মনিকা আলীর অজানা কথা
মনিকা আলী - ছবি : সংগ্রহ
মনিকা আলী। তিনি বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক ও ঔপন্যাসিক। ২০০৩ সালে তিনি গ্রান্টা পত্রিকা কর্তৃক ‘বেস্ট অব ইয়ং ব্রিটিশ নভেলিস্ট’ নির্বাচিত হয়েছিলেন তার প্রকাশিত পাণ্ডুলিপির প্রশংসার ওপর ভিত্তি করে। তার প্রথম প্রকাশিত বই বা উপন্যাস ‘ব্রিক লেন’ প্রকাশিত হয় ২০০৩ সালে। তার লেখা আরো তিনটি উপন্যাস ‘এনেল্টোজো ব্লু’ (২০০৬), ‘ইন দ্য চিকেন’ (২০০৯) ও ‘আনটোল্ড স্টোরি’ (২০১১) ব্যাপক প্রশংসা করেছে বিশ্বের সাহিত্যজগতের। ব্রিকলেন মনোনীত হয়েছিল ‘ম্যান বুকার পুরস্কার’-এর জন্য। একই নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছিল ২০০৭ সালে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ব্রিকলেন পাঠক সমাজকে এতটাই নাড়া দিতে পেরেছিল, যে কারণে তার ঘটনাবলি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। সেই চলচ্চিত্রও প্রচুর প্রশংসা পেয়েছে দর্শক-শ্রোতাদের কাছে। মনিকা আলী তার স্বামী ব্যবস্থাপনা পরামর্শক সাইমন টরেন্সের সাথে বসবাস করছেন দক্ষিণ লন্ডনে।
মনিকার জন্ম ১৯৬৭ সলের ২০ অক্টোবর ঢাকা শহরে। তার পিতা বাঙালি আর মা ইংরেজ। পিতার আদি নিবাস ময়মনসিংহ জেলায়। যখন তার পরিবার ইংল্যান্ডের বোল্টন নামক স্থানে চলে আসে, তখন মনিকা প্রায় তিন বছরের শিশু। তিনি প্রাথমিকভাবে ভর্তি হন বোল্টন স্কুলে। পরে পড়াশোনা করেন অক্সফোর্ডের ওয়াডহাম কলেজে দর্শন, রাজনীতি এবং অর্থনীতি বিষয়ে। তিনি মূলত লেখক, ঔপন্যাসিক হিসেবেই বেশি পরিচিত।
লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটের একটি সড়কের নাম ব্রিকলেন, যা অবস্থিত লন্ডনের পূর্ব প্রান্তে। এটি বাংলাদেশের সিলেটি সম্প্রদায়ের প্রাণের শহর। তাদের কাছে এটি পরিচিত বাংলাটাউন বা জালালি টাউন নামে। লেখক পাঠকদের সারিতে মনিকা আলীর জায়গা পাকাপোক্ত হয়ে যায় তার ব্রিকলেন প্রকাশ হওয়ার পরপরই। এ উপন্যাসের প্রশংসা করেছেন বড় বড় লেখক-সমালোচক। আর এ উপন্যাস নিয়ে ব্যাপক আলোচনা প্রকাশ পায় ম্যান বুকার পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় নাম আসার কারণে। তবে এগুলো অনেক বছর আগের কথা। পাঠক সমাজ বলেছে, যার প্রথম উপন্যাস বা লেখা এমন সুন্দর বা নিখুঁতভাবে প্রকাশ পায়, তার এ সংক্রান্ত প্রস্তুতি হয়তো অনেক দিনের। তা সিরিয়াসও বটে! এ ব্যাপারে মনিকা বলেন, আমি যেসব বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করেছি তার মধ্যে সাহিত্যসংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে ছোটবেলা থেকে পড়ালেখার প্রতি আমার খুবই আগ্রহ। সাধ্যের মধ্যে যা পেয়েছি তা-ই পড়েছি ও পড়ি।
