৫০ অভ্যাস, ৩৫ ধারণা
৫০ অভ্যাস, ৩৫ ধারণা - ছবি : সংগ্রহ
চার পাশের ঘটনাগুলো শুধু একটি ভাবনার উদ্রেক করে। তা হলো- কিছুই যেন ঠিক নেই। ব্যক্তিগত জীবন, সমাজ জীবন এবং রাষ্ট্রীয় জীবন- কোনোটিই যেন সহজ-সরলভাবে চলতে পারছে না। কেবলই হোঁচট খাচ্ছে, দিক হারিয়ে ফেলছে।
বহু প্রশ্নের মাঝে, ‘কেন এমনটি হচ্ছে’ প্রশ্নটি সবশেষে আসবেই। কে দায়ী এমন ঘটনাগুলোর জন্য হলো আরেকটি প্রধান প্রশ্ন।
অবশ্য এগুলোর জবাব নানাজনে নানাভাবে দিয়েছেন। কিন্তু সব জবাবই অসম্পূর্ণ বলে মনে হয়। কারণ জীবনের বহুমাত্রিকতা, যা বহুমাত্রিক সমস্যার উৎপত্তি ঘটাচ্ছে। এ জন্যই এককভাবে কোনো সমস্যার সমাধান দিচ্ছে না। তবুও মানুষ সুন্দর জীবনের আকাক্সক্ষা করে চেষ্টা করে চলেছে।
অনুসন্ধানী ও বিজ্ঞজনেরা উগ্রতা এবং হিংস্রতাকে সুন্দর জীবনের সবচেয়ে বড় অন্তরায় বা বাধা হিসেবে দেখেন। তাই রাষ্ট্রের সাথে উগ্রতা বা হিংস্রতার কতটুকু সম্পৃক্ততা আছে তার কিছু আলোচনা করা যেতে পারে।
ডান্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর এবং ব্রিটিশ কূটনীতিবিদ ক্রেইগ মারে মাত্র একটি বাক্যে এর উৎস বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, ‘রাষ্ট্রের ক্ষমতা উগ্রতার ওপর পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। (The State vests it Power on a monopoly of violence)। এই বক্তব্যের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ড. মারে বলেছেন, ‘রাষ্ট্র যখন ভালো কাজও করতে যায় যেমন জনগণের স্বাস্থ্যসেবা, তখনো এই উগ্রতার আশ্রয় নেয়। কারণ এই সেবা দেয়ার জন্য ট্যাক্স ইত্যাদি আদায় কতখানি করতে পারেন তার ওপর নির্ভর করে। তখন রাষ্ট্র জোর-ক্ষমতা-উগ্রতার আশ্রয় নেয়। যেমন কোনো নাগরিক ট্যাক্স দিতে অপারগ বা অনিচ্ছুক হলে তাকে গ্রেফতার করা হয় বা জেল দেয়া হয়। ড. মারে বলছেন, ‘এটা উগ্রতা এবং হিংস্রতা’। সাধারণত রাষ্ট্রের এর ব্যবহারকে উগ্রতা বা হিংস্রতা বলা হয় না।
বরং এটা রাষ্ট্রের অধিকার হিসেবে দেখা হয়। অথচ একই কর্মকাণ্ড যদি কোনো ব্যক্তি করে, তখন তাকে উগ্রতা বা হিংস্রতা বলা হয়। তিনি বলেছেন, ‘হাত মুচড়ে অথবা হাতে ধাক্কা দিয়ে কাউকে গ্রেফতার করে জেলে নেয়াও (রাষ্ট্রীয়) সন্ত্রাস।’ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে কখনো সন্ত্রাস বলে চিহ্নিত করতে দেয়া হয় না। অথচ এটা সর্বোচ্চ সন্ত্রাসের অংশ বলে ড. মারে মন্তব্য করেছেন।
তিনি কারারুদ্ধ জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে দেখতে যাওয়ার এক ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছেন। অ্যাসাঞ্জের কারাগারে অবস্থানের অন্যতম কারণ তিনি কিছু সত্য তথ্য প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। তথ্যগুলো সরকার গোপন করে রাখত গোপনীয় বিষয় বলে। অ্যাসাঞ্জ জনগণের জন্য সব ব্যবস্থা জনগণের জানার অধিকার আছে বলে মন্তব্য করেছেন।
ড. মারে তার অনুসন্ধানী নিবন্ধে লিখেছেন, ‘আমরা বেশির ভাগ সময়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে আমলে নিই না। কিন্তু একটি ছোট্ট প্রকোষ্ঠে বছরের পর বছর কাউকে আটকে রাখা সন্ত্রাসের চেয়ে ভয়াবহ।’ মারে দাবি করেছেন, ‘রাষ্ট্র যখন কাউকে বা কোনো নাগরিককে অন্যায়ভাবে এমনিভাবে আটকে রাখে, তা হলো সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাস।’
তিনি লিখেছেন, জুলিয়ানকে কারাগারে দেখতে যাওয়ার কালে তাকে কারাগারের দরজা থেকে (জুলিয়ানের) কারা প্রকোষ্ঠ পর্যন্ত চারবার তার হাতের ছাপ এবং সারা দেহের ইলেকট্রিক স্কানিং তল্লাশির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তার সবচেয়ে ধাক্কা লাগে যখন তিনি জুলিয়ানের সামনাসামনি হন। স্বাস্থ্যবান জুলিয়ান শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। অর্থাৎ তাকে সুস্থ থাকার জন্য ন্যূনতম সহায়তা দেয়া হচ্ছে না। রাষ্ট্র যখন কোনো নাগরিকের বাঁচার জন্য ন্যূনতম অধিকারের ব্যবস্থা করে না, সেটা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। জুলিয়ান রিমান্ডের প্রিজনার হিসেবে তার নিজের কাপড় পরার কথা। কিন্তু যখন তাকে গ্রেফতার করে আনা হয়, তাকে তার নিজের কাপড় আনার সুযোগ দেয়া হয়নি। ফলে কারাগার কর্তৃপক্ষ তাকে তার কাপড় পরতে দেয়ার অনুমতি দিলেও তা সেটা পারছে না কাপড়ের অভাবে। এটাকে তিনি ‘কৌশলে সর্বোচ্চ সন্ত্রাস’ বলেছেন। আরো মন্তব্য করেছেন উন্নত দেশগুলোর এই ব্যবস্থা অন্য সব দেশ বিশেষ করে তৃতীয়-দ্বিতীয় বিশ্ব অনুসরণ করে। ‘এই বেলমার্স কারাগারে এমন ক্ষুদ্র নিম্ন মানসিকতা স্রোতের মতো বয়ে চলেছে’, মারে লিখেছেন।
‘রাষ্ট্র যখন এমন নিম্ন মানসিকতার সন্ত্রাসের প্রয়োজন অনুভব করে এবং তা প্রয়োগ করে তার ওপর, যে কখনো সন্ত্রাসের সাথে যুক্ত নয়, তখন বুঝতে হবে রাষ্ট্র কিভাবে তৈরি হয়েছে’, ড. মারে মন্তব্য করেন। আসলে এ দৃশ্য বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত প্রকট বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
ড. মারে বলেছেন, “এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে যদি কেউ প্রতিরোধ করে সন্ত্রাসের আশ্রয় নেয় তখন তাকে সন্ত্রাস বলা যাবে না।’ ‘কারণ বেঁচে থাকার জন্য এবং নিশ্চিত জীবনের জন্য প্রত্যেকের অধিকার আছে”, ড. মারে মন্তব্য করেন।
অবশ্য আরেকটি উল্লেখযোগ্য মন্তব্য হলো, “রাষ্ট্রের এই সন্ত্রাসের একচ্ছত্র অধিকার অনেকাংশে প্রয়োজনীয় হলেও, এর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার জনগণ গ্রহণ করে না। ফলে প্রতিরোধ সৃষ্টি হয় এবং এটা কখনো কখনো বিশাল সন্ত্রাসের সৃষ্টি করে। এর মাঝ দিয়ে নতুন রাষ্ট্রেরও সৃষ্টি হয় বা স্বাধীনতা আসে। তখন ওই বিশাল মৃত্যুগুলোর প্রশংসা হয়, কিন্তু যারা মৃত্যুবরণ করল বা এ মৃত্যুর জন্য পরিবারগুলো বা তাদের কাছের মানুষগুলোর ক্ষতি হলো তাদের খোঁজ রাখা হয় না। বরং এটা স্মৃতির আড়ালে চলে যায়। কখনো কখনো তা জোর করে আড়ালে পাঠিয়ে দেয়া হয়।”
তার আরেকটি মন্তব্য উন্নত দেশগুলোর জন্য হলেও তা সর্বত্র সবাই অনুসরণ করছে। এর উদাহরণ হিসেবে সাম্প্রতিককালে হংকং প্রতিবাদের কথা বলা হয়েছে। হংকংয়ে পুলিশ শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদী জমায়েতের ওপর গুলি চালালে প্রতিবাদীরা পুলিশের ওপর বোমা নিক্ষেপ করে। ড. মারে বলেন, ‘এটা আত্মরক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা এবং তার সমর্থন তিনি করেন।’ ‘আসলে জনগণের প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ রাষ্ট্রের সন্ত্রাস করার একচ্ছত্র অধিকারকে অস্বীকার করার চেষ্টা মাত্র। হংকং প্রতিবাদ ছিল রাষ্ট্রের জনগণের শরীরের ওপর অধিকার স্থাপনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং এমনটি সারা বিশ্বে ঘটছে’ বলে তিনি মন্তব্য করেন। তার আরেকটি মন্তব্য এখন সর্বজনীন। এখন সর্বত্র যে রাজনীতির অনুসরণ হচ্ছে সেখানে সেখানে রাজনীতির আসল ভিত্তিকে অস্বীকার করা হচ্ছে। ভিত্তি হলো (রাজনীতির) সব কিছুতেই জনগণের সম্মতি থাকা। এর ফলে জনগণের বৃহৎ অংশ সরকারের বেশির ভাগ কর্মকাণ্ডে সমর্থন থাকে না। তাই নানা সামাজিক অশান্তি বিরাজ করে।
এখন ধনী-দরিদ্রের পার্থক্যকে রাষ্ট্রীয়ভাবে আড়াল করার চেষ্টা চলে অবিরত। নানা কর্মকাণ্ডের মাঝ দিয়ে জনগণের বৃহদংশের দৃষ্টিকে ফিরিয়ে রাখা হয়। এর প্রধান কারণ আজকের দিনে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আকার সহজেই যেমন বিশাল করা সম্ভব, তেমনি এটা দমন করাও সহজ- সবই প্রযুক্তির ব্যাপকতার কারণে। অবস্থা যাই হোক, মানুষের অবস্থানে কোনো উন্নতি আসছে না। এর মূলে আছে পরাশক্তি এবং ক্ষমতাবান রাষ্ট্রগুলো। তারা বিশ্বকে যেন ভাগাভাগি করে তাদের প্রভাবের বলয় সৃষ্টি করেছে। লেখক ম্যাথিউ হোয়াইট তার বহুল পঠিত অ্যাট্রোসাইটোলজি (হিংস্র মানসিকতা) বইতে বলেছেন, গত ১৫০ বছরে অন্তত ১০০টি মহা রক্তপাত ঘটেছে। সবই দখলদারিত্ব নিয়ে। বিশেষ করে ‘খ্রিষ্টানভোম’ (খ্রিষ্টান অধ্যুষিত স্থান) তীব্রভাবে ইসলামের উদ্ভবকে ঠেকাতে যায়। তারা ইসলামকে আরেকটি জীবনব্যবস্থা বা মতবাদ হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি ছিল না। ফলে এই রক্তপাতের ঘটনার শুরু হয়ে আজো নানা নামে এবং ঢংয়ে বিরাজ করছে। ইসলামের আইনে বিরাজিত ‘জিহাদ’ শব্দটিকে বেছে নিয়ে তারা তাদের সশস্ত্র অবরোধ এবং প্রতিরোধ শুরু করে। তারা বিশ্বে তাদের বিস্তারের যে ভয়াবহ রক্তপাতের ইতিহাস রচনা করে, তা তারা ভুলে যায়।
