ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে নতুন সুর!

কূটনৈতিক প্রতিবেদক - ছবি : সংগৃহীত
ভারতে মন্ত্রীদের একের পর এক সফর এবং দ্বিপক্ষীয় বৈঠক স্থগিত কাকতালীয় নয়, বরং নানা ইস্যুতে বাংলাদেশের অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশÑ এমনটাই মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের সরকারি পর্যায় থেকে প্রস্তুতির অভাবসহ বিভিন্ন কারণকে এ জন্য দায়ী করা হচ্ছে। ভারতও বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক অবস্থানকেই তুলে ধরছে।
গত ১১ ডিসেম্বর ভারতের পার্লামেন্টে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাস হওয়ার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রতিবেশী দেশটিতে তাদের পূর্বনির্ধারিত সফর স্থগিত করেন। এরপর অল্প সময়ের ব্যবধানে ভারতের সাথে অভিন্ন নদীবিষয়ক যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) ও বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতাবিষয়ক যৌথ কারিগরি কমিটির (জেডব্লিউসি) বৈঠক স্থগিত করে বাংলাদেশ। ভারত মহাসাগরীয় সংলাপে (আইওডি) যোগ দিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিল্লি যাওয়ার কথা ছিল ১২ ডিসেম্বর। পরদিন মেঘালয়ে যাওয়ার কথা ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। ১৮ ডিসেম্বর দিল্লিতে জেআরসি এবং ২০ ডিসেম্বর উদয়পুরে জেডব্লিউসি বৈঠকের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি ছিল। সফর স্থগিত করার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিজয় মাসের কর্মসূচিতে ব্যস্ততার কথা বলেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরবর্তী সুবিধাজনক সময়ে মেঘালয় যাওয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। আর জেআরসি ও জেডব্লিউসি বৈঠক স্থগিত করার আনুষ্ঠানিক কারণ হিসাবে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি ও বাংলাদেশের প্রস্তুতির অভাবকে সামনে আনা হয়েছে।
ধারাবাহিকভাবে দিল্লি সফর ও ভারতের সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকগুলো স্থগিত রাখাটা কাকতালীয় কিনা জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, কাকতালীয় অবশ্যই না। যেকোনো একটা সফর বা বৈঠক বাতিল হলে কাকতালীয় বলা যেতো। কিন্তু পরপর এতগুলো না। কূটনীতিতে এমনটাই হয়। করা হয় একটা, বলা হয় অন্যটা। তিনি বলেন, ভারতের পার্লামেন্টে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন প্রণয়নের সময় পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সাথে বাংলাদেশকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে রাখা বক্তব্যে অবশ্যই আমাদের সরকার খুশি নয়। পূর্বনির্ধারিত সফর ও বৈঠকগুলো স্থগিত করে এটাই ভারতকে বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের এই বার্তার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত কিছু বলবে বা করবেÑ এটা প্রত্যাশিত না। তবে একটা বার্তা দেয়া হলো।
ড. মোমেনের দিল্লি সফরকালে আইওডির সাইডলাইনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। জয়শঙ্করের সাথে বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও জাতীয় নাগরিকপুঞ্জি (এনআরসি) রাখা হয়েছিল। গত ৯ ডিসেম্বর লোকসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল উত্থাপন করে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সংবিধানকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, এই দেশগুলোর রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বলেই সেখানে অন্য ধর্মের মানুষ নিপীড়িত হচ্ছে।
এর প্রতিক্রিয়ায় ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে ড. মোমেন বলেন, নাগরিকত্ব বিল ভারতের ঐতিহাসিক ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানকে দুর্বল করে দেবে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন না থামাটাই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আনার অন্যতম কারণ বলে ভারতের পার্লামেন্টে দেয়া বক্তব্য সঠিক নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি অত্যন্ত গভীর। আমাদের দেশে অন্য ধর্মের মানুষ নিপীড়িত নয়। সরকারি অনেক কর্মকর্তা অন্য ধর্মের অনুসারী। সব ধর্মের লোক এখানে আছেন।
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলটি ১১ ডিসেম্বর ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় পাস হয়েছে, যার প্রতিবাদে আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন রাজ্যে সহিংস বিক্ষোভ চলছে।
ভারতের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র রবিশ কুমার গত বৃহস্পতিবার দিল্লিতে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে কারো নাগরিকত্ব দিতে ভারতে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করা হয়নি। ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে যারা ভারতে এরই মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের দ্রুত ভারতীয় নাগরিকত্ব দেয়া এ আইনের লক্ষ্য। বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানে অতীতে ধর্মীয় নিপীড়ন হলেও বর্তমানে দেশ দু’টির সরকারগুলো ধর্মীয় সুরক্ষায় কাজ করছে। তবে পাকিস্তানে এখনো ধর্মীয় নিপীড়ন চলছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফর এবং জেআরসি বৈঠক স্থগিত হওয়া সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাবে রবিশ কুমার বলেন, কিছু বৈঠক স্থগিত হয়েছে। তবে আমাদের বুঝতে হবে, বাংলাদেশের সাথে ৭৫টিরও বেশি কাঠামোতে আমাদের আলোচনা হচ্ছে। দুই পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতেই আলোচনার তারিখ ঠিক করা হয়। তিনি বলেন, আমাদের দুই দেশের সম্পর্ক খুবই নিবিড়। দুই-একটি সফর স্থগিত হওয়ার নিরিখে এই সম্পর্ককে মূল্যায়ন করা উচিত না।
প্রিয়াঙ্কা নিয়েই ক্ষোভের শুরু ঢাকা-দিল্লিতে : গতকাল ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুই মাস আগে রাজধানীতে (দিল্লি) বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সাক্ষাৎকারে প্রাথমিকভাবে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর নাম ছিল না। মুজিব-কন্যার আগ্রহে কিছুক্ষণ পরে সেখানে পৌঁছান ইন্দিরার নাতনী। তাদের আলিঙ্গনাবদ্ধ ছবিটি প্রিয়ঙ্কার টুইটের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সোস্যাল মিডিয়ায়।
প্রতিবেদনে কূটনৈতিক সূত্রের ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়, ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে অধুনা শৈত্যের যে বাতাবরণ দেখা যাচ্ছে তার শুরু হয়েছিল সে দিনই। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে বড় ভূমিকা নেয়া প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পরিবারের প্রতি নৈকট্য সেদিন গোপন করেননি হাসিনা। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, মোদি সরকারের সাথে সহযোগিতা বজায় রেখেও নেহরু-গান্ধী পরিবারের প্রতি প্রীতির সম্পর্ক বজায় রাখতে চান তিনি। বিষয়টিতে কিছুটা আড়ষ্টতা তৈরি হয় সাউথ ব্লকে (ভারতের পররাষ্ট্র দফতর)। এর পরে যখন ক্রিকেট দেখতে কলকাতা পৌঁছান শেখ হাসিনা, বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে দিল্লি থেকে কোনো মন্ত্রী বা শীর্ষ কূটনীতিককে পাঠায়নি মোদি সরকার। এই বিষয়টি যথেষ্ট ক্ষুন্ন করেছে ঢাকাকে। বাংলাদেশের এক কূটনৈতিক কর্তার কথায়, ‘বাংলাদেশ সব ব্যাপারে পাশে থাকবে বলে ধরেই নিয়েছে নয়াদিল্লি। তাই কিছু ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে। শুধুমাত্র কলকাতা সফর তো নয়, অক্টোবরে নয়াদিল্লি সফরেও প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানাতে বিমানবন্দরে পাঠানো হয়েছিল প্রথমবারের সংসদ সদস্য এক নতুন মন্ত্রীকে। নরেন্দ্র মোদি নিজে না পারেন, কোনো সিনিয়র মন্ত্রীকে কি পাঠানো সম্ভব ছিল না ?’
এই মন কষাকষির মধ্যেই চলে আসে আসামে এনআরসি নিয়ে অশান্তি এবং এবং তার পরে নাগরিকত্ব আইন পাস করানোর প্রক্রিয়া। এর মধ্যে একবার নিউ ইয়র্কে রাষ্ট্রপুঞ্জের পার্শ্ববৈঠকে, অন্যবার অক্টোবরের নয়াদিল্লি সফরে এনআরসি নিয়ে মোদির কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন হাসিনা। নাগরিকত্ব আইন পাস করানোর সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পার্লামেন্টে বারবার পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশকে একই বন্ধনীতে রাখায় ঘৃতাহুতি হয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিসরে। আওয়ামী লীগের মধ্যে একটি কট্টর ইসলামী অংশ রয়েছে, যাদের মতামতকে গ্রাহ্য করে চলতে হয় প্রধানমন্ত্রীকে। তিস্তা চুক্তি নিয়ে সাড়া না-পাওয়া সত্ত্বেও, হাসিনা কেন উদার ভারতনীতি নিয়ে চলছেন, এই প্রশ্ন তুলেছে সেই কট্টর অংশ। নাগরিকত্ব আইনে বিষয়টি আরো জটিল হয়েছে।
প্রতিবেদনে ঢাকা সূত্রের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, পরপর দুই মন্ত্রী ও প্রতিনিধিদলের ভারত সফর বাতিল করে সেই অভ্যন্তরীণ রোষকে ধামাচাপা দিতে পেরেছেন আওয়ামী লীগ নেত্রী। বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর বাতিল হওয়ার পরে চলতি সপ্তাহের মাঝামাঝি ঢাকার তরফ থেকে বাতিল করে দেয়া হয় দুই দেশের যৌথ নদী কমিটির বৈঠকও। ঢাকা সূত্রের খবর, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জলসম্পদ মন্ত্রককে জানিয়ে দেন, তাড়াহুড়া করে দিল্লি যাওয়ার প্রয়োজন নেই। বলে দেয়া হোক সংশ্লিষ্ট নদী সংক্রান্ত যথেষ্ট তথ্যাদি বিশ্লেষণ করা হয়নি। এর পেছনে যে নির্দিষ্ট কূটনৈতিক বার্তা দেয়ার ছিল, দিল্লিকে তা পৌঁছে দেয়া গেছে বলেই মনে করছে ঢাকা।
ভারতে অস্থিরতা প্রতিবেশীদের ওপর প্রভাব ফেলে : গতকাল ভারতীয় বার্তা সংস্থা পিটিআইকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেছেন, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তবে দেশটিতে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে তাতে প্রতিবেশীদের ওপর প্রভাব পড়তে পারে।
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে ভারতে চলমান বিক্ষোভের ব্যাপারে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এটা উদ্বেগজনক। আমরা আশা করছি, পরিস্থিতি শান্ত হবে এবং ভারত এটা থেকে মুক্ত হবে। তবে এটা আমাদের নয়, ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এটা ভারতকে ফয়সালা করতে হবে। তিনি বলেন, ভারত সরকার আমাদের বারবার আশ্বস্ত করেছে, এনআরসি তাদের অভ্যন্তরীণ ইস্যু। তারা আইনি এবং অন্যান্য কারণে এটির বাস্তবায়ন করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে কথা বলার সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আশ্বস্ত করেছেন, কোনো অবস্থায়ই এটি বাংলাদেশের ক্ষতি করবে না।
ভারতের প্রতি বাংলাদেশের আস্থা রয়েছে বলে মন্তব্য করে ড. মোমেন বলেন, আমরা ভারতের এক নম্বর বন্ধু। তাই ভারতে কোনো অনিশ্চয়তা তৈরি হলে প্রতিবেশীদের ওপর এর প্রভাব পড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে যখন অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছিল, তখন এটি অনেক দেশের ওপর প্রভাব ফেলেছে। কারণ আমরা গ্লোবাল ওয়ার্ল্ডে বসবাস করছি।