তাতে আমি অনেক আনন্দ পাই, অনেক বিষয় সম্বন্ধে কমবেশি জানতেও পারি। তবে লেখক হতে হলে আগে হতে হবে পাঠক। যদিও পাঠকরা আমাকে লেখক হিসেবে খুব বেশি মূল্যায়ন করেন, তবুও বলব, আমি এখনো পাঠক। কারণ, ভালো লেখক হতে চাইলে অনেক জ্ঞান-গুণের অধিকারী হতে হয়। তবে আমার লেখার ভাবনাটা এসেছে পড়তে পড়তেই। লেখালেখির জগতে কিভাবে ঢুকলাম তা বলতে পারব না।
তার ব্রিকলেনের প্রধান চরিত্রের নাম নাজনিন। জন্ম ১৯৬৭ সালে ময়মনসিংহে। তবে এই নাম, জন্ম, স্থান ইত্যাদি আমার কল্পনার, বলেছেন মনিকা। তিনি আরো বলেন, যেহেতু আমার বাবার দেশ বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, সেহেতু আমার অনেক গল্প শোনা হয়েছে সেখানকার মানুষ ও তাদের চার পাশের জগত সম্পর্কে। বাবার মুখে এ সংক্রান্ত গল্প শুনতে শুনতে ব্রিকলেন লেখার অনেক মলমসলা আমি এমনিতেই পেয়ে যাই।
এখানে আরো একটা চরিত্র আছে, যার নাম মাক্কু পাগলা। আমার বাবার বলা গল্পকেচ্ছার একটি চরিত্র এটি। নাজনিন বাংলাদেশে ছিল তার ১৭-১৮ বছর বয়স অবধি। অতঃপর বিয়ের পিঁড়িতে বসে এক বাঙালি (লন্ডন প্রবাসী) লোকের সাথে। বিয়ের পরপর পাড়ি জমান লন্ডনে এবং তা স্থায়ীভাবে। বলতে হয়, এগুলোও আমার বাবার গল্প বলার ফসল বা উপকরণ। মনিকা আলী বলেন, যেহেতু আমার ইংরেজ মা আমার বাঙালি বাবাকে বিয়ে করেন, সেহেতু মা ঢাকায় এসে তার ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে কমবেশি সমস্যায়ই পড়েন। কারণ সবই তার অজানা বা অচেনা। এক জায়গা থেকে ছেড়ে আসা নানা গল্প-কাহিনীর কথা মা বলতেন আমার বাবাকে। তবে তা বলতেন না খারাপ বা নেতিবাচকভাবে। আর এটাই হচ্ছে স্থানচ্যুত বা বিচ্ছিন্ন জীবনের রিয়ালিটি। মা সেই জীবনের নানা সমস্যার কথাও বলতেন আমার বাবাকে। সেসব গল্প বা কথা আমিও (মনিকা) শুনতাম।
তা শুনেও আমার মনের ভেতর দানা বেঁধে যায় নাজনিন নামের সুন্দর চরিত্রটি। আমার মা ঢাকায় আসার পর বর্ণিত যেসব অভিজ্ঞতার বাস্তবমুখী হয়েছেন, লন্ডনে গিয়ে একই ধরনের বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন কেন্দ্রীয় চরিত্র নাজনিনও। ব্রিকলেন উপন্যাসের নানা দিক আমার কল্পনাপ্রসূত বিষয় হলেও কিছু গবেষণা করেছি ব্রিকলেন নামক স্থানটিকে নিয়ে। সেখানকার প্রায় সব জায়গা ঘুরেছি। সেখানকার মানুষের সাথে মিশে তাদের গল্প শুনেছি মন দিয়ে। তার পরও লেখালেখির ক্ষেত্রে আমার প্রধান হাতিয়ার বা অবলম্বনই হলো কল্পনা, চিন্তাভাবনা ইত্যাদি। যেমন সিনেমা বা চলচ্চিত্র বেশির ভাগ সময় তৈরি হতে থাকে লেখকের কল্পনার জগত থেকে। অনেক সময় কল্পনাকে তাই বাস্তব বা প্রাকটিক্যাল মনে হয়।
মনিকা আলীর উপন্যাস ‘এনেন্টোজো ব্লু’ পর্তুগালের প্রামীণ মানুষদের নিয়ে লিখেছেন। সেখানকার নারী-পুরুষের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের প্রণা বিষয় ধরা পড়েছে। এখানে তেরেসা নামের অনূর্ধ্ব ২০ বছরের একটি সুন্দরী মেয়ের কথা বলা হয়েছে। মামারোসা নামক জায়গা থেকে সে অন্যত্র চলে আসে। তার পরিবারের নানা অসঙ্গতির কারণে তিনি বড়ই কষ্ট পাচ্ছিলেন। ভাস্কো, একটি ক্যাপের মালিক। এখানে তার আমেরিকান বধূ এবং বধূর মৃত্যুর কথাও রয়েছে। ভাস্কোও অসুস্থ। কিন্তু ভাস্কো অনেক ক্ষেত্রেই চৌকস বা পটু। একজন ইংরেজ পর্যটক মামারোসাতে একটি সুন্দর নতুন জীবনের কথা কল্পনা করেন। এনেন্টোজো ব্লু’র শুরুর দিকে এক প্রবীণ লোক তার দীর্ঘ এবং অস্থির জীবনের চালচিত্র দেখান।
মনিকা আলীর আরেক উপন্যাস দ্য কিচেন বা রান্নাঘর (২০০৯) অনুসরণ করেছে লন্ডনের একটি রেস্তোরাঁর নির্বাহী শেফ গ্যাব্রিয়েল লাইটফুটকে। এর ভাষা ইংরেজি, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪৩২। লাইটফুট রেস্তোরাঁয় তার রান্না সম্পর্কিত বিষয় সুন্দরভাবে পরিচালনার চেষ্টা করেন। লাইটফুটের উপার্জন কিন্তু ভালোই। উত্তর আয়ারল্যান্ডের একটি শহর থেকে একজন উদ্রোগী গ্যাব্রিয়েল লাইটফুট। ইম্পেরিয়াল হোটেল থেকে নিজের গড়া হোটেলে যাওয়ারও চেষ্টা চালান তিনি। ক্যানসারে আক্রান্ত তার বাবা! সব মিলিয়ে বেশ ব্যস্ত গ্যাব্রিয়েল।
২০১১ সালে মনিকা লেখেন ‘আনটোল্ড স্টোরি’ উপন্যাসটি। এটি ছোট গল্পের সংগ্রহ। এতে বলা আছে, প্রিন্সেস ডায়ানা যদি ১৯৯৭ সালে প্যারিসে গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত না হন তবে তিনি ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন নিজের গায়েব হওয়র বিষয়টি। পাশাপাশি একটি অজ্ঞাত জীবন পরিচালনার চেষ্টা করেছিলেন আমেরিকার একটি ছোট্ট শহরে। প্রিন্সেস ডায়ানাকে লিডিয়া বলা হয়েছে উপন্যাসটিতে। এমনকি চিত্রিত করা হয়েছে কাল্পনিক আকারে একজন ইংরেজি বহিরাগত হিসেবে। ২০১১ সালে খবর হয়েছিল যে, মনিকা আলী চলচ্চিত্রের অধিকারটি বিক্রি করে দিয়েছেন ব্রিটিশ প্রযোজনা সংস্থা ক্লাউড এইট নামক ফিল্মসের কাছে। তা নিয়ে সাহিত্য জগতে অনেক কথাবার্তা চলে। মনিকা আলীর নানা শিল্পকর্মে অবাক হয়ে ব্রিটেন মনিকাকে বেশ কয়েকটি নতুন মডেল হিসেবে ঘোষণা করে। এমনকি তাকে ব্রিটেনের শীর্ষস্থানীয় মহিলা হিসেবেও প্রচার করা হয়। একপর্যায়ে একটি অনলাইন লেখার গ্রুপে যোগ দেন তিনি। তার নাম প্রকাশ পায় ব্রিটিশ তরুণ ঔপন্যাসিকের অনূর্ধ্ব-৪০ এর একটি প্রত্যাশিত তালিকায়। তাকে প্রশংসা করা হয়েছে একবিংশ শতাব্দীর প্রতিভাবান (ব্রিটেনের) নতুন সাহিত্যের কণ্ঠের অভিষেক হিসেবে। মনিকা বলেন, লেখক হিসেবে কোনো কিছুর প্রতিনিধিত্ব করি না আমি। আমি প্রয়োজনীয় জিনিসের প্রতিফলন করেছি প্রতিস্থাপনের জন্য। লেখার ক্ষেত্রে কাউকে সংখ্যালঘু বলাটা ঠিক নয়, যা সৃজনশীল লেখার মধ্যে পড়ে না।
