বড় ভুল করল ভারত!
বড় ভুল করল ভারত! - ছবি : সংগৃহীত
ভারতের রিজিওন্যাল কমপ্রেহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি, ১৫ সদস্যবিশিষ্ট বাণিজ্য ব্লক) থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্তটির অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণ হয়তো বোঝা যায়। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নয়া দিল্লির ভূরাজণৈতিক লক্ষ্যে বড় ধরনের আঘাত সৃষ্টি করবে। ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারকের অন্যতম টোকিওর জন্যও এটি সমস্যার সৃষ্টি করবে। আবার ট্রাম্পের এশিয়া স্বার্থেও ক্ষতির কারণ হবে।
আরসিইপির ফলে সস্তা চীনা পণ্য সম্ভারের জন্য ভারতের বাজার খুলে যেতে পারে। এতে করে ভারতের খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলা ম্যানুফেকচারিং শিল্পের জন্য হুমকি সৃষ্টি হতে পারে। যে দেশটি আরসিইপির প্রায় সব দেশের সাথে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে এবং ছয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক মন্থরতার কবলে পড়েছে, তার জন্য এটি ছোটখাট কোনো বিষয় নয়।
এদিকে আরসিইপি নিয়ে প্রতিষ্ঠান থেকে চাষি পর্যন্ত ভারতে ব্যাপক বিরোধিতার সৃষ্টি হয়েছে। নয়া দিল্লি চাষিসহ তার ভোটারদের থেকে দূরে সরে থাকতে পারে না। কারণ তাতে এই সরকারের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়তে পারে। ভারতকে অগ্রাধিকার দেয়ার ইচ্ছাই আরসিইপি থেকে ভারতের সরে আসার মোদির সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার করেছে।
অবশ্য আরসিইপিকে ভারতের প্রত্যাখ্যান করার ফলে চীনসহ এই ব্লকের দেশগুলোর মধ্যে ভারতের প্রাধান্য সৃষ্টির লক্ষ্যটি বড় ধরনের সমস্যায় পড়ে গেছে। তাদের ভূরাজনৈতিক সম্ভাবনাগুলো এখন সঙ্কোচিত হতে পারে। অথচ নয়া দিল্লির অ্যাক্ট ইস্ট নীতিতে প্রাচ্যের, বিশেষ করে আসিয়ান দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদার করার কথা বলা হয়েছে। এই এলাকার জ্বালানি ও অন্যান্য সুযোগ গ্রহণ করা ও প্রতিন্দ্বন্দ্বী চীনের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান জোরদার করার জন্য এর প্রয়োজন ভারতের। এশিয়ান প্যাসিফিক ইকোনমিক কোঅপারেশনের (এপেক) সদস্য না হওয়ার ক্ষতিপূরণ করতে পারত ভারত এর মাধ্যমে।
ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে এশিয়ার নতুন ও উদীয়মান অর্থনৈতিক কাঠমোতে সক্রিয় ভূমিকা পালনের কথা বলা হয়েছে। এই লক্ষ্যেই সে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকে যোগ দিয়েছে চীনের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শেয়ারহোল্ডার হিসেবে। চীনের সাথে ভারতের সম্পর্ক জটিল। এই সম্পর্কের একদিকে যেমন রয়েছে বিপুল অর্থনৈতিক সহযোগিতা, অন্যদিকে রয়েছে তীব্র কৌশলগত প্রতিযোগিতা। আবার সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ ও বহুত্ববাদ বিকাশে উভয় দেশের অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। ফলে নয়া দিল্লি আরেকটি বহুপক্ষীয় ফোরামে বেইজিংয়ের অর্থনৈতিকভাবে অংশীদার হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করল।
আবার বিশেষ করে মোদির আমলে ভারতের একটি বড় লক্ষ্য হলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দায়িত্বশীল দেশ হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো। কিন্তু হিন্দুবাদের কারণে দেশে যেমন সমস্যা হচ্ছে,বিদেশেও তাদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্বের প্রায় ৩০ ভাগ জনসংখ্যাকে নিয়ে গঠিত এই জোট থেকে ভারতের সরে আসাটা নয়া দিল্লির জন্য ভালো বিবেচিত হচ্ছে না। বিশেষ করে জাপানের জন্য বিষয়টি বিশেষভাবে খারাপ হবে। এই জোটে ভারত আর জাপানই হতো সবচেয়ে গণতান্ত্রিক দেশ। ভারত যাতে আরসিইপি ত্যাগ না করে সেজন্য মোদিকে বোঝাতে ডিসেম্বরের ১৫ তারিখে জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবের নয়া দিল্লি যাওয়ার কথা ছিল। জাপানি কোম্পানিগুলোর উপমহাদেশে জোরদার উপস্থিতির জন্য তিনি ভারতের সাথে জোরালো রাজনৈতিক সম্পর্ক কামনা করছিলেন। আর আরসিইপি জাপানকে ভারতে রফতানি বাড়ানোর বিপুল সুযোগ দিত। তাছাড়া ভারতে বিনিয়োগ উভয় দেশের জন্যই লাভজনক হতে পারে।
তাছাড়া এই ব্লকের মাধ্যমে জাপানের পক্ষে সহজ হতো এই অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে। যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে ভারতের সাথে মিলে তার পক্ষে সম্ভব হতো চীনের মোকাবিলা করতে। কিন্তু ভারত এখন সরে যাওয়ায় জাপান অনেকটাই একা হয়ে যাবে। ফলে চীনের মোকাবিলায় তার কণ্ঠ সোচ্চার হওয়ার সম্ভাবনা কম হবে। আরসিইপি থেকে ভারতের সরে আসাতে যুক্তরাষ্ট্রও সমস্যায় পড়বে। ট্রাম্প প্রশাসন এখন দেখতে পাবে যে চীনা সমর্থনপুষ্ট একটি উদ্যোগে ভারত নেই। উল্লেখ্য, এশিয়ায় ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র বিবেচনা করে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। যুক্তরাষ্ট্র আশা করছিল যে এই ফোরামে ভারতের উপস্থিতি তার অবস্থান জোরদার করবে। কিন্তু এখন সেটা হচ্ছে না।
তবে শেষ কথা হলো, ভারতের আরসিইপি পদক্ষেপটি বর্তমানে অনেক দেশের সামনে আসা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকেই তুলে ধরেছে : দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে বিশ্বায়নকে অনুসরণ করার আকাঙ্ক্ষার সাথে বৈশ্বিক ধারণাকে পেছনে ঠেলে দেয়া দেশের ক্রমবর্ধমান তীব্র জাতীয়তাবাদী চাপের সমন্বয় সাধন কিভাবে করা যায়।
ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট