনেকেই এফ এইচ এম হলে থাকে। আমিও এফ এইচ এম হলে আবাসিক ছাত্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হলাম। আমি ইস্ট হাউসে স্থান পেলাম। দোতলায়! আমাদের হাউস টিউটর অধ্যাপক নূরুল মোমেন। সাহেবের কোয়ার্টারও দোতলায়। ঠিক আমার রুমের লাগোয়া। জানি না, কিভাবে আমি নূরুল মোমেন সাহেবের হৃদয় জয় করে স্নেহধন্য হতে পেরেছিলাম। তিনি প্রায়ই আমাকে ডেকে পাঠাতেন। অনেক গল্প-গুজব করতেন।

আমি নূরুল মোমেন সাহেবের নাম কুমিল্লায় অবস্থানকালেই শুনেছিলাম। অত বড় একজন নাট্যকার, তাঁর সম্বন্ধে আমার মনে একটা সমীহ ভাব ছিল। অনেকটা ভীতিজনিত সমীহ। কিন্তু তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর আমার সেই ভীতি চলে গিয়েছিল। আমি তাঁকে অত্যন্ত আপনজন হিসেবে পাবার সুযোগ লাভ করেছিলাম।
আগ্রহ আরো আশ্চর্যের ব্যাপার, কয়েকদিন পরে আমি হলের ড্রামা অ্যান্ড সোশ্যালস’ সম্পাদক নির্বাচিত হলাম। ওই বছরই এন্টারটেইনমেন্ট সেক্রেটারি পদবি বদলে ঐ নাম করা হয়। ড্রামা সম্পাদক হিসেবে নূরুল মোমেন সাহেবের আরো ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য ও সাহচর্য লাভে সুযোগ পেয়েছিলাম। ঐ সময় তিনি যদি এমন হতো’, ‘ভাই ভাই’ ইত্যাদি নাটকগুলো আমাদের জন্যে উপহার দিয়েছিলেন।

নূরুল মোমেন সাহেব শুধু নাটক লিখেই দায়িত্ব শেষ করেননি, তিনি অদ্ভুত অভিনয় করতেন। আর নাট্য পরিচালক হিসেবেও তাঁর দক্ষতা ও কৌশল ছিল অপূর্ব। পরবর্তীকালে আমাকে একদিন বলেছিলেন, বুঝলে, আমাকে ‘নেমেসিস’ নাটকে অভিনয় করতে বলা হলে আমি প্রথমে একটু ঘাবড়েই গিয়েছিলাম। আমার লেখা নাটক। হৃদয়ের সব অনুভূতি উজাড় করে দিয়ে লিখেছি। অভিনয়ের ভেতর দিয়ে যদি তা ফোটাতে না পারি তাহলে আমার চরম পরাজয় ঘটবে।

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us