মনিকা আলী লেখার ব্যাপারে বলেন, আমার লিখতে ভালো লাগে বাস্তবধর্মী আঙ্গিকে। আমি দেখেছি, এমন আঙ্গিকে গল্প বলার সময় গল্পের শ্রোতাদের সাথে একাকার হয়ে যাই নিজেও। এভাবে যুক্ত হয়ে যায় পাঠকও। আর তখনই বোঝা যায়, আমরা সঠিক গন্তব্যে যাচ্ছি। সেখানে অনেক কিছুরই সন্ধান মেলে। এগুলো হলো সাফল্য, ব্যর্থতা, হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, হতাশা ইতাদি। এমনো দেখা গেছে, বিভিন্ন সময়ে বা যুগে লেখায় বা সাহিত্যে ঠুনকো এমন কিছু আঙ্গিক ঢুকে পড়ে, যা বেশি দিন পাঠকের অন্তরে লালিত হতে পারে না। কিন্তু আমরা যদি বাস্তবধর্মী বা রিয়ালিস্টিক কোনো কিছু প্রবেশ করাতে পারি তা যুগ যুগ ধরেই পাঠকের মননে নাড়া দেয়। রিয়ালিস্টিক বা বাস্তবধর্মী শৈলীর ক্ষমতা এতটাই প্রবল যে, তা পাঠক-শ্রোতাদের মনে আঘাত করার মতো অবস্থা সৃষ্টি করে। এখানে সাহিত্য শিল্পের সার্থকতা।
তিনি আরো বলেন, অনেক সময় উপন্যাসের মধ্যে কমবেশি নৈতিকতাও খুঁজে পাওয়া যায়। খুঁজে পাওয়া যায় কমবেশি আনন্দ বা বিনোদনও। যদিও এর প্রধান কাজ আনন্দ দেয়া নয়। এখানে শিল্পকর্মে কিংবা ধ্যানগম্য বিষয়ে আত্মনিবিষ্ট হওয়ার অসীম ক্ষমতা। আরেকভাবে বলা যায়, অন্যের আবেগ অনুভূতির সাথে নিজের আবেগ অনুভূতি এক হওয়ার ক্ষমতা। উপন্যাসের কাজ হলো পাঠককে বোধগম্যতার ক্ষেত্রে মনোনিবেশ করানো। তার মানে সংবেদন সঞ্চার করানো। মনিকা আলীর শিল্পকর্মের বাজারও বেশ বড়। এ জন্য তাকে বলা হয় ‘বেস্ট সেলার রাইটার’ বা ভালো বাজার পাওয়া লেখক। তার লেখা অনুবাদ করা হয়েছে প্রায় ২৬টি ভাষায়। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পাঠকদের আগ্রহের কারণেই বিভিন্ন ভাষাভাষীদের জন্যও তার বই ছাপা হয়েছে।
লেখালেখির পাশাপাশি তিনি কাজ করেছেন বিবিসি রেডিও ফোর এর টুডে প্রোগ্রামের অতিথি সম্পাদক হিসেবে। হোস্ট করেছেন শো পয়েন্ট অব ভিউ শোয়ের কয়েকটি সংস্করণ। মনিকা উচ্চাকাঙ্ক্ষী লেখকদের সৃজনশীল লেখালেখির শিক্ষা দেন। তিনি সেন্ট জিলস ট্রাস্ট চ্যারিটির একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তিও। এটি যুক্তরাজ্যের প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের নানাভাবে সাহায্য সহায়তা করে। তিনি নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল লেখার শিক্ষা দেন ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে। তার অধ্যবসায় সম্বন্ধে বলেন, একটু অবসর পেলেই লিখতে বসতাম এবং একবার তা শুরু হলে দীর্ঘ সময় চলত। আমি তখনই লিখতে শুরু করি, যখন আমার মাথায় প্রধান চরিত্রগুলোর আভাস পাই। যারা এতে আগ্রহী তাদের উদ্দেশে বলি, ভালো লেখা তৈরি করতে হলে লেখকের সততা, সাহস ও অধ্যবসায়ের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি যখন পর্তুগালে ছিলাম তখনো অনেক লেখালেখি করেছি। তবে সব কিছুর উপর যে বিষয়, সেটি হলো ভালো পাঠক হওয়া। অর্থাৎ পড়ো, পড়ো আর পড়ো।