তা হলে এই সঙ্কট উত্তরণের উপায় কী? জবাবটি অবশ্যই জটিল এবং বহুমাত্রিক। এর জন্য যেমন সামষ্টিক চেষ্টার প্রয়োজন হবে, তেমনি ব্যক্তিগত প্রচেষ্টাও হবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে সর্বাগ্রে প্রয়োজন হবে সহনশীলতার আবহাওয়া। ক্ষমতাবানদের এটা প্রদর্শন করতে হবে সর্বাগ্রে।
যেহেতু তেমনটির দর্শন মিলছে না, তাই সঙ্কট সমাধানের প্রথম পদক্ষেপেই বাধা পড়ছে। অথচ এ সঙ্কট নিরসন হতে হবেই। ডিজিটাল মার্কেটিং কোম্পানি প্রধান আইভান ডিমিট্রিজেভিক ৫০টি ধারণা দিয়েছেন কেমনভাবে এই একবিংশ শতাব্দীতে চলতে হবে নিজেকে এবং সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেখানে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। যেমন সুস্থ থাকার জন্য খাবারের ওপর নজর দিতে হবে, ইচ্ছাপূর্বক কোনো কাজ ফেলে রাখা যাবে না, নতুন নতুন মানুষের সাথে মিলতে হবে; সর্বদা পরিবর্তনের চেষ্টা করতে হবে এবং তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে; আয় বৃদ্ধির চেষ্টা করতে হবে; সর্বদা বিনয়ী থাকার চেষ্টা করতে হবে, সুখী হওয়ার চেষ্টায় উদ্বেগমুক্ত হওয়ার চেষ্টায় থাকতে হবে; নিজের জীবন নিয়েই সুখী থাকতে হবে; ভালো ঘুম হতে হবে; ধূমপান ছাড়তে হবে; পরিচ্ছদের প্রতি নজর দিতে হবে; গুছিয়ে চলতে হবে; কারো বিরুদ্ধে ঈর্ষা-বিদ্বেষ পোষণ করা যাবে না; প্রয়োজনে শখের পেশাকে (hobby) পেশায় পরিবর্তিত করতে হবে; লেখালেখির অভ্যাস করতে হবে; আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এমন পঞ্চাশটি অভ্যাস সুন্দর জীবন নির্মাণ সহজ করে। এর সাথে কেট রকউড দিয়েছেন ৩৫টি ধারণা, যা এই সুন্দর জীবনকে চলমান রাখবে। যেমন, খাবারে লেবুর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে; সবজি প্রতিদিন থাকবে, গাছ-গাছড়ার প্রতি নজর দিতে হবে; একবারে একটি কাজই করতে হবে অনেকগুলো নয়; ধ্যানের অভ্যাস করতে হবে; ব্যায়ামের অভ্যাস করতে হবে; পুরনো কাপড় দান করতে হবে; দরকারে নিজের নিকট লিখতে হবে বিশেষ বিষয় মনে রাখতে; ফোনে সময় নষ্ট করা যাবে না; স্বামী বা স্ত্রীকে সময় দিতে হবে এবং সব শেষে নিজেকে কখনো কখনো ধন্যবাদ দিতে হবে কাজ সুসম্পন্ন করার পর এবং এমন ধন্যবাদে কাউকে অংশীদার করার প্রয়োজন নেই।
আসলে সুন্দর সুস্থ জীবনের সম্ভবত প্রধান প্রয়োজন নিজের প্রতি সত্যবাদী থাকা এবং অপরের ক্ষতির চিন্তা না করা। এমন মানুষেরা সমাজকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করে এবং পরিবারকে সুস্থ এবং আকর্ষণীয় করে তোলে।