আফগানিস্তান : আমেরিকার আরেক ভিয়েতনাম!
আফগানিস্তান : আমেরিকার আরেক ভিয়েতনাম! - ছবি : সংগ্রহ
আফগান যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটানোর জন্য তিন মাস বিরতির পর সম্প্রতি দোহায় যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানদের মধ্যে পুনরায় আলোচনা শুরু হয়েছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রামের আফগানিস্তানে থ্যাঙ্কস গিভিং ভিজিটের সময় আকস্মিক ঘোষণার মাধ্যমে এই আলোচনা পুনরায় শুরু হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবশ্য একই সময়ে তালেবানদের সাথে পুনরায় যুদ্ধবিরতিরও আহ্বান জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, আলোচনা স্থগিত থাকা অবস্থায় উভয় পক্ষই অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছিল।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানদের মধ্যকার আলোচনা আকস্মিকভাবে যখন বন্ধ ঘোষণা করছিলেন, তখন মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যাপারে দু’পক্ষই একটি চুক্তি স্বাক্ষরের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে পৌঁছেছিল। আমেরিকা এবং তার মিত্রদের বিরুদ্ধে আফগান ভূখণ্ডকে জঙ্গিবাদী তৎপরতায় ব্যবহার না করার ব্যাপারে তালেবানদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায়ের মাধ্যমে এই চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। শান্তি চুক্তির জন্য এ ধরনের প্রতিশ্রুতি বা নিশ্চয়তার বিষয়টি মেনে নেয়ার প্রকৃত অর্থ হলো- আমেরিকানরা স্বীকার করে নিলো যে, আফগানিস্তান তালেবানদেরই।
চুক্তি স্বাক্ষর স্থগিত থাকা সত্ত্বে¡ও কাবুলে নিযুক্ত মার্কিন সেনা কমান্ডার অস্টিন মিলার জানিয়েছিলেন, গত ১২ মাসে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে দুই হাজার সৈন্য সরিয়ে নিয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপার বলেছেন, তালেবানদের সাথে শান্তি চুক্তি হোক বা না হোক প্রায় চার হাজার সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এটাই পরিষ্কার হয়ে গেল যে, ওই এলাকার জন্য আমেরিকা যে কৌশল গ্রহণ করেছে, তাতেই সৈন্য হ্রাস করার বিষয়টি রয়েছে। আমেরিকার এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের আরো একটি কারণ হতে পারে তালেবানদের সাথে যেকোনো চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে বর্তমান আফগান সরকারের বিরোধিতার অবসান ঘটানো। এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আমেরিকা আফগানিস্তানের বর্তমান সরকারকে অনেকটা চাপের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এর মাধ্যমে আমেরিকা সুস্পষ্টভাবে একটি বার্তা দিতে চায় : ওয়াশিংটন আফগানিস্তানে তার সামরিক অবস্থানের পরিসমাপ্তি ঘটাতে চায় এবং কাবুলের দেয়ালের লিখন দেখা উচিত। এ ছাড়াও ওয়াশিংটন হয়তো মনে করছে, তাদের এই সিদ্ধান্তের ফলে শান্তিচুক্তির ব্যাপারে একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হবে। এতে আফগান সরকার এবং তালেবান উভয়ে লাভবান হবে। এদিকে, আমেরিকার সাবেক সিনিয়র কূটনীতিকরা হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, ‘সত্যিকারের শান্তিচুক্তির আগে আমেরিকার বেশির ভাগ সৈন্য সরিয়ে নেয় উচিত হবে না।’ তারা মনে করেন, অকালে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করা হলে আফগানিস্তানে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে এবং এতে ‘আমেকিার জাতীয় নিরাপত্তা বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে।’
ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতির আহ্বান কাবুলের জন্য একটি সুখবর হলেও তালেবানরা আমেরিকার সাথে চুক্তির আগে যুদ্ধবিরতির যেকোনো পরামর্শ নাকচ করে দিয়েছে। তালেবানদের সাথে পৃথকভাবে আলোচনায় বসার সিদ্ধান্তে দুর্বল হয়ে কাবুল ধারাবাহিকভাবে যুদ্ধবিরতি, তালেবানদের সাথে সরাসরি আলোচনা, নিরাপত্তা গ্যারান্টি এবং তারপর মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার চায়। তালেবানরা ‘অবৈধ পুতুল সরকারের’ সাথে আলোচনা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তালেবানরা জানে তাদের আক্রমণ করার সামর্থ্যরে ওপরই তাদের শক্তিমত্তার প্রমাণ নিহিত রয়েছে। তাই তারা তাদের হামলা বন্ধ করবে না।
এদিকে আফগানিস্তানে সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। ২৯ নভেম্বর এবং ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ৫৭ জন সরকারি সৈন্য এবং ২৭ জন বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। কয়েক দিন আগে তালেবান হামলায় আবার একজন মার্কিন সৈন্য নিহত হয়েছে। সহিংসতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ট্রাম্প আফিগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যাপারে এখন অনেকটা বেপরোয়া। ট্রাম্প তার নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্যই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু তার এই সিদ্ধান্তে কাবুল সরকার একেবারে অপ্রস্তুত ও উদ্বিগ্ন এবং চিন্তিত।
অসমাপ্ত আফগান যুদ্ধে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পাকিস্তান দোহায় এই শান্তি আলোচনার আয়োজন করে। তারা তালেবান-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনা পুনরায় শুরু করার জন্য পর্দার অন্তরাল থেকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। অক্টোবরে পাকিস্তান ইসলামাবাদে একটি তালেবান প্রতিনিধিদলকে স্বাগত জানায়। তারা একই সময়ে পাকিস্তান সফররত যুক্তরাষ্ট্রের একজন বিশেষ প্রতিনিধির সাথে তালেবানদের বৈঠকের ব্যবস্থা করেন। তারা আফগানিস্তানে সহিংসতা হ্রাস করা এবং পুনরায় শান্তি আলোচনা শুরু করার বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
যুক্তরাষ্ট্র মনে হচ্ছে তালেবানদের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য তাড়াহুড়ো করছে। বিশ্বব্যাংক সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, সম্ভাব্য শান্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে মৌলিক সেবামূলক কার্যক্রম চলানোর জন্য আফগানিস্তানের শত শত কোটি ডলার আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রয়োজন। বার্ষিক সরকারি ব্যয় নির্বাহের জন্য আফগানিস্তানের প্রতি বছর কমপক্ষে ১১ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। এসব ব্যয়ের ৭৫ শতাংশ পূরণ করা হতো আন্তর্জাতিক মঞ্জুরি এবং সহায়তা থেকে, যার বেশির ভাগই আসত যুক্তরাষ্ট্র থেকে। জনসংখ্যার তুলনায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধীরে হওয়ার কারণে আফগানিস্তানের অর্ধেকরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে।
এদিকে, আফগানিস্তানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দীর্ঘ দু’মাস পর নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচনে আশরাফ গনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। দেশটিতে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে গভীর বিভাজন রয়েছে। এই ফলাফল প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো কতটুকু মেনে নেবে- তা এখনো পরিষ্কার নয়। কারণ এ ব্যাপারে আগের রেকর্ড তেমন ভালো নয়। গতবার আশরাফ এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী আবদুল্লাহ আবদুল্লাহর মধ্যে একটি ঐক্য সরকার গঠনে আমেরিকা ভূমিকা রাখলেও এবার তারা এ ক্ষেত্রে সম্পৃক্ত হওয়ার ব্যাপারে তেমন একটা আগ্রহী নয়। আফগানরা পশ্চিমা ধাঁচের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত নয়। আমেরিকা ভুলবশত আফগানিস্তানে এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে অব্যাহতভাবে প্রয়াস চালিয়ে আসছিল।
ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত প্রায় সব উদ্যোগ আয়োজন স্থবির হয়ে আছে। অভিশংসনের মুখে এবং পুনর্নির্বাচন সামনে নিয়ে ট্রাম্প আমেরিকার সৈন্যদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে মরিয়া। তালেবানদের সাথে চুক্তির সম্ভাব্য ফলাফল হতে পারে আমেরিকা কাবুল সরকারকে পরিত্যাগ করে আফগানিস্তান থেকে কোনোরকমে বেরিয়ে আসতে পারে। তালেবানরাও এটা ঘটতে দিতে পারে। কিন্তু এতে করে সহজ কোনো সমাধান না হয়ে সঙ্কটও সৃষ্টি হতে পারে। তবে শেষ পর্যন্ত কী হয়, অবস্থা কোনো দিকে মোড় নেয়- তা এখনো অনিশ্চিত। সব কিছু পরিষ্কার হওয়ার জন্য আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।