ব্যাংক খাতের ঝুঁকি

ব্যাংক খাতের ঝুঁকি - ছবি : সংগ্রহ
দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বড় চালিকাশক্তি ব্যাংক খাত। ব্যাংকগুলো গ্রাহককে ঋণ দিয়ে আয় করে থাকে। কিন্তু গ্রাহক যখন ঋণ নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধ করেন না, তখন তা খেলাপি ঋণে পরিণত হয়। এ অবস্থায় ব্যাংকের কোনো আয় তো হয়ই না, অধিকন্তু মূল অর্থই গ্রাহকের হাতে আটকে থাকে। ফলে খেলাপি ঋণে ব্যাংকগুলোর আয় কমে যায়। সৃষ্টি হয় দায়বদ্ধতা। খেলাপি ঋণ ব্যাংকগুলোর গতি আটকে দেয়। বিপুল টাকা থেকে একদিকে ব্যাংক যেমন কোনো ধরনের আয় করতে পারে না, তেমনি ঋণ অনাদায়ী হওয়ায় নতুন কাউকে বিনিয়োগও করতে পারে না। ফলে ব্যাংকের আয় কমে যায়।
বিনিয়োগ কমে যায়। আর্থিক গতিও কমে। অন্য দিকে, এই খেলাপি ঋণের বিপরীতে আয় থেকে প্রভিশন রাখতে হয় বিধায় ব্যাংকের আয়ের বিশাল একটি অংশ খেলাপি ঋণের ঘাটতি মেটাতে ব্যয় করতে হয়। এ ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণের পরিমাণ যদি ব্যাংকের আয়ের সমান হয়; তাহলে আয়ের পুরোটাই প্রভিশন ঘাটতিতে ব্যয় করতে হয়। এ অবস্থায় ব্যাংকের কোনো আয় অবশিষ্ট থাকে না। তা ছাড়া জামানত অতি মূল্যায়ন, বন্ধকি সম্পত্তির দলিলপত্র সংগ্রহে দুর্বলতাও অনেক ক্ষেত্রে ঋণ আদায়ে সমস্যা সৃষ্টি করে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মানবসৃষ্ট দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ঋণগ্রহীতা খেলাপি হতে পারেন। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হচ্ছেন অনেকে। মামলা করেও ঋণ আদায় করা যাচ্ছে না। মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা, সুশাসনের অভাবও বর্তমান সময়ে ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা। খেলাপি ঋণের পরিমাণ যদি ব্যাংকের আয়ের চেয়ে বেশি হয় তা হলে সে ক্ষেত্রে ব্যাংক ক্ষতির অবস্থানে থাকে। ফলে ব্যাংকগুলো আয় করেও তা ভোগ করতে পারে না।
এ অবস্থায় ব্যাংকের অবস্থা দিন দিন নাজুক থেকে নাজুকতর হতে থাকে। খেলাপি ঋণের কারণে সরকারি ব্যাংকগুলোতে বহুদিন থেকেই স্থবিরতা চলছে। একইভাবে বেশ বেসরকারি ব্যাংকগুলোও সমস্যার মধ্যে আটকা পড়েছে। প্রতিটি ব্যাংকই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রভিশন আকারে সংরক্ষণ করে থাকে। এটা করা হয় বিদেশী ঋণদাতা এবং স্থানীয় আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তা বিধানে। কোনো কারণে ব্যাংক যদি প্রদত্ত ঋণের কিস্তি আদায় করতে না পারে, তাহলেও যেন আমানতকারীদের অর্থ এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পাওনা পরিশোধে অসুবিধা না হয় এবং ব্যাংকের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কোনো ধরনের সংশয় সৃষ্টি না হয়, মূলত সে কারণে ব্যাংকগুলো প্রভিশন সংরক্ষণ করে থাকে। সব ধরনের ঋণ হিসাবের বিপরীতেই প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।
ঋণ হিসাবগুলো সাধারণত পাঁচটি বিশেষ শ্রেণীতে ভাগ করা হয়ে থাকে- অশ্রেণীকৃত বা নিয়মিত ঋণ হিসাব, এ ধরনের ঋণ হিসাবের বিপরীতে ১ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট (এসএমএ), এ ধরনের ঋণ হিসাবের বিপরীতে ৫ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। সাবস্ট্যান্ডার্ড লোন হিসাবে ২০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। ডাউটফুল লোন অ্যাকাউন্টে ৫০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয় এবং ব্যাড অ্যান্ড লস ঋণ হিসাবে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। কিন্তু অনেক ব্যাংকই নির্ধারিত হারে প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে। অপরদিকে নিলামের মাধ্যমে বন্ধকিকৃত সম্পদ বিক্রি করাও অনেক সময় সম্ভব হয় না। বন্ধকিকৃত সম্পত্তি বিক্রির জন্য ব্যাংকের পক্ষ থেকে নিলাম আহ্বান করা হলেও তা অধিকারে যেতে পারবেন না মনে করে ক্রেতারা কিনতে কম আগ্রহ দেখান। কোনো ক্রেতা আগ্রহী হলেও তিনি ওই সম্পত্তির জন্য অপেক্ষাকৃত কম মূল্য দিতে চান। ফলে খেলাপি ঋণ যথাযথভাবে আদায় করাটা সম্ভব হয় না। ফলে এর পরিমাণ বাড়তেই থাকে। আবার মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা খেলাপি ঋণ আদায়ের অন্যতম বাধা। গ্রাহকের অযৌক্তিক মামলায় ব্যাংকের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়। এসব মামলা চালাতে অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও ব্যাংকগুলোর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। শুধু অর্থঋণ আদালতে এত মামলার সময়মতো নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না।
ব্যাংক খাতের সমস্যা নিরসনে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। ক্রমবর্ধমান অর্থঋণ মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে অর্থঋণ আদালতের সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। অর্থঋণ মামলার বিপরীতে বিবাদির দায়ের করা রিট দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্ট বিভাগে বেঞ্চ গঠন, আদালতকে বিভ্রান্ত করতে ঋণখেলাপির মিথ্যা তথ্য প্রদানকে একটি অন্যতম অপরাধ হিসেবে পরিগণিত করে, প্রচলিত আইনে শাস্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ব্যাংক কোম্পানি আইন, ব্যাংক জাতীয়করণ অধ্যাদেশ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, অর্থঋণ আদালত আইন, দেউলিয়া-বিষয়ক আইন, ব্যাংকার বহি সাক্ষ্য আইন, সমবায় আইন ও নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুুমেন্ট অ্যাক্টকে বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে গতিশীল করতে আইনের বিভিন্ন বিষয় সংস্কার করা যেতে পারে। জনগনের অর্থ লুণ্ঠনে যুগে যুগে চলে আসা ধারাবাহিক প্রক্রিয়াকে রুখতে না পারলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি বাধাগ্রস্ত হবে।
খেলাপি ঋণের কারণ এবং তা কমিয়ে আনতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সম্প্রতি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ঋণগ্রহীতা নির্বাচনে দুর্বলতা, ঋণের বিপরীতে রক্ষিত জামানতের অপর্যাপ্ততা, অতিমূল্যায়ন ও ঝুঁকি বিশ্লেষণে দুর্বলতা, এক ব্যাংকের অন্য ব্যাংকের খারাপ ঋণ অধিগ্রহণ, চলতি মূলধনের পরিমাণ নির্ধারণ না করা, একাধিক ব্যাংক থেকে চলতি মূলধন গ্রহণ, স্বজনপ্রীতি ও বিভিন্নভাবে প্ররোচিত হয়ে ঋণ প্রদান, শাখা পর্যায়ে ঋণ প্রদানের ক্ষমতা সীমিতকরণ, ঋণ পুনঃতফসিলকরণের সুবিধার অসৎ ব্যবহার খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
ব্যাংক এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যেখানে জনগণ কষ্টার্জিত অর্থ জমা রাখেন যাতে টাকাগুলো নষ্ট না হয়। তাই ব্যাংক খাতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা অতীব জরুরি। আস্থাহীনতার কারণে জনগণ যদি ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে একবার অনীহা প্রকাশ করেন; তাহলে কিন্তু ব্যাংকগুলো ডিপোজিট সমস্যায় পড়বে। ফলে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করতে পারবে না এবং আয় করতে পারবে না। ব্যাংকের বিনিয়োগ বা ঋণপ্রবাহ কমে গেলে দেশের অর্থনীতিই সমস্যায় পড়বে। তাই ব্যাংক খাতে নজরদারি বাড়াতে হবে।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট