কী ছিল কাতারের অপরাধ!

কী ছিল কাতারের অপরাধ! - ছবি : সংগ্রহ
ছোট্ট কিন্তু সম্পদশালী দেশ কাতার ও তার সম্পদশালী বড় প্রতিবেশী সৌদি আরবের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিরসনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আড়াই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক লড়াই সফলতার দিকে যাচ্ছে এমনটাই শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু এই দ্বন্দ্ব সহজেই মিটবে এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই।
২০১৭ সালে জুনের শুরুতেই কাতারের সাথে একে একে কূটনৈতিক সম্পর্ক ও পরিবহন যোগাযোগ ছিন্ন করেছিল সৌদি আরব, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসরসহ ৯টি দেশ। সন্ত্রাসবাদে মদদসহ একাধিক অভিযোগ আনা হয়েছিল কাতারের বিরুদ্ধে। সৌদির নেতৃত্বে ওই জোট কাতারের কাছে ১৩টি শর্ত দিয়েছিল। আল জাজিরা নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয়া, ইরান ও তুরস্কের সাথে সম্পর্কের মাত্রা কমানোসহ একাধিক শর্ত দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কাতার অনেক অভিযোগ সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিয়েছে। বাকিগুলোর ক্ষেত্রেও নতি স্বীকার করেনি। সে সময়ে সৌদি আরবের সাথে স্থলপথে পরিবহন যোগাযোগ ছিন্ন হওয়ার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহে টান পড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কাতার দ্রুত সমুদ্রপথে পণ্য সরবরাহের নতুন ব্যবস্থা করে ফেলে। ফলে আমদানি ব্যয় বাড়লেও অভাব-অনটন দেখা যায়নি।
আচমকা নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশের আর্থিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোয় কিছু রদবদল করতে হয়েছিল কাতারকে। স্থানীয় ব্যাংকে কোটি কোটি ডলার জমা দিয়ে এবং এলএনজি গ্যাসের উৎপাদন ৩০ শতাংশ বাড়িয়ে সঙ্কটের শুরুর দিকের পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিল ছোট্ট অথচ বিত্তশালী এই দেশটি। গত আড়াই বছর নিষেধাজ্ঞার পরও দেশটির তেমন ক্ষতি হয়নি।
সৌদি নেতৃত্বে জোট কাতারের উপর বাড়তি নিষেধাজ্ঞারও হুমকি দেয়। এর আওতায় ব্যাংকিং সম্পর্ক ছিন্ন করা কথাও বলা হয়। তাছাড়া যেসব কোম্পানি কাতারের সাথে যোগাযোগ রাখবে, তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথাও বলে এই জোট। কাতার সেই ধাক্কা দ্রুত সামলানোর প্রস্তুতিও নিয়ে নেয়। বিপুল অঙ্কের অর্থ ও সম্পদের ফলে প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিতে কাতারের বেগ পেতে হয়নি।
‘কাতার সঙ্কট’ সমাধানের আশা জাগিয়ে এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে শেষ হয় পারস্য উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ বা পিজিসিসির ৪০তম শীর্ষ সম্মেলন। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে অনুষ্ঠিত ছয়টি দেশের জোট (জিসিসি) শীর্ষ সম্মেলন সম্মেলনে দেয়া ‘ঐক্যের ডাক’ কাতার ও সৌদি আরবের নেতৃত্বে অবরোধ আরোপকারী ভূমধ্যসাগরীয় চারটি দেশের মধ্যে সম্পর্কের ‘বরফ গলার’ ইঙ্গিত দেয়।
কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি রিয়াদে অনুষ্ঠিত ওই শীর্ষ সম্মেলনে অংশ না নিলেও তার পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রী আবদুল্লাহ বিন নাসের বিন খলিফা আল থানিকে পাঠিয়েছিলেন। সৌদি সরকার কাতারের প্রধানমন্ত্রীর অভ্যর্থনায় কোনো কৃপণতাও দেখায়নি। প্রথা ভেঙে খোদ সৌদি বাদশাহ সালমান বিমানবন্দরে গিয়ে কাতারের প্রধানমন্ত্রীকে রাজকীয় অভ্যর্থনা জানিয়েছেন।
মূল সম্মেলন শুরুর আগে বাদশাহ সালমান কাতারের প্রধানমন্ত্রীর সাথে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ইরানকে মোকাবেলা, জ্বালানি সরবরাহ ও সামুদ্রিক চ্যানেলগুলো সুরক্ষিত করতে আঞ্চলিক ঐক্যের আহ্বান জানন। পরে কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, বাহরাইন এবং ওমান সমন্বয়ে ছয় সদস্যের জোটের চূড়ান্ত বক্তব্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা বজায় রাখতে সামরিক ও সুরক্ষা সহযোগিতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়া হয়। ২০২৫ সালের মধ্যে আর্থিক ঐক্য অর্জনেরও আহ্বান জানানো হয় সম্মেলনে।
