তুমুল আলোচনায় এক কিশোরী ও এক অশীতিপর
গ্রেটা থুনবার্গ ও জেন ফন্ডা - ছবি : সংগ্রহ
জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি বিশ্বজুড়ে এখন তুমুল আলোচিত। বিশ্বের উষ্ণায়ন এবং বিজ্ঞানীদের উপর্যুপরি সতর্কবাণীর পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসঙ্ঘও এ বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠেছে এবং এই বিশ্বসংস্থার উদ্যোগে ২৫ বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্বের করণীয় নির্ধারণে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করা হচ্ছে। কপ বা কনফারেন্স অব পার্টিজ নামে জাতিসঙ্ঘের এই সম্মেলন সম্প্রতি ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে শেষ হলো স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে। এ নিয়ে গত সপ্তাহেই আলোচনা করেছি। আজকের আলোচনার বিষয় কপ সম্মেলন বা জলবায়ু ইস্যু নয়। আজ আমরা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্বজুড়ে যেসব আন্দোলন সংগ্রাম চলছে, তার সাথে সংশ্লিষ্ট একটি ভিন্নতর পরিপ্রেক্ষিতের দিকে নজর দেবো।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে স্কুলশিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে আন্দোলন গড়ে তোলা এবং বিশ্বনেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী সবার নজর কাড়ে সুইডেনের ষোড়শী গ্রেটা থুনবার্গ। তার আন্দোলনের নাম ছিল ফায়ার ড্রিল ফ্রাইডেস। প্রতি শুক্রবার স্কুলে না গিয়ে গ্রেটা জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য সুইডিস পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে বিক্ষোভ কর্মসূচির আয়োজন করে। এতে স্কুলশিক্ষার্থীরা অংশ নিতে শুরু করলে একপর্যায়ে সেটি বৃহত্তর রূপ পায়।
২০১৮ সালের আগস্টে সুইডিস পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে গ্রেটার জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সূচিত ‘স্ট্রল স্ট্রাইক’ আন্দোলনে হাজারো স্কুলশিক্ষার্থী অনুপ্রাণিত হয়। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশে দেশে। গ্রেটা থুনবার্গের জন্ম ২০০৩ সালের ৩ জানুয়ারি। কিশোর বয়সেই পরিবেশ সচেতনতায় তাক লাগিয়েছে পুরো বিশ্বকে। সচেতনতা শুধু নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেনি এই সুইডিশ কিশোরী। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবেশ বাঁচানোর বার্তা নিয়ে বেরিয়েছে বিশ্বভ্রমণে। গত ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসঙ্ঘে দাঁড়িয়ে বিশ্বনেতাদের সামনে গ্রেটা বলেছে, আমাদের রক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছেন আপনারা। তাকে বিকল্প নোবেল খ্যাত ‘রাইট লাইভলিহুড’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। পরিবেশ রক্ষায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে রাজনৈতিক দাবিগুলো তীব্রতর ও উৎসাহিত করায় গ্রেটাকে এ পুরস্কার দেয়া হয়। বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের বিচারে গত বছর কম বয়সী প্রভাবশালীদের তালিকায় ছিল গ্রেটা। শুধু তাই নয়, পরিবেশ রক্ষার্থে এই কিশোরীর অবদান বিবেচনায় এ বছর তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেয়া হয়। পুরস্কার অবশ্য শেষ পর্যন্ত সে পায়নি। তবে নোবেল মনোনয়নের খবর পেয়ে টুইটারে তার যে প্রতিক্রিয়া ছিল সেটিও উৎসাহব্যঞ্জক। গ্রেটা লিখেছে, মনোনয়নের জন্য সম্মানিত ও কৃতজ্ঞ। আমরা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য ‘স্কুল স্ট্রাইক’ শুরু করেছি। যত দিন করতে হয় তত দিনই করব।
