প্রতিরোধ করছেন সাহসী মমতা
মমতা - ছবি : সংগৃহীত
গত নভেম্বরে বিজেপি যখন পশ্চিমবঙ্গের তিনটি উপনির্বাচনের সব কটিতেই হেরে গেল, তখন দলটির রাজ্য শাখার সভাপতি দিলিপ ঘোষ এর জন্য জাতীয় নাগরিকপঞ্জিকে (এনআরসি) দায়ী করেছিলেন। দলের অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো স্বীকার করেছিল যে আসামের হালনাগাদ করা এনআরসিতে ১৬ লাখের বেশি বাঙালি হিন্দু ও মুসলিমকে বাদ দেয়ার ঘটনাটি রাজ্যে দলের ভাগ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে।
দিলিপ ঘোষ যে খড়গপুর টাউনের আসনে ২০১৬ সালের রাজ্য নির্বাচনে সহজেই জয়ী হয়েছিলেন, এবং ২০১৯ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ৪৫ হাজার ভোটে জয়ী হয়েছিলেন, সেখানে উপনির্বাচনে বিজেপির প্রার্থী ২১ হাজারের বেশি ভোটে পরাজিত হয়েছেন। তবে পশ্চিমবঙ্গের নেতারা এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি এ কারণে যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ পার্লামেন্টে জোরালোভাবে জানান যে সর্বভারতীয় এনআরসি ‘অনিবার্য।‘
তবে সর্বভারতীয় এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (উভয়টি বিজেপির বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় উভয় সভায় পাস হয়েছে) বিরুদ্ধে সারা দেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ায়, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে, ফাঁকাবুলি ও বুক চাপড়ানোর জন্য খ্যাতিমান বিজেপি নেতারা মনে হচ্ছে সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়েছেন। আর এটিই দিলিপ ঘোষকে কথা বলার সাহস দিয়েছে।
এনআরসির ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি হিন্দুকে বলেন, কখন তা হবে এবং কী হবে তা ভবিষ্যতের ব্যাপার।
এনআরসি হলো ভারতে বসবাসরত নথিহীন অভিবাসী ও প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের একটি প্রক্রিয়া। দিলিপ ঘোষের মন্তব্যটি তার আগেরকার অবস্থান থেকে একটি বিশাল ইউ-টার্ন মনে হচ্ছে। আগে তিনি বিজেপির জাতীয় নেতাদের মতোই বলে চলেছিলেন যে পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি অনিবার্য এবং ভারতের অন্যান্য অংশেরমতো এখানেও দলটি আগ্রাসীভাবে প্রচারণা চালাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে দিলিপ ঘোষ এনআরসির জন্য সাবেক কংগ্রেসী প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে দায়ী করছেন।
দিলিপ ঘোষ বলেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আসামে এনআরসি বাস্তবায়িত হচ্ছে। রাজীব গান্ধী এনআরসি করার জন্য চুক্তি করেছিলেন। বিজেপি এ নিয়ে চুক্তি করেনি, দলটি বিষয়টি আদালতে উত্থাপন করেছে। আদালতের নির্দেশের আলোকে আসামে তা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এটা পরিষ্কার করা দরকার।
দিলিপ ঘোষ বলেন, প্রয়োজন হলে দেশব্যাপী এনআরসি করার কথা বলবে কেন্দ্রীয় সরকার। তবে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের ব্যাপারে তিনি বলেন, পার্লামেন্টে যেভাবে পাস হয়েছে, তার আলোকে ভারতের অন্যান্য অংশের মতো পশ্চিমবঙ্গেও তা বাস্তবায়িত হবে।
দিলিপ ঘোষের এই মন্তব্যের মাত্র কয়েক দিন আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ উভয়েই দেশব্যাপী এনআরসি নিয়ে কথা বলতে অস্বীকার করেন এমনভাবে যে তারা কখনো এ নিয়ে কিছু বলেননি। সামাজিক মিডিয়াজুড়ে মোদি-শাহ জুটিকে নিয়ে কৌতূক করা হচ্ছে, এক নেটিজেন মোদিকে বলেছেন, ‘চা বিক্রি করতে করুন, দেশ নয়’।
চলতি সপ্তাহে মন্ত্রিসভায় এনআরপির জন্য ৩৯০০ কোটি রুপি অনুমোদনের পর অমিত শাহ দাবি করেন, এনআরসি ও জাতীয় জনসংখ্যা নিবন্ধনের (এনপিআর) মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। তবে অনেকে বলছেন, এটি হতে এনআরসির প্রস্তুতিমূলক বিষয়। এমনকি ‘সেন্সাস অব ইন্ডিয়ায়’ এনপিআর সম্পর্কে বলা হয়েছে, এটি হলো এনআরসি করার প্রথম পদক্ষেপ।‘
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছেন যে তার সরকার এনআরসি, সিএএ ও এনপিআর- তিনটির বাস্তবায়নই বন্ধ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। রাজপথে লড়াকু রাজনীতির সহজাত আন্দোলনকারী মমতা রাজ্যে বিশাল বিশাল সমাবেশ ও মিছিল করে যাচ্ছেন। বৃহত্তম মিছিলটি তিনি করার পরিকল্পনা করছেন ৩০ ডিসেম্বর সিলিগুড়িতে। উত্তরবঙ্গে তার সমর্থন জোগাড় করতেই এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তিনি। পার্লামেন্ট নির্বাচনে তিনি ৮টির মধ্যে ৭টিতেই হেরে গেছেন। পাল্টা আঘাত আনতে মমতা বিজেপি শিবিরে হতচকিত অবস্থা ও অনিশ্চয়তাকে ব্যবহার করে হারানো ভূমি পুনরুদ্ধার করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
নার্ভাস হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে বিজেপির, যদিও তারা ২০১৯ সালের গ্রীস্মে পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিপুল জয় পেয়েছিল। মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ডে সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হওয়ার পর বিজেপি অবশ্য মাত্র তিনটি বড় রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পেরেছে। এগুলো হলো উত্তর প্রদেশ, গুজরাট ও কর্নাটক। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের পর বিজেপি ৫টি রাজ্যে হেরেছে। এগুলো হলো মধ্য প্রদেশ, রাজস্তান, ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খন্ড।
পার্লামেন্টে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে পাস করা হলেও অনেক কম রাজ্যে নিয়ন্ত্রণ থাকায় নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (বিরোধীরা একে ‘ভারতীয় সংবিধানের আত্মার ওপর সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে) মতো বিতর্কিত ব্যবস্থাগুলো বাস্তবায়ন কঠিন হবে।
মোদি ও তার দলের বিপুল চাপ সত্ত্বেও মার্ক্সসবাদী-শাসিত কেরালা, কংগ্রেস-মাসিত পাঞ্জাব, ছত্তিশগড়, মধ্য প্রদেশ, মমতার পশ্চিমবঙ্গসহ বেশ কয়েকটি রাজ্য সরকার বলেছে, তারা সিএএ বাস্তবায়ন করবে না। মোদি এমনকি মমতাকে অ্যাডভোকেট জেনারেলের পরামর্শ নিতে বলেছেন। তার মতে, এটি হলো কেন্দ্রের এখতিয়ারাধীন বিষয়। ফলে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে পাস হওয়া আইনটি রাজ্যে বাস্তবায়ন করতেই হবে। কিন্তু অনড় মমতা বলেছেন, সিএএ বা এনআরসি বাস্তবায়ন করা যাবে কেবল তার মৃতদেহের ওপর দিয়ে।
এনআরসি-সিএএ ভারতের বিরোধীদলগুলোকে বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার অজুহাত তুলে দিয়েছে। কাশ্মিরে তারা ঐক্যবদ্ধ হতে না পারলেও এবার তারা ‘দেশবিরোধী’ তকমা না লাগিয়েই তা করতে পারবে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভ তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে সূচিত এই আন্দোলন প্রায় ২৫টি ক্যাম্পাসে দেখা গেছে। পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের বিক্ষোভের মুখে চ্যান্সেলর ও গভর্নর জগদীপ ধনকরকে বার্ষিক কনভোকেশনে সভাপতিত্ব থেকে বিরত রাখে। ছাত্ররা বলে যে তিনি চ্যান্সেলর নন, বরং বিজেপির এজেন্ট। এমনকি ছাত্ররা এই ব্যাজ পরে ডিগ্রি গ্রহণ করে যে ‘নো এনআরসি, নো সিএএ, নো এনপিআর।‘
মোদির ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার সময় তাকে ভারতের তরুণদের আইকন হিসেবে দেখা হয়েছিল। ‘জেন নেক্সট’ ভোটে তাকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে। অর্থনীতির বিপুল পতন, চাকরির বাজার কঠিন হওয়ায় তরুণ ভারত আর মোদির প্রতিশ্রুতির ওপর ভরসা করতে পারছে না। সাম্প্রতিক বিক্ষোভের সময় পুলিশের কঠিন পদক্ষেপ জরুরি আইনের স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে, বিরোধীদের উদ্দীপ্ত করার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। তবে বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না, বিজেপিকে উৎখাত করা অনেক দূরের বিষয়। অমিত শাহ দিল্লির ‘তুকদে-তুকদে’ গ্যাংকে (গেরুয়ারা বামপন্থী সেক্যুরার বুদ্ধিজীবীদের এভাবেই অভিহিত করে থাকে) ‘শিক্ষা দেয়ার’ হুমকি দিয়েছেন। বিজেপির মন্ত্রীরা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন যে ডানপন্থী রাজপথের শক্তি দিয়ে বিক্ষোভ ‘এক ঘণ্টার মধ্যে হাওয়া’ করে দেয়া হবে।
তবে জাতির ভাবসাবে স্পষ্টভাবেই এমনকিছু দেখা যাচ্ছে, যার ফলে মোদি ও শাহকে বিক্ষোভকারীদের ওপর সহিংস গেরুয়া ব্রিগেডকে লেলিয়ে দেয়া থেকে বিরত রেখেছে। আবারো বলা প্রয়োজন, অর্ধ ডজনেরও বেশি রাজ্যে বিজেপির নিয়ন্ত্রণ না থাকায় মোদি ও অমিত শাহের বিকল্প সীমিত করে ফেলেছে।