ভারতকে বাদ, পাকিস্তানকে গ্রহণ সৌদি আরবের!
প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ও ইমরান খান - ছবি : সংগৃহীত
সৌদি আরব-পাকিস্তান সম্পর্ক পুনঃবিন্যাস করার লক্ষ্যে ২৬ ডিসেম্বর সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান বিন আবদুল্লাহ এক দিনের সফরে পাকিস্তান যান। এতে যা হলো তা এই যে পাকিস্তানকে সন্তুষ্ট করার জন্য আরো কিছু করতে যাচ্ছে সৌদি আরব। মোদি সরকারকে বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে।
গত সেপ্টেম্বরের ঘটনা মনে করিয়ে দিতে হয়। মোদি সরকারের জম্মু ও কাশ্মিরকে ‘একীভূত’ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করার পর সৌদি আরবের অনেকটাই শীতল মনোভাবের কারণে তুরস্ক ও মালয়েশিয়ার সাথে একটি ইসলামি সম্মেলন আহ্বান করার ধারণা গ্রহণ করে পাকিস্তান।
এর জের ধরেই ১৯-২১ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ার রাজধানীতে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান কেএল শীর্ষ সম্মেলন ২০২০ অনুষ্ঠিত হয়। এর বৃহত্তর এজেন্ডা ছিল সমসাময়িক পরিস্থিতিতে মুসলিমবিশ্বের জন্য নতুন পথ সৃষ্টি করা।
স্বাভাবিকভাবেই সৌদি আরবের মনে হয় যে মালিয়েশিয়ার এই উদ্যোগটি উম্মাহয় তার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। সম্মেলনের আগ দিয়ে সৌদি বাদশাহ সালমান নজির সৃষ্টি করে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদকে ফোন করে বলেন যে ইসলামি ইস্যুগুলো নিয়ে কাজ করার যথার্থ ফোরাম হলো ওআইসি।
অধিকন্তু, কেএল শীর্ষ সম্মেলন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে রাজি করাতে সক্ষম হন। এই অতিনাটকীয়তার বিষয়টিই তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যিপ এরদাগান বলেছেন পরে : আমরা দেখতে পাচ্ছি যে দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে সৌদি আরব। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিষয়টি বিবেচনা করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে পাকিস্তানকে। অবশ্য, এর চেয়েও বড় বিষয় হলো, ৪০ লাখ পাকিস্তানি কাজ করে সৌদি আরবে। তাদেরকে হুমকি দেয়া হয়েছে যে এসব পাকিস্তানিকে দেশে ফিরিয়ে দিয়ে এর বদলে বাংলাদেশীদের নিয়োগ করা হবে।
এরদোগানের মতে, অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে পাকিস্তানকে এই হুমকির কাছে নতি স্বীকার করতেই হবেয়ছে। তবে সৌদি আরবের কোনো ধরনের চাপের কথা অস্বীকার করেছে পাকিস্তান।
অবশ্য সৌদিরা ভালোমতোই জানত যে কাশ্মির ইস্যুতে তাদের উদাসীন মনোভাবের প্রভাব পড়বে সৌদি-পাকিস্তান সম্পর্কে চড়াই-উৎরাইয়ের ফলে ইরানের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করছে পাকিস্তান।
আঞ্চলিক রাজনীতির এই সন্ধিক্ষণে সৌদিরা কোনোভাবেই তাদের নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ুক তা চাইবে না। মুসলিম মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্ক-ইরান-কাতার জোট আত্মপ্রকাশ করলে নিশ্চিতভাবেই সৌদি কর্তৃপক্ষের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করবে।
এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানি ভাবাবেগকে আশ্বস্ত করার সবচেয়ে উদার উপহার নিয়ে বৃহস্পতিবার ইসলামাবাদে যান প্রিন্স ফয়সাল। তিনি পাকিস্তানি নেতাদের জানান যে কাশ্মির ইস্যু নিয়ে আলোচনার জন্য ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বিশেষ সভা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাদশাহ সালমান। আর নজিরবিহীন উদারতা প্রদর্শন করা হয় এই বলে যে ওই সভাটি হবে এপ্রিলে ইসলামাবাদে।
সৌদি নেতৃত্ব কি জানতেন না যে বাদশাহ সালমানের সিদ্ধান্তে ভারত দুঃখিত হবে? তা সত্ত্বেও সৌদিরা মনে করেছে, ভারতের চপলতার চেয়ে পাকিস্তানকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে সৌদি আরব।
সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়, এই ঘটনা ভারতীয় কূটনীতি ও মোদি সরকারের পারস্য উপসাগরীয় কৌশলের জন্য একটি বড় বিপর্যয় হিসেবেই দেখা দিয়েছে। সৌদি আরামকোর ৭০ বিলিয়ন ডলারের মেগা পেট্রোক্যামিক্যাল প্লান্টের (প্রথমে রত্নগিরিতে স্থাপনের কথা ছিল) ভবিষ্যত নিয়েও প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে, সিএএর পর ভারতের বর্তমান অবস্থা তাকে মুসলিমবিরোধী হিসেবেই তুলে ধরছে। এর ফলে ভারতের সাথে সম্পর্ক মন্থর করবে সৌদিরা। সর্বোপরি, এর ফলে যে কাশ্মির প্রশ্নের সৌদিরা যে ভারতকে সমর্থন করবে না, তা বলাই বাহুল্য।
এদিকে, সৌদি-ইরান প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পক্ষ নিয়েও মারাত্মক ভুল করেছে মোদি করার। সৌদি আরবের (ও সংযুক্ত আরব আমিরাত) সাথে সম্পর্ক উষ্ণ রাখার বোকামি সিদ্ধান্তের ফলে ইরানের সাথে সম্পর্ক শীতল হয়েছে, তেহরানের সাথে কৌশলগত অংশীদারিত্বকে পেছনে ঠেলে দিয়েছে মোদি সরকার।
এখন সৌদিরা ইউ-টার্ন করায় ভারতকে অবশ্যই ভুল স্বীকারের মনোভাব নিয়ে ইরানের কাছে ছুটতে হবে। কী ভয়াবহ অবস্থা!
এটি দিল্লির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এই নির্বিজতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্বের কথাই প্রকাশ করছে কেবল।
সৌদি আরব ও ইরান- উভয়ের সঙ্গে একইসাথে কিভাবে সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে রাশিয়া, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া বা মালয়েশিয়া? কোনো দেশই অন্য দেশের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করে সৌদি আরব বা ইরানের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করছে না।
সৌদি আরব ঐতিহাসিক পরিবর্তনের পথে রয়েছে। সৌদি আরব কর্তৃপক্ষকে বাস্তব অবস্থার মুখোমুখি করিয়ে দিয়েছে কেএল শীর্ষ সম্মেলন। কেএল শীর্ষ সম্মেলন থেকে যে বার্তাটি এসেছে তা হলো, সৌদি আরব কেবল ইসলামি বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থই হয়নি, সেইসাথে মুসলিম বিশ্ব যখন প্রচণ্ড চাপে রয়েছে, তখন তাদের নেতৃত্ব মানসম্পন্ন হচ্ছে না।
এখানেই প্রধান মুসলিম দেশ পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ মিত্রে পরিণত হয়েছে। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে ইমরান খানের উষ্ণ ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে। প্রিন্স মোহাম্মদ এই সম্পর্ক বজায় রাখতে চান। কাশ্মির ইস্যুতে ভারতের দিকে সৌদি আরব ঝুঁকলেও সৌদি উদ্বেগ উপলব্ধি করে ইমরান খান কেএল সম্মেলন থেকে সরে আসেন ইমরান খান। পাকিস্তান এখনো সৌদি আরবের সাথে তার ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়।
ইসলামাবাদের প্রতি ফয়সালের মিশন কাশ্মির ইস্যুতে পাকিস্তান নেতৃত্বের প্রতি সৌদ সমর্থনই নতুন করে দেয়া হয়েছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) মুসলিমবিশ্বের সাথে ভারতরে সম্পর্কই কেবল জটিল করেছে।
ভারতীয় কূটনীতির সামনে কঠিন সময় আসছে। মোদির আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এবং ক্ষমতায় হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের বিচ্যুতির কারণে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে দোলাচল দেখা যাবে। ফলে নতুন বছরে ভারতকে খারাপ অবস্থায় চলতে হবে।
ইন্ডিয়ান পাঞ্চ