এসব ঘটনা অনেকেই জানেন। তবে গ্রেটার মতো তরুণ প্রজন্মের কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ হয়ে একই ধরনের আন্দোলনে শরিক হওয়া আরেকজন পরিবেশ বীরের ভূমিকার কথা আজ তুলে ধরতে চাই। ইনি একজন মার্কিন নারী। নাম জেন ফন্ডা, পুরো নাম জেন সিমোর ফন্ডা। বিশ্বের বিনোদন জগতের সামান্য খবরাখবরও যারা রাখেন, তাদের কাছে নামটি সুবিদিত। যৌবনের উচ্ছল দিনগুলোতে তিনি অভিনয়কুশলতা দিয়ে জয় করেন বিশ্বের হাজারো মানুষের হৃদয়। বর্তমানে তার বয়স ৮২ বছর। কিন্তু এই বয়সেও তিনি জীবনের দাবি অস্বীকার করতে পারেননি। নেমে পড়েছেন পরিবেশবিষয়ক আন্দোলনে। বিশ্বকে বাসযোগ্য রাখতে হবে, মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিরাপদ রাখতে হবে এবং এ জন্য প্রত্যেক মানুষের কিছু করণীয় আছে। এই বিশ্বাসে উজ্জীবিত জেন ফন্ডা বয়সের বাধা উপেক্ষা করে নেমে এসেছেন রাজপথে।
সাহসী এই নারী পরিবেশ আন্দোলনে যোগ দেয়ায় গত শনিবার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। ওয়াশিংটনে ‘নো নিউ ফসিল ফুয়েলস’ এবং ‘গ্রিন নিউ ডিল’ নামে পরিবেশ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। এটাই তার জীবনের প্রথম গ্রেফতারি ছিল না, বরং এবারে তিনি পঞ্চমবারের মতো গ্রেফতার হলেন। এর আগে একবার তাকে গ্রেফতার করে হাতে হাতকড়া লাগিয়ে গাড়িতে তোলে পুলিশ। শেষবার গ্রেফতার হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক ওই সমাবেশে ‘শুভ ৮২তম জন্মদিন জেন’ লেখা একটা ব্যানারের সামনে ভাষণ দেন। এ দিন ছিল তার জন্মদিন। যে মুহূর্তে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে ভক্ত শুভার্থীদের নিয়ে তার জমজমাট অনুষ্ঠানে মেতে থাকার কথা, ঠিক সেই সময়েই তিনি অংশ নেন ধরিত্রী রক্ষার আন্দোলনে। সেই আন্দোলনে ওয়াশিংটন ডিসির হার্ট সিনেট ভবনের সামনে থেকে ১৩৮ আন্দোলনকারীকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে কর্মসূচি শেষ হয়।
জেন ফন্ডা ১৯৩৭ সালের ২১ ডিসেম্বর নিউ ইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা হেনরি ফন্ডা (১৯০৫-১৯৮২) ছিলেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও অভিনেতা এবং মা ফ্রান্সেস ফোর্ড সিমোর (১৯০৮-১৯৫০) ছিলেন একজন কানাডীয়-বংশোদ্ভূত সমাজকর্মী। ‘ক্লুট’ (১৯৭১) ও ‘কামিং হোম’ (১৯৭৮) ছবিতে অভিনয় করে দু’বার বিশ্বসেরা পুরস্কার অস্কার জয় করেন জেন ফন্ডা। তিনি কেবল অভিনেত্রীই নন, একই সাথে একজন লেখিকা, রাজনৈতিক কর্মী ও সাবেক ফ্যাশন মডেল এবং ফিটনেস গুরু। তিনি দু’বার একাডেমি অ্যাওয়ার্ড ও দু’বার বাফটা পুরস্কার বিজয়ী। ২০১৪ সালে তিনি আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে এএফআই আজীবন সম্মাননা পুরস্কার লাভ করেন। তার অভিনীত অন্য যেসব ছবি একাডেমি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয় সেগুলো হলো- হল জুলিয়া (১৯৭৭), দ্য চায়না সিনড্রোম (১৯৭৯), অন গোল্ডেন পন্ড (১৯৮১) এবং দ্য মর্নিং আফটার (১৯৮৬)। এ ছাড়া তিনি ১৯৮৪ সালে দ্য ডলমেকার টেলিভিশন চলচ্চিত্রের জন্য একটি এমি পুরস্কার, জুলিয়া ও দ্য চায়না সিনড্রোম চলচ্চিত্রের জন্য দু’বার বাফটা পুরস্কার এবং চারবার গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার লাভ করেন।
এই রকম একজন তারকার তো শেষ জীবনটা নির্ঝঞ্ঝাটে আরাম-আয়েশে কাটিয়ে দেয়ার কথা। কিন্তু তিনি তা না করে রাজপথে কেন? এখানেই উঠে আসে আমাদের বাসস্থান এই পৃথিবীর জন্য প্রতিটি ব্যক্তির ব্যক্তিগত দায়িত্বের কথা। নিজের ওয়েবসাইটে ফন্ডা লিখেছেন, রোদ হোক বা বৃষ্টি, তরুণ প্রজন্ম যে দুরন্ত মুহূর্ত তৈরি করছে তা থেকে তিনি উদ্বুদ্ধ হন। তরুণ প্রজন্মের প্রেরণা থেকেই তিনি দীর্ঘদিন ধরে জীবাশ্ম জ্বালানির বিরুদ্ধে ও সবুজায়নের লক্ষ্যে আন্দোলন করে যাচ্ছেন। ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ফন্ডা ট্রাম্পের সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধে তার করণীয় নিয়ে কথা বলতেই তার সাথে দেখা করার কথা ভেবেছিলেন তিনি। ফন্ডা বলেন, ‘আমি ভেবেছি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে গিয়ে বলব পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারলে আপনি হবেন পুরো বিশ্বের হিরো, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্ময়কর একজন মানব।’ কিন্তু তার সে পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ পায়নি নানা কারণে।