কুয়েতের ক্ষমতাসীন আমির শেখ সাবাহ আল আহমাদ আল-সাবাহও, যিনি দীর্ঘদিন ধরে কাতারের বিরোধ সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন, তার বক্তব্যে ঐক্যের আহ্বানের প্রশংসা করে বলেছেন, আল্লাহ সহায় হলে, আগত বৈঠকগুলো অতীতের বৈঠকের চেয়ে আরো ভালো হবে। শীর্ষ সম্মেলন শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান আল সৌদ বলেছেন, ‘কুয়েতের আমিরের মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা এখনো অব্যাহত রয়েছে এবং অবরোধকারী দেশগুলো এই প্রচেষ্টাকে সমর্থন করছে।’
যেই তুরস্কের সাথে কাতারের সামরিক সম্পর্ক কমাতে চায় সৌদি আরবসহ উপসাগীয় জোট, সেই তুরস্কের সাথে সামরিক সম্পর্ক বাড়াচ্ছে কাতার। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান গত মাসে কাতার সফরে গিয়ে দোহার সাথে যৌথভাবে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ এবং পরিচালনার কথা বলে এসেছেন। দোহা সফরকালে তিনি সেখানে নতুন নির্মিত তুরস্কের একটি সামরিক ঘাঁটি পরিদর্শন করেন এবং সেখানে তুর্কি সেনাদের সাথে বৈঠক করেন। তুর্কি এ ঘাঁটিতে পাঁচ হাজার সেনা মোতায়েন রাখা সম্ভব।
কাতারে তুরস্কের সেনা কমান্ডকে প্রেসিডেন্ট এরদোগান ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব, সংহতি ও আন্তরিকতার প্রতীক বলে উল্লেখ করেন। এরদোগান বলেন, ‘আমরা কখনো হুমকি ও ঝুঁকির মুখে আমাদের বন্ধুদের একা ছেড়ে যাইনি এবং কখনো একা ফেলে যাবো না।’ ২০১৭ সালের জুনে কাতারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অবরোধ আরোপ করে। তখন তুরস্ক কাতারের পাশে দাঁড়ায় এবং ইরান ও তুরস্ক মিলে কাতারকে ব্যাপকভাবে খাদ্য সহায়তা দিয়ে যায়। ফলে কাতারের ওপর সৌদি অবরোধের বড় কোনো প্রভাব পড়েনি।
কিছুদিন আগেও কাতারকে নিয়ে মানুষ ততটা ভাবেনি। মধ্যপ্রাচ্য একটি আন্তমহাদেশী অঞ্চল যা পশ্চিমে এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকার দেশ মিসরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাহরাইন থেকে শুরু করে ইয়েমেন পর্যন্ত ১৭টি দেশ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য গঠিত। এরই মধ্যে ১১ হাজার ৪৩৭ বর্গকিলোমিটার নিয়ে ক্ষুদ্র একটি দেশ, যেটা কি না বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মাথাপিছু আয়ের দেশ। বর্তমানে কাতারের মাথাপিছু আয় প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার। ভাবতেও অবাক লাগে।
হালের অবরোধ কাতারকে একটি আক্রমণাত্মক রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। বিশ্বের একটি অন্যতম টেলিভিশন নেটওয়ার্ক আল-জাজিরা কাতার থেকে সম্প্রচার করা হয়। বর্তমানে কাতার বিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ। কাতারের অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি বিরাট সমস্যা রয়েছে, যা এখন অপার সম্ভাবনায় রূপান্তরিত হতে চলেছে। কাতারের একটি মাত্র প্রতিবেশী রাষ্ট্র রয়েছে। সেটা হলো সৌদি আরব। আর সঙ্গত কারণেই সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রতিবেশী রাষ্ট্র সৌদি আরবকে ঘিরেই পরিচালিত হতো। এমনকি কাতারের উট, ভেড়া, ঘোড়া প্রভৃতি পশুপালনের চারণভূমিও ছিল সৌদি আরব। সেই কাতার এখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।
কী ছিল কাতারের অপরাধ। কাতারকে আখ্যায়িত করা হয়েছে দুমুখো জাতি হিসেবে, যা একদিকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের সহায়তা করছে। অন্যদিকে অর্থ ও অস্ত্র জোগান দিয়ে সন্ত্রাসীদেরও সহায়তা করছে। কাতারের বিরুদ্ধে আল-কায়েদা, আল নুসরা, আইএস ও হামাসকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য দেয়ার অভিযোগ তোলা হয়। কিন্তু কাতার বরাবরই তা অস্বীকার করে আসছে। কাতারের আমির শেখ তামিমের মতে, তারা ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামীদের সহায়তা করছে। তা করতে গিয়ে হামাসকে সহায়তা করা অপরাধ নয়।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, সৌদি আরবের সাথে কাতারের এ দ্বন্দ্ব সহজেই মিটবে না। তাই কাতার সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছে। এ জন্য ইরান ও তুরস্ক তাদের সহায়তা করছে। ফলে রাশিয়াও চলে আসছে দৃশ্যপটে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সেদিন বেশি দূরে নয়, যখন কাতার মধ্যপ্রাচ্যে একটি প্রভাবশালী রাষ্ট্রে পরিণত হবে।