ফিরে পেতে চাই
ফিরে পেতে চাই - ছবি : অন্য দিগন্ত
বনে যদি ফুটলো কুসুম
নেই কেন, নেই কেন, সেই সুর
বনে বনে প্রচুর ফুল ফুটেছে। মাধবী, বকুল, চাঁপা, চামেলী, শেফালী, মালতি, পারুল, নানা বর্ণের নানা ছন্দের ফুল ফুটিয়ে কেটেছে আষাঢ় ও শ্রাবণ। ভাদ্র আশ্বিন মাস অবধি মেঘ জমেছিল অঝোর ধারায় বর্ষণ নিয়ে। কার্তিকে এসেও বৃষ্টির আনাগোনা চলে। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, নদীর চরে কাশ বনের সাদা আকাশ দিয়ে পাখা মেলা সাদা বলাকা, তবু যেন মনে হয় বাংলার ঋতুগুলো এখন এক সঙ্গে মিতালী করে চলছে। এখন চলছে শীত। কুয়াশাঢাকা শীতের ঋতু আমাদের। ঢাকায় বেশ কবছর পর এবার নামলো শীত। শীতের মধ্যেই এলো ১ জানুয়ারি- নতুন বছর। নতুন বছর নতুন করে ভাবনার দিন। নতুন করে দেখার দিন।
এবার সবজি ও ফল প্রচুর এসেছে বাজারে। লাউ ঝিঙা পটল কুমড়া বেগুন ফুলকপি বাঁধাকপি ডাঁটা বরবটি কাকরল শিম মুলা এমনকি অসময়ের নানা ধরনের সবজিরাও পথ ভুলে চলে এসেছে। তবে দাম চড়া। শীতের সবজি এত দাম আগে ছিলো না। মাছের বাজারে আগুন লাগার উপক্রম, তবু কমতি নেই আমদানির। ইলিশ রুই কাতল মৃগেল রূপচাঁদা পাঙ্গাশ কই পুঁটি তেলাপিয়া কত না ডিজাইনের মাছ বাজারে উপচে পড়ছে। দাম অবশ্য মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার পরোয়া করছে না। একমুঠো ভাত আর একহাতা ডাল যাদের নিত্যদিনের চাহিদা তারা এ সবের খবর রাখে না। মানুষে মানুষে এই যে বৈষম্য এটি মানুষেরই সৃষ্টি। স্রষ্টা একইভাবে তার শিল্পকর্ম করেন, সব মানুষ ভাই ভাই এই তাঁর আদর্শ।
পথে বের হলেই দেখি শীর্ণ দু’টি হাত, করুণ তার আকুতি- ‘আম্মা তোয়ালে নেবেন খুব সস্তা মাত্র বিশ টাকা, যদি ছয়টি নেন ১০০ টাকায় দিয়ে দেব।’
আরেকজন এগিয়ে আসে দুই হাতভর্তি সাদা দোলনচাঁপার গুচ্ছ। এখানে দরাদরি শুরু হয় :
‘মাত্র দু’শ’ টাকা,
দু’শ’ কিরে, একশ’-তে দাও
না আম্মা একশ’ না আরো পঞ্চাশ টাকা দেন
অত হবে না
ঠিক আছে আরো বিশ টাকা দেন তা হলেই হবে
দরদামের শেষে দুই আঁটি দোলনচাঁপা নিয়ে আমি তার খুশবু নিই।
জোটে যদি মোটে একটি পয়সা খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি
দু’টি জোটে তবে অর্ধেকে ফুল কিনে নিও হে অনুরাগী
বড় বড় অট্টালিকার কারাগারে বন্দী নাগরিক জীবনে সুকুমারবৃত্তিগুলো পথ হারিয়ে ফেলছে। যেখানে আকাশ দেখা যায় না, মুক্ত বাতাস পাওয়া যায় না, রাস্তায় নানা রকম আবর্জনা সেখানে মানুষ দমবন্ধ হয়ে পড়ছে। নতুন বছরে এসব নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের।
এত যে সন্ত্রাস হানাহানি বিবাদ বিসম্বাদ তার মূলে কাজ করে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্নতা। রুক্ষ বিষণ্ন রাগান্বিত হয়ে পড়ছে অকারণে। একটু ক্ষমা একটু ধৈর্য একটু উদারতা একটু পরমতসহিষ্ণুতা কেন জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। শ্যামল বাংলার শ্যামলিমাখা অন্তর আবার আমাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। ছুটির দিনে সব বিষণ্নতা ঝেড়ে ফেলে প্রকৃতির কাছে দু’দণ্ড জিরিয়ে নেয়ার ফুরসত খুঁজে বের করতে হবে। তা হলে দেখা যাবে আকাশের উদারতা বাতাসের হিমেল হাওয়া কাশবনের শুভ্রতা আমাদের অন্তরকে আবার ফিরিয়ে দেবে তার জন্মলগ্নের পবিত্র উদারতা।
আমি পাখির কাছে যাই, আমি বনের কাছে যাই, আমি নদীর কাছে যাই, আমি নীল আকাশে ঘুরে বেড়াই, আমি রংধনুর সাতটি রঙে সাত সুরের বেহালা বাজাই। আসলে মানুষ মাত্রেই রোমান্টিক, কল্পনাবিলাসী, যার মনে কল্পনা নেই সে তো মানুষই হতে পারল না। আঁধার আকাশে মেঘের ডম্বরু বাজিয়ে যখন ঘনঘটার আবির্ভাব হয়, তখন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষমাত্রই বর্তমানকে ভুলে অতীত অথবা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেন হৃদয়ে।
আমারো এখন মন হারাবার ক্ষণ। সেই সুদূরে মনু নদী তীরে ছবির মতো সুন্দর একটি শহর। চারদিক লতাপাতা গাছের সবুজ মায়াবী পরশ মাখিয়ে ডাক দেয় পথিকজনে। শরৎকালে নদীতীরে সাদা শুভ্র কাশের গুচ্ছ হাতছানি দিয়ে আপন করে নিতে চায়, ছোট নদীতে পাল তুলে নৌকো যায় কোনো নাইওরিকে বাপের বাড়ি পৌঁছে দিতে। নদীর ঢেউ কখনো বড় কখনো বা ছোট, তারই দোলায় ছন্দ আসে নৌকোতে। আমরা যখন সেই পাল তোলা নৌকায় রওয়ানা দিতাম পিতার ভূমিতে, যার নাম নবীগঞ্জ, আমাদের মনে অহর্নিশি বাঁশি বাজাত সে কোন সুজন। শহর থেকে অদূরে যাওয়া কী যে আনন্দের, গ্রামের মাটি গ্রামের প্রকৃতি গ্রামের খালবিল নদী সবই যেন অতুলনীয়।
আমরা ঘরে থাকতে চাইতাম না। সব আনন্দ যে ছড়ানো আছে ঘরের বাইরে। সেখানে এবাড়ি ওবাড়ি থেকে সব শিশু-কিশোর বের হয়ে আসত, শহুরে মেহমান যে তাদের কাছে কল্পজগতের মানুষ। আমাদেরও তেমনি বিস্ময় লাগত গ্রামের সহজ সরল কচিপাতার মতো শিশুদের। তাদের মন যেন ঝকঝকে শ্লেটের মতো পরিষ্কার। শহুরে চাকচিক্য যে মেকি রাঙতার পরশ বোলায় তা যে কত কৃত্রিম এই বোধোদয় গ্রামে এলেই বোঝা যায়। রাতেরবেলা ঝোপে ঝোপে জোনাকির আলো, ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর আওয়াজ, শিয়ালের হুক্কাহুয়া গান আমাদের জন্য অতি আনন্দের খোরাক।
রাত সাড়ে ৮টার দিকে বড় ঘরে মাটিতে দস্তরখানা পেতে খাওয়ার আয়োজন। ক্ষেতের আমন ধানের সুগন্ধি ভাত, নানা রকম টাটকা মাছের মুচমুচে ভাজি, ঘরে পোষা মুরগির সুরুয়া, আর শেষ পাতে ঘন দুধ সবরি কলা ও নলেন গুড়। এ যে মহাভোজ, যত না খাওয়া তার চেয়ে বেশি চেঁচামেচি। চাচী আম্মা, ফুপু আম্মা, সবাই মিলে হিমশিম খেতেন আমাদের সামলাতে গিয়ে।
দিনের পর দিন বছরের পর বছর পার হয়ে এলাম। এখন দেখি রাজধানীর যানজট জনজট ধোঁয়া ধূলায় বন্দী এক শিবিরে শহরবাসী আবদ্ধ। রাস্তায় বেরুনোর উপায় নেই, এক ঘণ্টার দূরত্ব এখন ছয় ঘণ্টায় দাঁড়িয়েছে। কথা দিলেও কথা রাখার উপায় নেই, বিয়ে বা অন্য কোনো উৎসবে যাওয়ার কথা ভাবলেই কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। তবু তারই মধ্যে খুশি থাকার চেষ্টা।
এ বছর প্রচুর ফল এসেছে বাজারে, নানা জাতের নানা ধরনের আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, বাঙ্গি, তরমুজ, কলা, পেঁপে, জামরুল, সবই শোভা পাচ্ছে বড় বড় ঝুড়িতে। ফরমালিনের ভয় কিছুটা কাটছে, শুনেছি যে কোনো ফল কিনে এনে ঘণ্টা দু’য়েক পানিতে ভিজিয়ে রাখলে দোষণমুক্ত হয়। আমি অতটা ভয় পাই না। বাস করছি তো ভেজালের শহরে, কাজেই এখন সবাইকে ভেজালপ্রুফ হতে হবে। নানা রকম বিজ্ঞাপন দেখে নানা দোকানে যাই, তারপর আল্লাহ্র নাম করে মুখে ঢুকাই। এ ছাড়া উপায় কী।
ভেজাল ছাড়া একটি সুন্দর জগৎ আমার পাঁচতলার ঝুলন্ত বারান্দায় ফুল লতাপাতার বাগান। বর্ষাকালে কত যে ফুল ফুটল, বেলী, চামেলী, রজনীগন্ধা, বকুল, শেফালী, জুঁই, হাসনুহেনা, তাদের সুরভীতে বাতাসকে মাতিয়ে রাখল। আর আমরা শরৎকাল ও হেমন্তকালেও পেলাম বর্ষার রিমঝিম বর্ষণ।
আজি ঝরঝর মুখরিত বাদলে
জানি নে জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না
হেমন্ত শেষে এলো শীত ঋতু। শীতের শীতলতা নিয়ে আমরা উদযাপন করছি নতুন বছর। নতুন বছর আমাদের জন্য নতুন কিছু নিয়ে আসুক। আমরা ফিরে পেতে চাই আমাদের স্বাভাবিক সুন্দর। পেতে চাই আমাদের প্রাণসর্বস্ব জীবন ধারা।