যেভাবে যুদ্ধে জয় করছে আফগান তালেবান

যেভাবে যুদ্ধে জয় করছে আফগান তালেবান - ছবি : সংগৃহীত
আগের সোভিয়েত বাহিনীর মতো মার্কিন ও মিত্র বাহিনীও আফগানিস্তানের পাহাড়-পর্বত আর প্রতিকূল এলাকায় অপ্রতিসম যুদ্ধের শিকার হচ্ছে। আফগান মঞ্চে হানাদার বাহিনী নির্দিষ্ট রাজনৈতিক সাফল্য লাভের জন্য সীমিত যুদ্ধে নিয়োজিত হলেও বিদ্রোহীদের কাছে তা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করে। বিদ্রোহীদের কাছে এটি হলো তাদের টিকে থাকার সংগ্রাম।
আফগান বিদ্রোহীরা সাবেক মার্কিন কূটনীতিক ও রাজনীবিদ হেনরি কিসিঞ্জারের একটি উক্তি প্রমাণ করেছে : গেরিলারা জয়ী হবে, যদি তারা না হারে; প্রচলিত সেনাবাহিনী হেরে যাবে, যদি তারা না জয়ী হয়।
আফগান যুদ্ধে অব্যাহত অচলাবস্থা প্রমাণ করছে যে তালেবানই এতে জয়ী হচ্ছে। বিদ্রোহী গ্রুপটিকে কেবল যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করতে হচ্ছে এবং আফগানিস্তানে অবস্থান করার আমেরিকান ইচ্ছাশক্তি অবসান হওয়ার প্রতীক্ষা করতে হচ্ছে। অপ্রতিসম যুদ্ধের কৌশলগত সুবিধার কারণে সম্ভাব্য বিমান হামলা ও গোলন্দাজ বাহিনীর হামলার সময় বিদ্রোহীদের স্থান ত্যাগ করার সুযোগ দিচ্ছে এবং এই হামলা শেষ হওয়া মাত্র তারা তাদের ঘাঁটিগুলোতে ফিরে আসতে পারছে। অন্যদিকে বিদ্রোহীদের অপ্রত্যাশিত হামলা সরকারি বাহিনীর ধৈর্য ভেঙে যাচ্ছে।
ভৌগোলিক ও কৌশলগত অপ্রতিসম যুদ্ধের সুবিধা ছাড়াও আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র বাহিনীর সমর্থন ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে এবং বেসামরিক হতাহত, বেকারত্ব ও দুর্নীতির মতো নানা কারণে বিদ্রোহীদের সমর্থন বাড়ছে। প্রতিবছরই সরকারপন্থী বাহিনীর হাতে বেসামরিক হতাহত বাড়ছেই। ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সর্বশেষ ইউএন অ্যাসিস্ট্যান্স মিশন ইন আফগানিস্তান (ইউএনএএমএ) প্রতিবেদন অনুযায়ী সরকারপন্থী বাহিনীর হামলায় ২,৩৪৮ জন (নিহত ১,১৪৯ ও আহত ১,১৯৯ জন) হতাহত হয়েছে। ২০১৮ সালের একই সময়ের চেয়ে তা ২৬ ভাগ বেশি।
এদিকে উদার গণতন্ত্রের বিকাশ কাবুলের বাইরে খুব একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। আর জাতীয়তাবাদী অনুভূতিকে পুঁজি করে এবং ছায়া অর্থনীতি পরিচালনা করে (আফিম উৎপাদন ও ব্যবসা) চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করে সমর্থন বাড়িয়ে নিয়েছে।
গ্রাম এলাকায় বসবাসকারী বেশির ভাগ পশতুই বিদেশী দখলদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তালেবানের ভাষ্যই গ্রহণ করে নিচ্ছে। তারা মনে করছে, যেকোনো মূল্যে বিদেশী দখলদারদের থেকে দেশকে রক্ষা করা গর্ব আর সম্মানের বিষয়। বিদ্রোহী গ্রুপটি দেশের সম্মান ও স্বাধীনতা রক্ষার যুগপ্রাচীন আফগান গর্বকেই উস্কে দিচ্ছে। ঊনিশ শতকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে, ২০ শতকে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে অতি মূল্যবান স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা তারা গর্বভরে বলে থাকে। গ্রামের মানুষদের কাছে নিজেদের বার্তা প্রচারে লোকজ কবিতা, গল্প, গান ব্যবহার করে থাকে বিদ্রোহীরা।
পশতুদের মধ্যে তালেবানের সমর্থন আরো বেড়েছে। আফগান জনসাধারণের প্রায় ৪০ ভাগ পশতু। আফগানিস্তানের চেয়ে বেশি পশতু বাস করে পাকিস্তানে। ডুরান্ট লাইন পশতুদের আফগান ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভক্ত করে ফেলেছে। আফগান পশতুরা পাকিস্তানে থাকা পশতুদের কাছ থেকে সমর্থন পেয়ে থাকে।
আফগান সেনাবাহিনীতে উত্তর আফগানিস্তানের জাতিগত গ্রুপগুলোর প্রাধান্য রয়েছে। এর ফলে দক্ষিণ আফগানিস্তানে তালেবানের ঘাঁটিতে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে মারাত্মক প্রতিকূলতার মুখে পড়ে। উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে জাতিগত বৈরিতা থাকায় দক্ষিণে এসব আফগানকে বিদেশী মনে করা হয়। আবার দক্ষিণে পশতুদের মধ্যে সমর্থন বাড়ানোর উদ্যোগে সাফল্য আসেনি।
বেকারত্ব ও দুর্নীতি
অবশ্য বিদেশী হস্তক্ষেপের সময় দীর্ঘ হওয়ায় ও মারাত্মক বেকারকত্বের কারণে তালেবানদের পক্ষে সহজ হয়েছে তাদের অবস্থান জোরদার করার। উত্তর আফগানিস্তানের জাতিগত গ্রুপগুলো থেকে স্থানীয় কমান্ডারদের একটি নতুন প্রজন্ম তালেবানের চাকরির প্রস্তাবে আকৃষ্ট হয়ে ঐতিহাসিক বৈরিতা সত্ত্বেও তাদের সাথে যোগ দিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাদাখশান প্রদেশের অনেক তালেবান যোদ্ধা এসেছে তাজিক জাতিগত গ্রুপ থেকে। তাছাড়া তালেবান বিপুলভাবে জয়ী হতে যাচ্ছে, এমন ধারণার ফলেও অনেকে তাদের সাথে যোগ দিচ্ছে।
আবার তালেবানের ইসলামি মূল্যবোধের ওপর গুরুত্ব প্রদানের ফলেও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী তাদের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। সোভিয়েত আমলে তাদের বিরুদ্ধে লড়াইতেও মুজাহিদরা এই কৌশলে সাফল্য পেয়েছিল।
অন্যদিকে দুর্নীতিও আফগান সেনাবাহিনীর শক্তি শুষে নিচ্ছে। অস্তিত্বহীন অনেক সৈন্যের নাম পাওয়া যায় বেতনের তালিকায়। আবার আফগান বাহিনীর মধ্যে উচ্চ হতাহতের হারের কারণেও অনেকে বাহিনী ত্যাগ করতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। দীর্ঘ যুদ্ধের জন্য আফগান বাহিনী প্রস্তুত ছিল না। ফলে তাদের মধ্যে হতাহত বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, আফগানিস্তানে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে, সেটাকে সামাল দেয়ার জন্য তরুণদের মধ্যে বিপুলসংখ্যক চাকরি সৃষ্টি করতে হবে। আর সেজন্য দরকার সম্প্রসারণশীল ও টেকসই অর্থনীতি। কিন্তু অর্থনীতি প্রায় পুরোটাই সাহায্যের ওপর নির্ভরশল হয়ে রয়েছে। আর তালেবান আফিম বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল অর্থ সংগ্রহ করছে। এর মাধ্যমেই তারা ছয় লাখ লোককে পূর্ণকালীন চাকরিতে নিয়োজিত রাখতে পারছে। তালেবানের আফিম বাণিজ্য নষ্ট করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল, কিন্তু সাফল্য আসেনি।
অনেক আফগানই অন্য সব মতাদর্শের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। জাতীয়বাদের গর্বই তাদেরকে ব্রিটিশ ও রুশদের বিরুদ্ধে জয়ী হতে সহায়তা করেছিল। আর এটিই এখন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। দেশ যখন হুমকির মুখে পড়ে তখন বেপরোয়া স্থানীয় পরিচিতিই সাধারণত ঐক্যবদ্য জাতীয় পরিচিতিতে পরিণত হয়।
এশিয়া টাইমস