হেলিশ হিটওয়েভ : একটি ধ্বংসযজ্ঞ
হেলিশ হিটওয়েভ : একটি ধ্বংসযজ্ঞ - ছবি : সংগ্রহ
সর্বসাম্প্রতিক খবর : অস্ট্রেলিয়ার ওপর দিয়ে এখন বাইছে ‘হেলিশ হিটওয়েভ’ বা নরকতুল্য তাপতরঙ্গ। দেশটির নর্থ ওয়েস্ট ওয়েলস টেরিটরিতে ঘোষণা করা হয়েছে জরুরি অবস্থা। কারণ সেখানকার এই রেকর্ডভাঙা তাপতরঙ্গ দেশটির বনাঞ্চলের চলমান দাবাগ্নি পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ করে তুলতে পারে। এই হিটওয়েভ অব্যাহত থাকলে দেশটির তিনটি রাজধানী শহর সিডনি, অ্যাডিলেট ও ক্যানবেরার তাপমাত্রা এই ডিসেম্বরেই ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যেতে পারে।
প্রসঙ্গত, অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছে আটটি রাজধানী শহর। এগুলো দেশটির বিভিন্ন স্টেট বা টেরিটরিতে অবস্থিত। যে রাজধানী শহর যে স্টেট বা টেরিটরিতে অবস্থিত সেটি সে স্টেটের বা টেরিটরির রাজধানী হিসেবে বিবেচিত। তবে ক্যানবেরা হচ্ছে দেশটির জাতীয় রাজধানী। সে যা-ই হোক, অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্কে ‘অ্যালডারাডো ওয়েদার’ ও ‘দ্য ব্যুরো অব মেটিওরোলজি’ আরো খারাপ সংবাদ আমাদের জানিয়েছে। গত ১৮ ডিসেম্বর নেয়া উপাত্ত থেকে এই দু’টি প্রতিষ্ঠান দেখতে পেয়েছে, ওই দিনে বিশ্বের সব থেকে বেশি তাপমাত্রার ১৫টি স্থানের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায়ই রয়েছে ১৪টি। এ থেকে অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান পরিবেশ-প্রতিবেশ সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা পাওয়া যায়।
এ দিকে বর্তমানে বিশ্বের বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪০৮ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন)। অন্য দিকে মিথেইন ও নাইট্রাস অক্সাইডসহ গ্রিনহাউজ গ্যাসের মাত্রা পৌঁছেছে ৫০০ পিপিএম কার্বন ডাই-অক্সাইডের সমতুুল্যে। এর প্রভাবে গ্রিনল্যান্ড ও অ্যান্টার্কটিকার বরফস্তূপ গলে চলছে এক ত্বরান্বিত গতিতে, আর তা এই বরফ গলার হারকে এক হুমকির মাত্রায় উপনীত করেছে। অন্য দিকে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে চলার কারণে গোটা পৃথিবী তেতিয়ে উঠছে, পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে দাবাগ্নি। এখন আমরা দাবাগ্নির খবর পাচ্ছি ক্যালিফোর্নিয়া, আলাস্কা, সাইবেরিয়া, সুইডেন, স্পেন, পর্তুগাল, গ্রিস, এঙ্গোলা ও অস্ট্রেলিয়াসহ আরো অনেক স্থান থেকে। এর ফলে মানব বসতির ব্যাপক ধ্বংস সাধন হচ্ছে। আর বনাঞ্চল উজাড় হওয়ার ফলে তা ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে গোটা প্রাণিজগতের বসবাসের ও খাবারের ওপর। এর প্রভাবেই আজ নানা প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কায় পড়েছে। কিছু কিছু প্রজাতির প্রাণী ইতোমধ্যেই পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে।
অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে ফসিল জ্বালানি বেড়ে যাওয়ার ফলে বায়ুমণ্ডলে আজ পর্যন্ত অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড জমা হয়েছে ৯১০০০ কোটি মেট্রিক টন। এর ফলে বায়ুমণ্ডলের আজ কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা দাঁড়িয়েছে ৪০৮ পিপিএম। শিল্পযুগ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে এই মাত্রা ছিল ২৮০-৩০০ পিপিএম। একুশ শতাব্দীর শুরু থেকে বায়ুমণ্ডলে এই কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বছরে বাড়ছে ২ থেকে ৩ পিপিএম হারে। এর সাথে সালফার ডাই-অক্সাইড ও এয়ারোসোলের কারণে শিল্পযুগের আগের তুলনায় পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে গেছে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বর্তমান গ্রিনহাউজ গ্যাস ও বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বেড়ে পৌঁছে যাচ্ছে মিলোসিনের মতো (৫.৩ থেকে ২৩ মিলিয়ন বছরের আগের সময়ের) কম্পোজিশনে। বর্তমান কার্বন ডাই-অক্সাইডের বেড়ে চলার মাত্রা কে-টি অ্যাস্টেরয়েডের প্রভাবের (৬৬.৪ মিলিয়ন বছর আগের) সময়ের সবচেয়ে দ্রুত বেড়ে চলার মাত্রা এবং PETM (Paleocene-Eocene Temperature Maximum) hyperthermal ইভেন্টের (৫৫.৯ মিলিয়ন বছর আগের) সময়ের মাত্রা ছাড়িয়েছে। বর্তমানে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের বেড়ে চলার মাত্রা গত বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
পাঁচ বছর আগে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা প্যারিসে সমবেত হয়েছিলেন একটি আবহাওয়া চুক্তি স্বাক্ষরের লক্ষ্যে। বিশ্বের প্রায় সব দেশ শেষ পর্যন্ত একটি চুক্তিতে উপনীত হয়। এতে তারা সম্মত হয়, বিশ্বের তাপমাত্রা শিল্পযুগের আগে যে মাত্রায় ছিল তার থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়তে দেয়া যাবে না। বৈশ্বিকভাবে ফসিল জ্বালানি কমিয়ে আনতে হবে। ১৯১৫ সালের প্যারিস সম্মেলনের পর আজকে বৈশ্বিক ব্যাংকগুলো ফসিল জ্বালানি প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ করেছে ১৯ লাখ ডলার। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন সরকার পরিকল্পনা নিয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে ফসিল জ্বালানি ব্যবহার বাড়াবে ১২০ শতাংশ। এসব দেশের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, সৌদি আরব, ভারত, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া। অথচ খবর আসছে, এই অস্ট্রেলিয়ায় এখন বইছে নরকতুল্য তাপতরঙ্গ, যা এ লেখার শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে।
তা ছাড়া বিগত দেড় বছর সময়ে চীন নতুন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়েছে ৪৩ গিগা ওয়াট। এই বিদ্যুতের সংযোগ পাবে ৩ কোটি ১০ লাখ নতুন বাসাবাড়ি। চীন পরিকল্পনা করছে আরো ১৪৮ গিগা ওয়াট শক্তিসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে। এটি হবে গোটা ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার সমান। এ দিকে ভারত গত সাত বছরে কয়লাচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়েছে ৭৪ শতাংশ। দেশটি আশা করছে, আগামী তিন বছরে এই কয়লাচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়বে আরো ২২ শতাংশ। বিশ্বব্যাপী চীনের বাইরে নতুন কয়লাচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ২৫ শতাংশেই অর্থ জোগান দিচ্ছে চীন। এসব দেশ হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। এরই মধ্যে চীন নবায়নযোগ্য জ্বালানি চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৩০ শতাংশ ভর্তুকি দেয়ার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে যাচ্ছে।
একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রস্তাব দিয়েছেন নবায়নযোগ্য বাজেটের বরাদ্দ কমিয়ে আনতে। কারণ তার প্রশাসন ফসিল জ্বালানিকে নতুন করে ব্র্যান্ড দিয়েছে ‘Molecules of U.S. Freedom’ হিসেবে। চলতি বছরের মে ৩০ সংখ্যার ‘ফর্বস’ সাময়িকীতে এর উল্লেখ আছে। এ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোত্তরের শহর আলাস্কার অঙ্গরাজ্যের ‘ব্যারো’তে অভাবনীয় মাত্রায় ঘটছে মিথেন গ্যাসের নির্গমন এবং তা চলছে চার মাস ধরে। এ বিষয়টি মনিটর করছেন ড. পিটার কার্টার। মাদ্রিদে গত ২-১৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত COP25 (Conference of the Parties25) নামের সম্মেলনে বিভিন্ন দেশ থেকে ২৫ হাজার প্রতিনিধি যোগ দেন। এরা এখানে সমবেত হয়েছিলেন বৈশ্বিক আবহাওয়া পরিবর্তনের সর্বশেষ পরিস্থিতি বিস্তারিত জানতে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ পরিবর্তন পরিস্থিতিকে জানা কি আরো অব্যাহত থাকবে? সব কিছু দেখেশুনে যা মনে হচ্ছে, তা অব্যাহত থাকবে না। আসলে এটি হচ্ছে আবহাওয়া সম্পর্কিত সাইডশোর আরেকটি পুনরাবৃত্তি। ব্যাপারটিকে আরো মগ্নচৈতন্য বা পরাবাস্তব করে তুলতেই উপরে বর্ণিত ২০৩০ সালের মধ্যে ফসিল জ্বালানি ১২০ শতাংশ বাড়িয়ে তোলার ‘ডেথ-ডিফাইনিং’ পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। স্টকহোম এনভায়রনমেন্ট ইনস্টিটিউট দাবি করেছে, বিশ্ব এখন শিল্পযুগোত্তর ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের পথে রয়েছে, সম্ভবত সে পথ বন্ধ হয়ে যাবে। এর কারণ বিশ্বজুড়ে ফসিল জ্বালানি ব্যবহারের সম্প্রসারণ।
গত ২০ জুনে প্রকাশিত ‘ডিকার্বনেজাইজিং সাউথ অ্যান্ড সাউথ ইস্ট এশিয়া’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে- বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে এর কয়লাচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের অবদান ৩৫ শতাংশে পৌঁছাবে। অর্থাৎ বাংলাদেশ এর কয়লাচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন তিনগুণ বাড়াবে। যদিও এ সম্প্রসারণ প্যারিস চুক্তির সাথে সামঞ্জস্যহীন। বাংলাদেশ এই চুক্তির স্বাক্ষরদাতা একটি দেশ।
কিন্তু যে সতর্কবার্তার পর সতর্কবার্তা আইপিসিসি (ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) ইতোমধ্যেই পৃথিবীর মানুষকে জানিয়ে দিয়েছে, তা থেকে জানা যায় আর মাত্র ২ ডিগ্রি তাপমাত্রা বাড়লেই পৃথিবী ধ্বংসের দুয়ারে গিয়ে দাঁড়াবে। শুধু তা-ই নয়, বিজ্ঞানীরা একমত, দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লেই দুঃসহ ও বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে পৃথিবীর অনেক অঞ্চল। তার আভাস পাই যখন শুনি অস্ট্রেলিয়ায় এখন বইছে নরকতুল্য তাপতরঙ্গ তথা ‘হেলিশ হিটওয়েভ’।
সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, আমাদের পৃথিবীতে ফসিল জ্বালানির প্রবৃদ্ধির হারটা ব্যাপক পর্যায়ে রয়েছে। এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা বারবার কঠোর সতর্কবার্তা উচ্চারণ করছেন। তারা বলছেন, কার্বন উদগীরণের মাত্রা অবশ্যই একদম শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। তা না হলে অচিরেই পৃথিবীটা পরিণত হবে একটি ‘হট হাউজ’-এ। আজ আমরা যেমন একটি পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে, তাতেই মনে হয় পৃথিবী নামের ‘হট হাউজ’র তাপে আমরা সেঁকা হতে শুরু করে দিয়েছি। অস্ট্রেলিয়া এর জায়মান উদাহরণ। হট হাউজ বলতে আমরা বুঝতে পারছি, পৃথিবীটা এখন একটি অতিমাত্রিক উত্তপ্ত বস্তু, যার তাপ ধ্বংস করতে শুরু করেছে আমাদের ইকোসিস্টেম তথা প্রতিবেশ-পরিবেশ ব্যবস্থা; যার ফলে পৃথিবীটা ক্রমেই দুঃসহ হয়ে উঠছে প্রায় ৭৮০ কোটি মানুষের জন্য।
আমাদের মনে রাখতে হবে, এ পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ একে অপরের ভাই। এক আদম থেকেই আমাদের সৃষ্টি। আমাদের বসবাসের পৃথিবী একটাই। আমাদের জীবন একটাই। আমরা যদি পরস্পর পরস্পরের সাথে হাত মিলাই তবেই সুন্দর হয়ে উঠতে পারে আমাদের পৃথিবী। ফেরাতে পারি এই পৃথিবীকে ‘হট হাউজ’ হয়ে ওঠার হাত থেকে। তখন নিরাপদ হতে পারে আমাদের আজকের ও আগামী প্রজন্মের বসবাস। বিশ্বের প্রতিটি সরকারকে এই উপলব্ধি নিয়েই কাজ করতে হবে। তবেই যদি আমরা ঠেকাতে পারি এই পৃথিবীটাকে বিপজ্জনকভাবে তেতিয়ে ওঠা থেকে।