মোদি-শাহ জুটির দম শেষ!
মোদি-শাহ জুটি - ছবি : সংগৃহীত
ঝাড়খন্ড রাজ্য বিধান সভার নির্বাচনী ফলাফলের নীতিকথা দিবালোকের মতো পরিষ্কার : আরেকটি রাজ্যে বিজেপির পরাজয়। গত এক বছরে বিজেপি হলো ৫ম রাজ্য, যেখানে বিরোধীদলের কাছে হেরেছে বিজেপি। প্রধানত কংগ্রেসের কাছেই তারা এছাড়া মধ্য প্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্তান ও মহারাষ্ট্রে হেরেছে।
বিজেপি হরিয়ানায়ও হেরেছিল, কিন্তু তবুও তারা সরকার গঠন করতে পেরেছিল দুশিয়ান্ত চৌতালার কেবল উপমুখ্যমন্ত্রীই নয় , তার বাবা ওম প্রকাশ চৌতালাকে প্যারোলে কারাগার থেকে বের করার জন্য বিজেপির পোশাক পরতে হয়েছিল।
ঝাড়খন্ডে প্রাক-নির্বাচনী জোট- ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চা (জেএমএম), কংগ্রেস ও রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) পরাজিত করে বিজেপিকে। ভোট গণনার সময় অবস্থা বেগতিক দেখে বিজেপি অন্তত ৩০টির বেশি আসন আশা করেছিল। ওই সংখ্যক আসন পেলেই তারা অন্য ছোট ছোট দলের সাথে মিলে সরকার গঠন করতে পারবে বলে আশা করেছিল। তারা এজন্য দলগুলোকে দ্রুত ফোনও করেছিল। কিন্তু দুপুরের পরও তারা আশা ছাড়েনি। বিজেপি নেতা ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অর্জুন মুন্ডা ইঙ্গিত দেন যে সুদেশ মাহতোর নেতৃত্বাধীন অল ঝাড়খন্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (এজেএসইউ) ও বাবুলাল মারান্দির নেতৃত্বাধীন ঝাড়খন্ড বিকাশ মোর্চার (জেভিএম) সমর্থন নিয়ে তারা সরকারে থাকতে পারবে।
কিন্তু দিন যতই গড়াতে থাকে, ততই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বিজেপি একক বৃহত্তম দলের মর্যাদা হারাচ্ছে, তাদেরকে দ্বিতীয় বৃহত্তম হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। জেএমএম একক বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ফলে মহারাষ্ট্রের মতো করে গভর্নরের আশীর্বাদ নিয়ে সরকার গঠনের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়। সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী রঘুবার দাস পরাজয় স্বীকার করে নেন।
মজার ব্যাপার হলো রঘুবার নিজেও জমশেদপুর ইস্ট আসনে পরাজিত হয়েছেন। এই আসনে তিনি ১৯৯৫ সাল থেকে জয়ী হয়ে আসছিলেন। সেখানে তিনি তার নিজ দলের বিদ্রোহী প্রার্থী সূর্য রাইয়ের কাছে হেরে গেছেন। আরো বড় খবর হলো, ঝাড়খন্ডে এখন পর্যন্ত কোনো মুখ্যমন্ত্রী টানা দ্বিতীয়বার জয়ী হননি।
ঝাড়খন্ডের ফলাফল ছিল বিজেপির জন্য একটি নির্বাচনী বিপর্যয়। ছত্তিশগড়ের রমন সিংয়ের মতে, রঘুবর দাস তার ঔদ্ধত্য ও আত্মপ্রসাদের কারণে কেবল জনগণের কাছ থেকেই নয়, তর দলের কর্মী ও রাজ্যের নেতাদের কাছ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিরেন। তিনি কেবল নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহের কথাই শুনতেন, অন্য কারো পরোয়া করতেন না।
ঝাড়খন্ডের নির্বাচনী ফলাফলে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। সবচেয়ে বড় ও তাৎক্ষণিক প্রভাব হলো এই যে এই পরাজয় মোদি-শাহ জুটির সর্বশেষ পদক্ষেপের (নাগরিকত্ব সংশোধনী অ্যাক্ট, সিএএ ও জাতীয় নাগরিক পঞ্জি- এনআরসি) ওপর প্রশ্নবোধক চিহ্ন সৃষ্টি করেছে।
উদাহরণ হলো বিজেপির সদ্য সাবেক মিত্র শিব সেনার কঠোর মন্তব্য। শিব সেনা বলেছে, ঝাড়খন্ডের ফলাফল প্রমাণ করে যে জনগণ আর অমিত শাহের নেতৃত্বাধীন দলের জাতীয় নাগরিক পঞ্জির মতো আবেগপ্রবণ ইস্যুগুলোভিত্তিক রাজনীতি গিলতে চায় না। সেনার মুখপাত্র মনীষা কায়ান্দে আরেকটু এগিয়ে বলেন, এই ফলাফলে এই প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে যে জনগণ এখন অমিত শাহের নেতৃত্বাধীন দলকে বিশ্বাস করে কি না।
তিনি বলেন, বিজেপি আগে জনগণকে বলত যে তারা উন্নয়নের রাজনীতি করবে, কিন্তু এখন তারা প্রকৃত ইস্যুগুলোর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে আবেগগত ইস্যুগুলোতে জনগণকে সম্পৃক্ত করে রেখেছে।
শিব সেনার মৌখিক আক্রমণ আমাদের এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের দিকে নিয়ে যায় যে সিএএ ও এনআরসি বিজেপির জন্য বুমেরাং হচ্ছে কিনা? তেমনই মনে হচ্ছে।
অধিকন্তু, মাত্র কয়েক দিন আগে রাজ্য সভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস করতে সক্ষম হওয়ার পর বিজেপি মনে হচ্ছে এখন ক্রমবর্ধমান হারে নিজেকে মিত্রদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।
এখন মিত্ররা সিএএ/এনআরসি ইস্যু নিয়ে নতুন করে ভাবতে পারে। এ ধরনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে বিহার থেকে। সেখানে বিধান সভার নির্বাচনের বাকি আছে ১০ মাসেরও কম। ক্ষমতাসীন জনতা দলের (ইউনাইটেড) নেতা ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতিশ কুমার নিজেকে সিএএ ও এনআরসি প্রশ্নে বিজেপি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন।
পরপর দুটি নির্বাচনে বিজেপির পরাজয়ে মোদি-শাহ জুটির জন্য সতর্কঘণ্টা বেজে গেছে। তাদের উভয়েই ঝাড়খন্ডে জয়ী হওয়ার জন্য কোনো চেষ্টা বাকি রাখেননি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রচারণার শেষ দিনে ৯টি সভায় বক্তৃতা করেছেন। বিজেপির জয় নিশ্চিত করার জন্য অমিত শাহ ব্যক্তিগতভাবে বেশ কয়েক দিন ধরে ঝাড়খন্ডে পড়ে ছিলেন।
এখন অবস্থা যখন খারাপ হয়ে গেছে, তখন মোদি ও শাহ নিজেদের বেশ কঠিন অবস্থায় দেখতে পাচ্ছেন। মোদি কি এখন তাহলে অমিত শাহকে দলের কাজে পাঠানোর জন্য তাকে সরকার থেকে সরিয়ে দেবেন, যাতে তিনি পুরো সময় দলের কাজে নিয়োজিত থাকতে পারেন, যা তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে করতে পারছেন না? এই প্রশ্নের জবাবের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
আরেকটি বিষয় হলো, ঝাড়খন্ডের নির্বাচনে বিজেপির পরাজয়ের ফলে দিল্লি ও বিহারের আসন্ন নির্বাচনে জয়ী হতে বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ করতে ও সম্ভাবনা বাড়াতে কাজ করবে। আম আদমি পার্টির (এএপি) নেতা ও দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে অবশ্যই ঝাড়খন্ডের ফলাফল দেখার পর হাসতেই হবে।
নিতিশ কুমার অবশ্যই মোদি ও শাহের পর বর্তমান ভারতের তৃতীয় সবচেয়ে উদ্বিগ্ন লোক। তিনি জানেন যে প্রতিবেশী ঝাড়খন্ডে জনগণের মনোভাবে ব্যাপকভাবে বদলে গেছে।
লেখক : দিল্লিভিত্তিক কলামনিস্ট, রাজনৈতিক বিশ্লেষক