আফগান যুদ্ধে যেভাবে হেরে গেল যুক্তরাষ্ট্র
আফগান যুদ্ধে যেভাবে হেরে গেল যুক্তরাষ্ট্র - ছবি : সংগ্রহ
ওটা ছিল অজেয় এক যুদ্ধ। কিন্তু মিথ্যার বেসাতিতে সেটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। যে যুদ্ধটি ভুল ছিল সেটা নিয়ে প্রায় দুই দশক ধরে মার্কিন জনগণকে সে দেশের নেতারা ভুল পথে পরিচালিত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে ২০০১ সালে আফগানিস্তানে গিয়েছিল। যে দেশটিকে ‘সাম্রাজ্যবাদের কবরস্থান’ হিসেবে প্রায়ই বর্ণনা করা হয়ে থাকে- সে সম্পর্কে ভালোভাবে না জেনেই আমেরিকা আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালায়।
বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সামরিক ক্ষমতার অধিকারী দেশটি যদি মনে করে তারা যুদ্ধে হেরে যায়নি- তা হলে বলতে হয় তারা যুদ্ধে জয়ীও হতে পারেনি। ২০০১ সাল থেকে আমেরিকার তিনজন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ, বারাক ওবামা ও ডোনাল্ড ট্রাম্প সবাই এবং তাদের সামরিক কমান্ডাররা আফগানিস্তানে জয়লাভের ব্যাপারে তাদের প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেননি। ওয়াশিংটন পোস্টে ‘দ্য আফগানিস্তান রিপোর্ট’ নামে প্রকাশিত একটি তদন্ত প্রতিবেদনে যুদ্ধ ক্ষেত্রের বিবর্ণ বাস্তবতা লুকানোর জন্য সত্যকে কিভাবে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে দেয়ার প্রয়াস চালানো হয়েছে তা প্রকাশ করা হয়েছে। হাজার হাজার পৃষ্ঠার সরকারি নথি ও দলিল এবং কনফিডেনশিয়াল সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। রিপোর্টে আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বে পরিচালিত ১৮ বছরব্যাপী যুদ্ধে মিথ্যাচার ও ব্যর্থতার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে।
আমেরিকার যুদ্ধ প্রয়াসে দুর্নীতি ও অদক্ষতার অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে ফেডারেল এজেন্সি সিগার প্রজেক্টের জন্য এসব সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছিল। সাক্ষাৎকারের পাণ্ডুলিপিগুলো ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশ করার জন্য পত্রিকাটিকে তিন বছর পর্যন্ত আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে। ‘দ্য আফগানিস্তান পেপারস’ হচ্ছে পেন্টাগন পেপারসের পুনরাবৃত্তি বা প্রতিধ্বনি। আর পেন্টাগন পেপারস হচ্ছে ভিয়েতনাম যুদ্ধের গোপন সামরিক ইতিহাস। ভিয়েতনাম যুদ্ধের ওই গোপন সামরিক ইতিহাস ১৯৭১ সালে ফাঁস হয়ে যায় এবং সরকারের মিথ্যাচার জনসমক্ষে প্রকাশ হয়ে পড়ে। এটা ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না- ওই বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তির মতো।
পদস্থ কর্মকর্তারা সাক্ষাৎকারে তাদের হতাশার অনুভূতি যেভাবে প্রকাশ করেছেন তাকে আমেরিকার সামরিক ও বেসামরিক নেতৃবৃন্দ সরকারি বিবৃতির মাধ্যমে যা প্রকাশ করেছেন তার সাথে তুলনা করা হয়। রিপোর্টে স্পষ্ট নীতি বা কৌশলের অভাব এবং সাংঘর্ষিক উদ্দেশ্য লক্ষ্যের কারণে যুদ্ধে ভরাডুবির পথ পরিষ্কার হয় বলে উল্লেখ করা হয়।
৯/১১ হামলার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ২০০১ সালের অক্টোবরে আমেরিকানরা যখন আফগানিস্তানে হামলা চালিয়েছিল তখন আফগানিস্তান সম্পর্কে তাদের যে কোনো জ্ঞান বা জানাশোনা ছিল না- সেটা বুশ প্রশাসন ও ওবামা প্রশাসনের ‘ওয়ারজার’ সেনাবাহিনীর তিন তারকা জেনারেল ডগলাস লোট ভালোভাবেই বর্ণনা করেছেন।
তিনি বলেন, ‘আফগানিস্তানের ব্যাপারে আমাদের কোনো মৌলিক উপলব্ধি বা ধারণাও ছিল না। আমরা কী করতে যাচ্ছি- সেটাও আমরা জানতাম না। জেনারেল লোট ২০১৫ সালে এক সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে এ কথা বলেছিলেন। তার উদ্ধৃতি দিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টের এক রিপোর্টে বলা হয়, ‘আমরা এখানে কী করার চেষ্টা করছি? মার্কিন প্রশাসনের মধ্যেই আফগানিস্তানের মার্কিন আগ্রাসন চালানোর লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে মৌলিক অসম্মতি ছিল। কিছু মার্কিন কর্মকর্তা আফগানিস্তানকে একটি রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসতে চাইলেও অন্যরা তাদের অভিমত অনুসারে নারী অধিকারসহ আফগান সংস্কৃতি বদলে দিতে চান। রিপোর্ট অনুসারে, কেউ কেউ পাশের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য দেখতে চান।
আমেরিকা এই যুদ্ধকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়ে এটাকে একটি দীর্ঘতম যুদ্ধে পরিণত করেছে- আমেরিকা এত দীর্ঘ সময় ধরে আর কোনো যুদ্ধে লিপ্ত ছিল না। এই যুদ্ধে লাখ লাখ আফগান নাগরিক মৃত্যুবরণ করেছে। আমেরিকার এক ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে। শিগগির যেকোনো সময়ে এই যুদ্ধ শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না।
২০০১ সাল থেকে আফগানিস্তানে সাত লাখ ৭৫ হাজারেরও বেশি মার্কিন সৈন্য মোতায়েন করা হয়। তাদের মধ্যে যুদ্ধে দুই হাজার সৈন্য নিহত এবং ২০ হাজারেরও বেশি আহত হয়। রিপোর্টে দেখানো হয় কংগ্রেস, পেন্টাগন ও পররাষ্ট্র দফতরে সম্পূর্ণরূপে একটি আমলাতান্ত্রিক পতন ঘটে এবং ফলে সামরিকভাবে আমেরিকা ব্যর্থ হয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, সামরিক কমান্ডার ও কূটনীতিকরা তাদের দেশবাসীকে আফগান যুদ্ধে আমেরিকা লাভবান হয়েছে বলে আশ্বস্ত করে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন রিপোর্টে তার সাথেও দ্বিমত পোষণ বা অস্বীকার করা হয়। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এই যুদ্ধকে একটি ‘ভালো যুদ্ধ’ বলে ঘোষণা করেছিলেন।
রিপোর্ট অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র সরকার সুচিন্তিতভাবে জনগণকে ভুল পথে পরিচালনার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। ‘যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে জয়লাভ করতে যাচ্ছে বলে কাবুলের সামরিক সদর দফতর এবং হোয়াইট হাউজ অভিন্নভাবে মিথ্যা পরিসংখ্যান তুলে ধরে মার্কিন জনগণকে বিভ্রান্ত করে- অথচ সেটা সঠিক ছিল না।’
রিপোর্টে মার্কিন সামরিক কমান্ডারের সিনিয়র কাউন্টার ইনসারজেন্সি উপদেষ্টার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, সম্ভাব্য সর্বোত্তম প্রতিচ্ছবি বা অবস্থা উপস্থাপন করার জন্য সত্যিকারের অবস্থাকে বেশ কয়েকবার পরিবর্তন করে অন্যভাবে তুলে ধরা হয়। তিনি সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে বলেন, ‘উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যেসব জরিপ করা হয়েছে সেগুলো মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়, অথচ আমরা যা করে যাচ্ছি তা সঠিক বলে জোর দিয়ে উল্লেখ করা হয় এবং আমরা নিজেরাই আইসক্রিম চেটে খাওয়ার কোনি বা শঙ্কুতে পরিণত হয়েছি।’