জেন ফন্ডা যে গ্রিন নিউ ডিল আন্দোলনের সাথে যুক্ত সেটি মূলত একটি পরিকল্পনা।
এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হলো পৃথিবীতে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ ২০৩০ সালের মধ্যে অর্ধেকে নামিয়ে আনা। এটা করা সম্ভব হলে বিশ্বের উষ্ণায়নের গতি ২১০০ সালের মধ্যে ২.৭ ডিগ্রি ফারেনহাইটের নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসঙ্ঘের কপ সম্মেলনে যে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়, গ্রিন নিউ ডিলের লক্ষ্য সেই কর্মসূচিরই প্রতিফলন।
এই আন্দোলনের নামের মধ্যে যে ‘ডিল’ শব্দটি আছে, তা এসেছে ১৯২৯ সালের মার্কিন অর্থনীতির মহামন্দা পরিস্থিতি সামলে উঠতে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের নেয়া তাৎক্ষণিক ডিল বা মহাপরিকল্পনা থেকে। রুজভেল্ট নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিল্প বিকাশের মতো অনেক কর্মসূচি নিয়েছিলেন ওই মহাপরিকল্পনার আওতায়। এখন গ্রিন নিউ ডিলের আন্দোলনকারীরা চাচ্ছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিও একই রকম অতি জরুরি বিবেচনা করে এ বিষয়ে মহাপরিকল্পনা নেয়া হোক। কিন্তু ট্রাম্পের মতো একজন বিজ্ঞানচেতনাহীন মানুষের কাছে এই আন্দোলনের কোনো গুরুত্ব নেই। গত বছর গ্রেটা থুনবার্গকে নিয়ে ট্রাম্পের হাস্যকৌতুক সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে ফন্ডা সাংবাদিকদের বলেন, এ জন্য ট্রাম্পের করুণা পাওনা। কারণ গ্রেটার মতো মেয়ের সাথে যে ব্যক্তি এমন করতে পারে, সে আসলে ফাঁপা। তার সমবেদনা ও সহমর্মিতার ঘাটতি রয়েছে। লোকটির প্রতি আমার সহমর্মিতা আছে। কিন্তু আমি শঙ্কিত, কারণ তার ভেতর কোনো পরিবর্তন দেখছি না।
যা হোক, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সূচিত গ্রিন নিউ ডিলের পক্ষ থেকে মার্কিন কংগ্রেসে একটি প্রস্তাবনা পেশ করা হয়েছিল এবং ৬০ জন কংগ্রেস সদস্য সেই পরিকল্পনায় সমর্থন দেন। আর আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থী চারজন ডেমোক্র্যাট সদস্যও এটি সমর্থন করেন। ফলে আগামী বছর জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যুটি জোরালো ও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠবে বলে আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
গ্রিন নিউ ডিলের যে সাতটি দাবি রয়েছে, তার অন্যতম হলো- আমেরিকার বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থার পুরোটাই নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে রূপান্তর, সব ভবনে জ্বালানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তির উপযোগী করে তোলা, কৃষি ও শিল্পে কার্বন নিঃসরণ বন্ধ করা, গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করা ইত্যাদি।
আমাদের বিশ্বাস, জলবায়ু পরিবর্তন একটি জ্বলন্ত ইস্যু হিসেবেই সামনের বছরগুলোতেও আলোচনায় থাকবে। এই ইস্যুতে গ্রেটার মতো ষোড়শী এবং জেন ফন্ডার মতো অশীতিপর এক নারীর অগ্রণী ভূমিকা পালন নিঃসন্দেহে বিশ্বের সব বয়সের নারী-পুরুষকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সক্রিয় হয়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ করবে।