শ্রীলঙ্কায় চীন-ভারত খেলা
শ্রীলঙ্কায় চীন-ভারত খেলা - ছবি : সংগৃহীত
তিন বছর আগে নেপালের নতুন সংবিধানের বিষয়বস্তু নিয়ে ভারতের নির্দেশনা যে রূঢ়ভাবে খারিজ করে দিয়েছিল দেশটির কমিউনিস্ট নেতৃত্ব, মোদি সরকার ঠিক একই ধরনের প্রত্যাখ্যানের মুখে পড়তে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কায়। বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসা কলম্বোভিত্তিক বিদেশী সাংবাদিকদের জন্য একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন এটা নিশ্চিত করার জন্য যে দিল্লির উচিত হবে মাত্তালা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনার বিষয়টি ভুলে যাওয়া।
তিনি বলেন, এই প্রকল্প নিয়ে ভারতের সাথে কোনো আলোচনা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে মাত্র তিন সপ্তাহ আগে নয়া দিল্লি সফর করার পর তিনি এ মন্তব্য করলেন। ওই সফরকালে গোতাবায়ার সাথে এক সংবাদ সম্মেলনে মোদি শ্রীলঙ্কার জন্য ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের ঋণের কথা ঘোষণা করেছিলেন।
মাত্তালা হলো চীনা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একটি কোম্পানির পরিচালনায় থাকা হাম্বানতোতা বন্দরের জন্য ফিডার বিমানবন্দর। হাম্বানতোতায় চীনা কার্যক্রম নজরদারি করার জন্য মাত্তালা হতে পারে আদর্শ স্থান। সম্ভবত এ কারণেই শ্রীলঙ্কা মাত্তালায় কোনো ভারতীয় উপস্থিতি অনুমোদন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হয়তো এ ব্যাপারে কলম্বোর ওপর প্রভাবকে কাজে লাগিয়েছে চীন।
স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে, কৌশলগত তাৎপর্যপূর্ণ যেকোনো প্রকল্প থেকে ভারতকে সরিয়ে রাখতে চায় শ্রীলঙ্কা। গোতাবায়ার নির্বাচনী সাফল্যের পর মোদি তাকে মুগ্ধ করার জন্য যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করা যায়। গোতাবায়া বরং উল্টা ছক্কা হাঁকিয়েছেন কলম্বোতে তার প্রথম রাষ্ট্রীয় অতিথি হওয়ার জন্য মোদিকে জোরালোভাবে আমন্ত্রণ জানিয়ে।
বৃহস্পতিবারের সংবাদ সম্মেলনে গোতাবায়া আরো ঘোষণা করেন যে হাম্বানতোতা বন্দর প্রকল্প নিয়ে তিনি নতুন করে আর আলোচনা করবে না। কারণ চীনা কোম্পানিটির সাথে একটি চুক্তি ইতোমধ্যেই হয়েছে গেছে। কলম্বো বরং এটিই খতিয়ে দেখবে যে বন্দরটির পুরো নিয়ন্ত্রণ শ্রীলঙ্কার হাতে আছে কিনা।
সিনহুয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী, গোতাবায়া আরো বলেছেন যে সফররত চীনা দূতের মাধ্যমে চীনকে এসব ব্যাপারে তার উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। সম্প্রতি ওই দূত শ্রীলঙ্কা সফর করেছে। আর চীনও নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিয়ে শ্রীলঙ্কা সরকারের সাথে আলোচনা করতে সম্মতি প্রকাশ করেছে।
দুই পক্ষের কথাবার্তা আমলে নিয়ে তা ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্টের জন্য বড় ধরনের একটি আঘাত মনে হতে পারে। দিল্লি আশা করেছিল যে হাম্বানতোতার কৌশলগত অবস্থানে চীনের উপস্থিতির ব্যাপারে গোতাবায়া বেইজিংয়ের ওপর আরো কঠোর হবে। আর ভারত মাত্তালা থেকে বন্দরটির ওপর নজরদারি চালাতে পারবে।
কলম্বোর কাছ থেকে এ ধরনের প্রচণ্ড শীতল আঘাতের কী ব্যাখ্যা আছে? বস্তুত, শ্রীলঙ্কা ঐতিহ্যগতভাবেই ভারতীয় উপস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাদের মধ্যে এমন ধারণা সৃষ্টি হওয়ার (অবশ্য কেবল শ্রীলঙ্কাই নয়, পুরো অঞ্চলেই) কারণ হলো, তারা মনে করছে ভারত হয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের তাবেদার।
সহজভাবে বলা যায়, চীনকে সংযত করার যুক্তরাষ্ট্র-ভারত ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির অংশ হতে চায় না শ্রীলঙ্কা। এটি হলো একটি বিষয়।
দু’দিন আগে ওয়াশিংটন জোরালোভাবে জানায় যে ওয়াশিংটনে চলতি সপ্তাহে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের২+২ সংলাপে শ্রীলঙ্কা ও নেপাল প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে। বস্তুত, যুক্তরাষ্ট্র-ভারতীয় উদ্দেশ্য নিয়ে কলম্বো চরমভাবে উদ্বিগ্ন।
গত মাসে গোতাবায়ার বিজয়ের ব্যাপারে ওয়াশিংটন অবন্ধুসুলভ পরিভাষায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেইও তার বার্তায় কার্যত এলটিটিইর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময়ে গোতাবায়ার মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি নতুন করে সামনে আনার হুমকি দিয়েছেন।
সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, পারস্পরিকভাবে সন্তোসজনক একটি ফরমুলা কাজ করছে কলম্বো ও বেইজিংয়ের মধ্যে। ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগগুলো সামাল দেবে শ্রীলঙ্কা, আর চীন ২০১৭ সালের চুক্তি অনুযায়ী হাম্বানতোতার ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখবে।
শ্রীলঙ্কা কর্তৃপক্ষ জানে যে ভারতীয় বিশ্লেষকেরা কলম্বোর এই আশ্বাসে আস্থা আনতে পারছে না যে হাম্বানতোতা বন্দরটি বেসামরিক এবং তাতে তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকবে। ভারতীয় বিশ্লেষকদের হিসাব অনুযায়ী ভারতের কাছাকাছি চীনা নৌবাহিনীর একটি চৌকি স্থাপনের কাজ করছে চীন। তবে চীনও এখন আর নমনীয় ভাষায় কথা বলছে না। তারাও এখন শ্রীলঙ্কায় তাদের অবস্থান জোরদার করার চেষ্টায় নেমেছে।
তবে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো কলম্বো বন্দরের ইস্ট কন্টেইনার টার্মিনাল (ইসিটি) উন্নয়ন প্রকল্পের ভবিষ্যত কী হবে? এটি ভারতের দীর্ঘ দিনের স্বপ্নের প্রকল্প। প্রকল্পটি যৌথভাবে সম্পন্ন করার জন্য মে মাসে ভারত ও জাপান একটি সমঝোতা স্মারকে সই করেছে। প্রকল্পটির জন্য জাপান ৫০০ মিলিয়ন ঋণের প্রস্তাব দিয়েছে।
গত মাসে গোতাবায়া ক্ষমতায় আসার পরপরই সিনহুয়া এক প্রতিবেদনে জানায় যে নতুন সরকার দ্রুততার সাথে ইসিটি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চায়। ভারত কি তা করতে পারবে? আগামী মাসগুলোতে এটিই হবে একটি গল্পের সারকথা।
ইন্ডিয়ান পাঞ্চলাইন