রিপোর্টে পদস্থ কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে সবার সামনে লক্ষণীয়ভাবে তুলে ধরা হয়, ‘চলমান দুর্নীতি হ্রাস করে একটি দক্ষ আফগান সেনা ও পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার জন্য মার্কিন সরকারের কলঙ্কিত উদ্যোগগুলো এবং আফগানিস্তানের সফল আফিম বাণিজ্যের বিষয়।’ যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার বেশির ভাগ অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র যুদ্ধবাজ নেতা (ওয়ারলর্ডস) এবং আফগান কর্মকর্তাদের কাছে সরবরাহ করা হয়। কিছু অত্যন্ত ভুল নীতির ফলে আফগানিস্তান একটি নারকো বা অসাড় বা আকর্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
আফগান ন্যাশনাল আর্মি বা সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য নিরাপত্তা কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি বা সিকিউরিটি পার্সোনালদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্য করে গড়ে তুলতে শত শত কোটি ডলার ব্যয় করা সত্ত্বেও আমেরিকার সমর্থন ছাড়া আফগান সৈন্যরা তালেবানদের মোকাবেলা করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। তালেবানদের সাথে যুদ্ধে ৬৪ হাজারেরও বেশি আফগান সৈন্য নিহত হয়েছে। যুদ্ধে হতাহত আফগান সৈন্যের সংখ্যা আমেরিকান সৈন্যদের চেয়ে অনেক বেশি। গোপন সাক্ষাৎকারে মার্কিন সামরিক প্রশিক্ষকরা আফগান নিরাপত্তা বাহিনীকে, ‘অদক্ষ, লক্ষ্য উদ্দেশ্যহীন ও ভীতসন্ত্রস্ত বলে বর্ণনা করেন।’ তারা আফগান কমান্ডারদের বিরুদ্ধে ‘হাজার হাজার জাতিগত সৈনিক’ বা ভৌতিক সৈন্যের নামে বেতন তুলে নিজেরাই ভোগ করার অভিযোগ আনেন। অথচ এ অর্থের বেশির ভাগ মার্কিন করদাতাদের কাছ থেকে আসছে। আফগান সেনাবাহিনী ও পুলিশ তালেবানদের প্রতিরোধ করতে পারবে বলে কেউই মনে করেন না। তারা মনে করেন, তালেবানদের কাছে এসব সৈন্য ও পুলিশ নির্ঘাত পরাজয় বরণ করবে। কিন্তু তাদের আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে মার্কিন জেনারেলরা ঘোষণা করেন, তারা তাদের কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ও কৌশল অনুসারে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছেন। আফগান সেনাবাহিনী এবং জাতীয় পুলিশ বাহিনী বিদেশী সহায়তা ছাড়াই যেন দেশকে রক্ষা করতে পারে- সে জন্য তারা তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন।
আফগানিস্তানে আমেরিকান সৈন্যদের ব্যর্থতা দীর্ঘ দিন ধরে প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও ওয়াশিংটনে আফগান যুদ্ধ নিয়ে বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তি অনেকটা প্রকাশ হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়া আলোচনা যখন পুনরুজ্জীবিত হতে যাচ্ছে তখন এই রিপোর্ট প্রকাশ হলো। দু’পক্ষের মধ্যকার আলোচনার সময় এই রিপোর্টের কিছুটা প্রভাব হয়তো পড়তেও পারে। এতে নিশ্চিতভাবে তালেবানদের আস্থা ও দৃঢ়তা আরো বেড়ে যাবে।
লেখক : গ্রন্থকার ও সাংবাদিক
ডন থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার