জাতীয় বেতন কাঠামো : অসঙ্গতি ও বৈষম্য

নূর আহমদ | Dec 23, 2019 04:49 pm
জাতীয় বেতন কাঠামো : অসঙ্গতি ও বৈষম্য

জাতীয় বেতন কাঠামো : অসঙ্গতি ও বৈষম্য - ছবি : সংগ্রহ

 

২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর সরকার অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলের গেজেট প্রকাশ করেছে। প্রাথমিকভাবে দেখা যায় সরকার চাকরিজীবীদের বেতন আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ করেছে, তখন বেতন স্কেলের অন্য দিকগুলো নিয়ে তেমন ভাবার প্রয়োজন মনে হয়নি। অষ্টম বেতন স্কেলের গেজেট প্রকাশের পর অসঙ্গতি ও বৈষম্য নিয়ে আন্দোলন হয়েছে।

পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে। লাভ হয়নি। বেতন স্কেলে মোট ২০টি ধাপ। ২০১৫ সালের পে-স্কেলের আগে নিয়ম ছিল, আট বছর চাকরি পূর্ণ হলে প্রথমবারের মতো গ্রেড উন্নীত হয়, যাকে টাইম স্কেল বলা হতো। ২০১৫ সালের পে-স্কেলে তা বাদ দিয়ে নিয়ম করা হয়- ১০ বছর চাকরির পর প্রথমবারের মতো গ্রেড পরিবর্তন হবে। ধরা যাক, একজন ১৪ নম্বর ধাপে চাকরি শুরু করেছেন। ১০ বছর অপেক্ষার পর তার বেতন বাড়বে ৮০০ টাকা। যারা বেতন কাঠামো তৈরি করেছেন, তাদের কাছে এটি বেশি মনে হতে পারে (!), কিন্তু অন্য যে কেউ ‘মাত্র’ বলবেন নির্দ্বিধায়। বিষয়টি দেখার পর সঙ্গত কারণেই অন্য ধাপগুলোর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। দেখি অন্য অনেক ধাপে ধাপ বাড়লে বেতন বহু গুণে বাড়বে। বিশেষ করে উপরের ধাপগুলোতে। কিন্তু নিচের দিকে ধাপ পরিবর্তন হলে বেতন বৃদ্ধি তেমন বোঝা যায় না। বেতন কাঠামো প্রণয়নের দায়িত্ব আমলাদের না দিয়ে একজন সাধারণ শিক্ষিত ব্যক্তিকে দিলেও তিনি হয়তো এর চেয়ে গ্রহণযোগ্য ও যৌক্তিক একটি কাঠামো জাতিকে উপহার দিতে পারতেন। আমলা ছাড়া যারা এ বেতন কাঠামোর বাইরে, এমন এক লাখ সচেতন মানুষের মতামত নেয়া হলে একজনও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি এরকম ধাপ নির্ধারণকে পক্ষপাতহীন ও যৌক্তিক বলে বিবেচনায় নেবেন।

বর্তমান সরকার দেশকে উন্নত দেশের কাতারে শামিল করতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আমাদের মনে হয়, দেশের উন্নতির পথে বড় অন্তরায় আমলাতন্ত্র। জাপানের একটা বিষয় লক্ষ্য করলে এ মতামতের সত্যতা প্রমাণিত হবে। জাপানে শ্রমের মূল্য অনেক বেশি। সেখানে নিচের শ্রেণীর কর্মীরা দেশের প্রথম সারির পেশাজীবীদের গড় আয়ের অনেকটা কাছাকাছি পেতন পান। দেশের সব নাগরিকের হাতে যেন পর্যাপ্ত টাকা থাকে, সে জন্য জাপান সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। সেখানে একজন নরসুন্দরের গড় আয় মাসে দুই হাজার ডলার। [জাপান কাহিনী দ্বিতীয় খণ্ড, আশির আহমেদ, ঐতিহ্য, পৃষ্ঠা-৬০] জাপানের মতো কোরিয়ায়ও মানুষের আয়বৈষম্য নিরসনে সরকার সচেষ্ট থাকে। অন্যরা যখন আয়বৈষম্য নিরসনের চেষ্টায় ব্যস্ত, আমরা তখন আয়বৈষম্য বৃদ্ধির অপচেষ্টায় লিপ্ত, যার রুঢ় দৃষ্টান্ত জাতীয় বেতন কাঠামো।

অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের বেতন যা, একজন সাধারণ শ্রমজীবীর বেতন প্রায় কাছাকাছি। কিন্তু বাংলাদেশে সব শ্রেণীর মানুষের হাতে পর্যাপ্ত টাকা থাকুক, এটি দেশের নেতৃস্থানীয় কিছু ব্যক্তি বোধ হয় চান না। তারা স্বার্থপর আর সঙ্কীর্ণ মনের অধিকারী। যার উৎকৃষ্ট প্রমাণ বৈষম্যমূলক বেতন কাঠামো, যেখানে নিচের শ্রেণীর এক গ্রেড পরিবর্তনে বেতন বাড়ে ২০০-৩০০ টাকা, আর উপরের এক গ্রেড পরিবর্তনে বেতন বাড়ে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা। কেন, সব গ্রেডে যদি সমানহারে বেতন বাড়ে, উপরের গ্রেডে চাকরিজীবীদের কী মস্ত বড় ক্ষতি হয়ে যাবে? বেতন গ্রেডের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্নের পার্থক্য বের করে ১৯ দিয়ে ভাগ করলে যা হয় (৭৮০০০-৮২৫০/১৯=৩৬৭১ বা ৩০০০/৪০০০), প্রতি গ্রেডে পার্থক্য তাহলে অসুবিধা কোথায়? ১৯ দিয়ে ভাগের কথা বলা হলো এ কারণে যে যেহেতু শেষ গ্রেড চাকরি শুরুর পর প্রথম গ্রেডে আসতে সর্বোচ্চ ১৯ বার গ্রেড পরিবর্তন হতে পারে।

উপরের গ্রেডের চাকরিজীবীরা হয়তো বলতে পারেন, নিচের দিকের গ্রেডগুলোতে জনবল বেশি। তাই তাদের বেশি বেতন দিতে গেলে দেশের অর্থনীতিতে চাপ পড়বে। দেশের প্রতি তাদের এতই যদি মায়া থাকে, তাহলে নিজেদের গ্রেডগুলোর মধ্যকার পার্থক্য এত বেশি কেন? এমনিতেই উপরের দিকের গ্রেডে চাকরি করছেন, এরপর বেতন বৃদ্ধি যদি নিচের দিকের গ্রেডগুলোর চেয়ে দু’-তিন গুণ বেশি হতো, তবু কম হতো না। কিন্তু তাদের বেতন বাড়ে নিচের দিকের গ্রেডগুলোর চেয়ে ২০-২৫ গুণ বেশি। তাদের এত বেতন দিতে গেলে দেশের অর্থনীতির ওপর কী চাপ পড়ে না? এসব হচ্ছে বাহানা। নিজেরা বেতন কম নিয়ে দেশপ্রেমের কথা বললে তা সত্যিকার দেশপ্রেম হতো।

উপরের গ্রেডে চাকরিজীবীদের স্বার্থপরতার কাছে অসহায় হয়ে আছে দেশের সামগ্রিক মানুষের জীবনমানের উন্নতি। একটি বিশেষ শ্রেণীর হাতে দেশের টাকা চলে যাচ্ছে বেশি। সরকার বিষয়টি যতদিন বিবেচনায় না নেবে, ততদিন দেশ সত্যিকার উন্নতির পথ খুঁজে পাবে না।

বেতন কাঠামোর বৈষম্য নিরসনের উদ্যোগ যখনই নেয়া হোক; তখন অথবা পরবর্তী পে-স্কেল যখনই দেয়া হোক, তখন কিছু প্রস্তাব বিবেচনায় নেয়ার অনুরোধ করছি আমরা। প্রতি গ্রেডে ব্যবধান যেন সমান হয়। এতে উপরের দিকের গ্রেডে যারা চাকরি করেন, তাদের ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। কারণ, তারা বড় স্কেলে চাকরি শুরু করেছেন। প্রতি আট বছর পর যেন সব চাকরিজীবীর বেতন গ্রেড পরিবর্তন করা হয়। চাকরি জীবনে ন্যূনতম তিনবার যেন উন্নীত গ্রেডে যাওয়ার সুযোগ থাকে।

এতে যেসব পদে পদোন্নতির সুযোগ নেই, সেসব পদে কর্মরতদের হতাশা কমবে। ২০ থেকে কমিয়ে ১৬ গ্রেড করা হলে অনেক দিক থেকে ভালো হতে পারে। সরকারি চাকরিতে যেহেতু মোট চারটি শ্রেণী, নিয়োগের ক্ষেত্রে ১৬টি গ্রেডকে চার শ্রেণী দিয়ে ভাগ করে প্রতি শ্রেণীর প্রান্তিক গ্রেডকে সেই শ্রেণীতে নিয়োগের প্রারম্ভিক গ্রেড হিসেবে নির্ধারণ করা যেতে পারে। সবার জন্য ন্যূনতম তিনবার উন্নীত গ্রেডে যাওয়ার সুযোগ রাখা প্রয়োজন। সর্বনিম্ন গ্রেড আট হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করে প্রতি গ্রেডে দুই হাজার, দুই হাজার ৫০০ বা তিন হাজার টাকা করে বাড়িয়ে বেতন কাঠামো নির্ধারণ করা যেতে পারে। ন্যূনতম দুটি গ্রেড পরিবর্তন না হলে যেন বাড়িভাড়া কমানো না হয়। আর কমানো হলেও ৫ শতাংশ নয়, ২ শতাংশ বা ৩ শতাংশ কমালে সবার জন্য ভালো হয়।

লেখক : সরকারি চাকরিজীবী
nurahmad786@gmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us