ভারতে মুসলিমদেরকে কেন বাদ দেয়া হচ্ছে?

ইফতিখার গিলানি | Dec 30, 2019 08:52 pm
অস্বস্তি এড়াতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে অমুসলিম উদ্বাস্তুদের তথা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারর্সিদের নাগরিকত্ব মঞ্জুর করার জন্য নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন প্রণয়ন করেছে। ভারতীয় পার্লামেন্ট সম্প্রতি আইনটি পাস করেছে। অথচ নথিপত্রের অভাবে বা নামে ভুল থাকায় আট লাখ মুসলিমকে বিচার বিভাগের কাছে আবেদন জানাতে হচ্ছে। হাইকোর্টও যদি তাদেরকে সন্দেহজনক নাগরিক ঘোষণা করে, তবে তারা ষ্ট্রহীন হয়ে যাবে এবং তাদের বহিষ্কার শুরু হবে। অবশ্য, এখন পর্যন্ত কেউ জানে না, তাদেরকে কোথায় পাঠানো হবে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছে, তারা আর কাউকে গ্রহণ করবে না।

অস্বস্তি এড়াতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে অমুসলিম উদ্বাস্তুদের তথা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারর্সিদের নাগরিকত্ব মঞ্জুর করার জন্য নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন প্রণয়ন করেছে। ভারতীয় পার্লামেন্ট সম্প্রতি আইনটি পাস করেছে। অথচ নথিপত্রের অভাবে বা নামে ভুল থাকায় আট লাখ মুসলিমকে বিচার বিভাগের কাছে আবেদন জানাতে হচ্ছে। হাইকোর্টও যদি তাদেরকে সন্দেহজনক নাগরিক ঘোষণা করে, তবে তারা ষ্ট্রহীন হয়ে যাবে এবং তাদের বহিষ্কার শুরু হবে। অবশ্য, এখন পর্যন্ত কেউ জানে না, তাদেরকে কোথায় পাঠানো হবে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছে, তারা আর কাউকে গ্রহণ করবে না। - ছবি : সংগৃহীত

 

কয়েক মাস আগে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের অবৈধ অভিবাসীদের খুঁজে বের করার সাত বছরের প্রয়াস সমাপ্ত হলো, তখন এর ফলাফল হজম করা ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) কাছে কঠিন হলো।
হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের সমর্থিত দলটি ১৯৮০ সালে যাত্রা শুরু করার পর থেকে তার মূল স্তম্ভগুলোর একটি হিসেবে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) মাধ্যমে বিদেশীদের খুঁজে বের করে বহিষ্কার করাকে গ্রহণ করেছে।

দলটির নেতারা দাবি করেছিল যে এই অঞ্চলে কোটি কোটি বাংলাদেশী নাগরিক অনুপ্রবেশ করে বিভিন্ন জেলায় হিন্দুদের সংখ্যালঘু করে ফেলছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের তদারকিতে পরিচালিত এনআরসিতে ৩ কোটি ৯৯ লাখ লোকের মধ্যে নথিপত্র না থাকায় ১৯ লাখ লোককে সন্দেহজনক নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করে। এদের মধ্যে ১১ লাখ হিন্দু, আর মুসলিম সংখ্যঅ মাত্র আট লাখ।

অস্বস্তি এড়াতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে অমুসলিম উদ্বাস্তুদের তথা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারর্সিদের নাগরিকত্ব মঞ্জুর করার জন্য নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন প্রণয়ন করেছে। ভারতীয় পার্লামেন্ট সম্প্রতি আইনটি পাস করেছে।
অথচ নথিপত্রের অভাবে বা নামে ভুল থাকায় আট লাখ মুসলিমকে বিচার বিভাগের কাছে আবেদন জানাতে হচ্ছে। হাইকোর্টও যদি তাদেরকে সন্দেহজনক নাগরিক ঘোষণা করে, তবে তারা ষ্ট্রহীন হয়ে যাবে এবং তাদের বহিষ্কার শুরু হবে। অবশ্য, এখন পর্যন্ত কেউ জানে না, তাদেরকে কোথায় পাঠানো হবে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছে, তারা আর কাউকে গ্রহণ করবে না।

মুসলিম নেতারা বলছেন, প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আসা নির্যাতিত নাগরিকদের নাগরিকত্ব মঞ্জুর করাবিষয়ক আইনটির ব্যাপারে তাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে তাদের আপত্তি ভারতব্যাপী এনআরসি বাস্তবায়নের সাথে নাগরিকত্ব আইনটি সম্পর্ক নিয়ে। কেন্দ্রীয় সরকার ইতোমধ্যে। ১.১৬ বিলিয়ন ডলার (৮৩ বিলিয়ন রুপি) ব্যয়ে জাতীয় জনসংখ্যা নিবন্ধন (এনপিআর) পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে। ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে মোদি আশ্বাস দিয়েছেন যে দেশব্যাপী কোনো এনআরসি হবে না, বরং এনপিআর নথি হবে নাগরিকদের নিবন্ধনের হালনাগাদের সাথে সম্পর্কিত।
প্রখ্যাত মুসলিম নেতা আসাদুদ্দিন ওয়াইসি দাবি করেছেন, নিম্ন পদস্থ কর্মকর্তাদের ঘরে ঘরে গিয়ে নাগরিকত্ব প্রমাণের নথিপত্র দেখে যাদের এগুলো নেই, তাদেরকে সন্দেহজনক নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করার কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছে।
জটিল, ব্যয়বহুল কাজ
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, ভারতের মুসলিম জনসংখ্যা ১৭ কোটি ২২ লাখ। তারা ভারতের মোট জনসংখ্যার ১৪.২ ভাগ। তিনি বলেন, কোনো হিন্দু যদি নথিপত্র দেখাতে না পারে, তবে তাকে নতুন আইনে বিবেচনা করা হবে। কিন্তু মুসলিমেরা রাষ্ট্রহীন হয়ে যাবে।

আসামে প্রকল্পটি কাঙ্ক্ষিত ফলাফল দিতে ব্যর্থ হওয়ার প্রেক্ষাপটে বিজেপি নেতা হিমান্ত বিশ্ব শর্মা বলেন, বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী ভারতের অন্যান্য অংশে অভিবাসন করায় আসামে খুব বেশি বিদেশী পাওয়া যায়নি। অন্য কথায় বলা যায়, সারা ভারতে তাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে।
তিনি মনে করেন, ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ খুঁজে বের করার জন্য দেশব্যাপী এনআরসি করা প্রয়োজনীয় বিষয়।
আসামে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচিতিপত্র, ড্রাইভার লাইসেন্স ইত্যাদির কিছুই গ্রহণযোগ্য হয়নি। নাগরিকত্ব প্রমাণ করার জন্য ব্যক্তিকে তাদের দাদার রাজস্ব রেকর্ড কিংবা ভূমির মালিকানা প্রদর্শন করে তারপর তার সাথে তার সম্পর্ক প্রমাণ করতে বলা হয়।

আসামের এনআরসির খবর সংগ্রহে নিয়োজিত প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল বারি মাসুদ বলেন, এটি একটি কঠিন কাজ। তিনি বলেন, স্রেফ দুটি নথির মধ্যে নামের বানানে ভিন্নতার কারণেই অনেককে সন্দেহজনক নাগরিক হিসেবে অভিহিত করে আটক কেন্দ্রে রাখা হচ্ছে। তিনি বলেন, এক ব্যক্তিকে কারাগারে রাখা হয়েছে তার স্কুল ও রাজস্ব কর্মকর্তারা তার মোহাম্মদ নামটি দুটি ভিন্ন বানানে লিখেছিলেন। একজন মোহাম্মদ লিখেছেন ইউ দিয়ে আরেকজন লিখেছেন ও দিয়ে।
এমনকি ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলী আহমদের পরিবারকেও এনআরসি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ সানাউল্লাকে কেবল সন্দেহভাজন কর্মকর্তাই ঘোষণা করা হয়নি, তাকে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে আটকও করা হয়েছিল।

অধিকন্তু, আসামের এনআরসি বাস্তবায়ন করতে ব্যয় হয়েছে ২২৪ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ১৬ বিলিয়ন রুপি)। এতে নিয়োজিত ছিল ৫২ হাজার লোক। অ্যাকাউট্যান্ট রাহুল পান্ডের মতে, ১.৩ বিলিয়ন লোকের জন্য প্রশাসনিক ব্যয়ই হেব ৭ বিলিয়ন ডলার (৫০০ বিলিয়ন রুপি)। তিনি বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন, অন্যান্য ব্যয় আরো বাড়তে পারে।
মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ
নতুন নাগরিক আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারী ৩০ নাগরিক সংস্থার একটির সদস্য তাসলিম রাহমানি বিশ্বাস করেন, হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা ভারতীয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ করছে। তাদের মতে, গত ৭০ বছর ধরে তাদের ক্ষমতায় আসার পথে অন্যতম বাধা হয়ে ছিল মুসলিমেরাই।

ভারতের মোট ৫৪৩টি পার্লামেন্টারি আসনের মধ্যে ১২৫টি আসনে মুসলিমদের হার ১৫ ভাগ বা এর চেয়ে বেশি। এই সংখাটি অনেক নির্বাচনে ফলাফল নির্ধারকে পরিণত হয়।
আসামে মুসলিম জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৩৩.৪ ভাগ। জম্মু ও কাশ্মিরের পর এখানেই তাদের হার সবচেয়ে বেশি। এই রাজ্যের ৯টি জেলায় মুসলিমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।
তিনি বলেন, মোদির ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বে হিন্দু ভোট প্রথমবারের মতো সুসংহত হয়।
বিপর্যয়কর অর্থনীতি ও অন্যান্য কারণে বিজেপির বিরুদ্ধে হিন্দু ভোটারদের একটি অংশের মোহভঙ্গ ঘটেচে। এখন মুসলিমরা যাতে সেক্যুলার হিন্দুদের সাথে জোট গড়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের ক্ষমতাচ্যুত করতে না পারে, সেজন্য তাদের একটি বড় অংশকে রাষ্ট্রহীন করার পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে।
গত কয়েক মাসে হওয়া তিনটি রাজ্য বিধান সভার নির্বাচনে (মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা ও সম্প্রতি ঝাড়খন্ডে) বিজেপি খুবই খারাপ করেছে। অথচ মাত্র সাত মাস আগে তারা পার্লামেন্টে বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল।

শ্রীলঙ্কা, নেপালের সংখ্যালঘুদের বাদ দেয়া

পার্লামেন্টে নতুন আইনটি উপস্থাপনের সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আইনটি প্রণয়নের যুক্তি হিসেবে প্রতিবেশী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের কথা বলেন। তিনি বিশেষ করে পাকিস্তানের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্তির সময় হিন্দুদের সংখ্যা ছিল ২৩ ভাগ। কিন্তু এখন তা নেমে এসেছে ৩.৭ ভাগ। তিনি বলেন, হয় এই লোকদেরকে জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে কিংবা তাদেরকে নির্মূল করা হয়েছে।
কিন্তু পাকিস্তানি আদমশুমারিতে দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানে সংখ্যালঘুরা কখনোই ২৩ ভাগ ছিল না। ১৯৬১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, অমুসলিম জনসংখ্যা ছিল ২.৮৩ ভাগ। এক দশক পর ১৯৭২ সালে অমুসলিম জনসংখ্যা দেখানো হয় মোট জনসংখ্যার ৩.২৫ ভাগ।
অর্থাৎ সেখানে জনসংখ্যা বেড়েছে ০.৪২ ভাগ। ১৯৮১ সালে অমুসলিম জনসংখ্যঅ ছিল ৩.৩ ভাগ। ১৯৯৮ সালের পরবর্তী আদমশুমারিতে মোট জনসংখ্যার মধ্যে অমুসলিমেরা ছিল ৩.৭ ভাগ। পাকিস্তান হিন্দু কাউন্সিলের নেতা রাজা মাঙ্গলানি বিশ্বাস করেন, ২১ কোটি লোকের মধ্যে হিন্দুরা ৪ ভাগ।

আবার বিজেপি ভোটার তালিকা থেকে সরিয়ে রাখতে মুসলিমদেরকে নাগরিকত্ব আইনের বাইরে রাখলেও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্যে তা ব্যাপকভাবে বিরোধিতা করা হয়।
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এসব রাজ্যের নেতারা বিশ্বাস করেন যে এটি আসাম চুক্তির লঙ্ঘন। ১৯৮৫ সালে ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ও আসাম মুভমেন্টের নেতাদের মধ্যে সই হওয়া ওই চুক্তিতে ১৯৭১ সালের আগে আসামে যাওয়া লোকদের ভারতীয় নাগরিকত্ব মঞ্জুরের কথা বলা হয়। কিন্তু নতুন আইনে ভিত্তি বছর করা হয়েছে ২০১৪ সালকে। এটি বিক্ষোভকারীদের কাছে অগ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই শুরু হওয়ার সময় নির্যাতন এড়াতে বিপুলসংখ্যক লোক আসামে গিয়েছিল। ওই সময় ভারত তার সীমান্ত খুলে দিয়েছিল।
একইভাবে দক্ষিণ অঞ্চলে বসবাসরত নেপালের ভারতীয় বংশোদ্ভূত মদেশী হিন্দু লোকজনকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
লেখক : চিফ করেসপন্ডেন্ট, ইংরেজি ডেস্ক, আনাদুলু এজেন্সি; বিশেষজ্ঞ, দক্ষিণ এশিয়া

আনাদুলু এজেন্সি


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us