নতুন জোট চীন-রাশিয়া ও ইরানের?

নতুন জোট চীন-রাশিয়া ও ইরানের? - ছবি : সংগৃহীত
চীন, রাশিয়া ও ইরান গত ২৭ ডিসেম্বর ভারত মহাসাগর ও ওমান উপসাগরে যৌথ নৌমহড়া শুরু করে। এই তিন শক্তির মধ্যে এটি নজিরবিহীন সামরিক সহযোগিতা। উল্লেখ্য, এই তিন দেশের সবাই কোনো না কোনোভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী কিংবা শত্রু। সামরিক মহড়াটি নিয়ে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে নানাভাবে। যেহেতু ওমান উপসাগর হরমুজ প্রণালীর সাথে সংযুক্ত, এখান দিয়েই বিশ্বের এক পঞ্চমাংশ তেল পরিবহন করা হয়, কাজেই মহড়াটি এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা বজায় রাখার কজে ব্যবহৃত হওয়ার পাশাপাশি এই বার্তাও দিচ্ছে যে বৈদেশিক ঘটনাপ্রবাহে ইরান বিচ্ছিন্ন নয়। গত বছর যুক্তরাষ্ট্র অযৌক্তিকভাবে নিজেকে ইরানি পরমাণু চুক্ত থেকে সরিয়ে নেয়। এরপর ইরানি অপরিশোধিত তেলের ওপর অবরোধ আরোপ করার পাশাপাশি বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করার পর থেকে ইরানের আশপাশের পানিরাশি আঞ্চলিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
এমন পরিস্থিতিতে এ ধরনের প্রথম আয়োজনে ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র রাশিয়া মহড়ায় তার বাল্টিক বহরের তিনটি রণতরী (একটি ফ্রিগেট, একটি ট্যাঙ্কার ও একটি উদ্ধারকারী ট্যাগ বোট) পাঠায়। আবার বর্তমানে রাশিয়ার সবচেয়ে কৌশলগত অংশীদার চীনও এই খেলায় যোগ দেয়। দেশটি এতে একটি নিয়ন্ত্রিত-ক্ষেপণাস্ত্র ডেস্ট্রোয়ার পাঠায়। সত্য বটে যে যৌথ সামরিক মহড়া অন্য যেকোনো দেশের জন্যই রুটিন বিনিময়। এমনটা আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতির আলোকেই হয়ে থাকে। তবে চীন, রাশিয়া ও ইরানের নৌবাহিনীর মহড়াটি স্বাভাবিক সামরিক সহযোগিতার চেয়েও বেশি কিছু। যদিও চীন দাবি করে আসছে যে আঞ্চলিক পরিস্থিতির সাথে এই যৌথ মহড়ার কোনো সম্পর্ক নেই, কিন্তু এই মহড়ায় জোরালোভাবে ঘোষণা দেয়া হলো যে তিন শক্তির ইচ্ছা করছে ও তাদের সামর্থ্য রয়েছে, যৌথভাবে এই অঞ্চল ও আশপাশের এলাকার শান্তি ও সামুদ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার।
বৃহত্তম দুই ইউরেশিয়ান শক্তি হিসেবে যৌথ নৌমহড়ায় চীন ও রাশিয়ার অংশগ্রহণ যুক্তরাষ্ট্র যে জোট গঠনের পথে রয়েছে সেটা প্রতিরোধের জোট আত্মপ্রকাশের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই মহড়া ও সম্ভাব্য সামরিক সহযোগিতা নিয়ে ইতোমধ্যেই পাশ্চাত্যের কিছু সতর্ক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। মহড়াটি তাদের কাছে এই অঞ্চলের শান্তি ও শক্তির ভারসাম্যের প্রতি হুমকি মনে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা সারা দুনিয়ায় সুবিধাজনক সময়ে যৌথ সামরিক মহড়া আয়োজন করায় এটি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। তাছাড়া জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রথম অনুমোদিত ঘোষণা অনুযায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা সৃষ্টিতে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে ওয়াশিংটন। ইসরাইল ছাড়া বেশির ভাগ দেশই ইরানের ওপর মার্কিন-নেতৃত্বাধীন অবরোধ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, কিংবা এমনকি তাদের অংশগ্রহণ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে। তাদের মতে, এই অবরোধের ফলে এই ভূ-কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় উত্তেজনা বাড়বে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কোনো দায়িত্বশীল দেশই তেলের অবাধ প্রবাহে হস্তক্ষেপ চায় না। অধিকন্তু, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে চীন ও রাশিয়ার সামরিক সম্পর্কের বিষয়টিও গোপন নয়। সৌদি আরবে একটি ড্রোন কারখানা চালু করতে যাচ্ছে চীন। বিষয়টি আর গোপন কিছু নয়। আবার ২০১৭ সালে রাশিয়ায় বাদশাহ সালমানের সফরের পর রিয়াদের সাথে অস্ত্র চুক্তি করছে রাশিয়া। সংযুক্ত আরব আমিরাতে মর্যাদাপূর্ণ অস্ত্র প্রদর্শনীতে চীন ও রাশিয়া উভয়েই অংশগ্রহণ করছে। এসব কারণে তৃতীয় কোনো পক্ষকে কেন্দ্র করে এই তিন দেশের মহড়া অনুষ্ঠিত হচ্ছে, এমনটা মনে করা অদ্ভূত লাগে। আসলে তারা একে স্বাভাবিক কূটনীতি বলেই মনে করছে।
কৌশলগতভাবে চীন ও রাশিয়া এই অঞ্চলে তাদের শক্তির প্রদর্শনী করতে চাচ্ছে কুশলীভাবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পারস্য উপসাগীয় বিরোধে বেইজিং ও মস্কো কোনো পক্ষ নেয়নি, তারা স্থানীয় রাজ্যগুলোর কাছে অস্ত্র বিক্রির পাশাপাশি ইরানের সাথেও যৌথ মহড়ায় অংশ নিচ্ছে। এই বিচক্ষণ নীতির ফলে সম্পর্ক আরো উচ্চতর পর্যায়ে উপনীত হতে পারে। চীন ও রাশিয়া সব পক্ষকে সামরিক শক্তির বদলে রাজনৈতিক উপায়ে বিরোধ মীমাংসায় উৎসাহিত করতে পারে। অবশ্য মস্কো ও বেইজিং উভয়েরই এই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। এই অঞ্চলে নিরাপত্তার ব্যাপারে রাশিয়ার স্বার্থ আছে, চীনের রয়েছে অর্থনৈতিক বিষয়াদি।
উল্লেখ্য, চীন ও রাশিয়া উভয়েই বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে উচ্চপর্যায়ের কৌশলগত অংশীদারিত্ব প্রক্ষেপ করতে চায়। ‘মেরিন সিকিউরিটি বেল্ট’ নামের পরিচিত এই তিন দেশের মহড়ার প্রধান লক্ষ্যই হলো আঞ্চলিক ব্যবস্থা ও ভারসাম্য প্রয়োগ করা। পুরো মহড়াটি এই লক্ষ্যেই চালিত হচ্ছে : সন্ত্রাসী হুমকি দমন, উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা, জলদস্যূদের হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলা। সবাই চাচ্ছে সম্ভব সর্বাত্মক শিক্ষা গ্রহণ করা। সেটি কৌশলগত অঞ্চলগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হতে পারে, সামুদ্রিক উদ্ধার অভিযানও হতে পারে। কারণ কৌশলগত অঞ্চলের নিরাপত্তার দায়দায়িত্ব রয়েছে চীন, রাশিয়া ও ইরানের হাতে। আঞ্চকি ব্যবস্থা রক্ষা ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসঙ্ঘের ১৯৮২ সালের কনভেনশনের সাথে সামঞ্জস্যশীল এই যৌথ মহড়া। ওই কনভেনশন অনুযায়ী রাশিয়া, চীনের সাথে মহড়ায় অংশ নিতেই পারে ইরান। রাশিয়ার মিডিয়াও বলছে যে এই মহড়ায় রাশিয়া, ইরান ও চীনের সম্মিলিত নিরাপত্তা জোরদার হবে। এই তিন দেশ তাদের নিজস্ব নিরাপত্তার জন্য মহড়ায় অংশ নেবে, তাতে দোষের কিছুই নেই।
সংক্ষেপে বলা যায় যে মহড়ার ব্যাপারে চীন, রাশিয়া ও ইরানের নিজস্ব অবস্থানও আছে। ওয়াশিংটনের সর্বোচ্চ চাপ মোকাবিলা করতে চায় তেহরান। নৌমহড়াটি এই যুক্তিই দেবে যে তেহরানকে কূটনৈতিকভাবে বা সামরিকভাবে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। যৌথ মহড়াটি রাশিয়ার সম্মিলিত নিরাপত্তা প্রয়াসের ধারণার সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। আর চীন তার জ্বালানি প্রয়োজনের দিকটি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে। এই অর্থনৈতিক পরাশক্তিটি এই অঞ্চলে কোনো উত্তেজনা সৃষ্টির পরিকল্পনা করেনি। আবার চীনের উন্নয়ন ভণ্ডুল করার মার্কিন পদক্ষেপও বানচাল করতে আগ্রহী বেইজিং।
এই মহড়ায় প্রমাণিত হলো যে ইরান, রাশিয়া ও চীনকে নিঃসঙ্গ করতে ব্যর্থ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই অঞ্চলে এসব দেশের নৌবাহিনীর উপস্থিতি ও প্রভাবে বাধার সৃষ্টি করতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। বরং এই যৌথ মহড়াটি যুক্তরাষ্ট্রকে এই প্রতিভারসাম্যের বার্তাই দেয় যে ২০২০ সালে বা এর পর এই তিন শক্তি প্রয়োজনে এ ধরনের আরো যৌথ নৌমহড়া আয়োজন করতে সক্ষম।
মডার্ন ডিপ্লোমেসি