ঠাট্টা-তামাশা নিয়ে ইসলাম কী বলে
ঠাট্টা-তামাশা নিয়ে ইসলাম কী বলে - ছবি : সংগ্রহ
প্রাঙ্ক ইংরেজি শব্দের অর্থ কৌতুক, ঠাট্টা, তামাশা, ক্রীড়া ইত্যাদি। প্রাঙ্ক অডিও এবং ভিডিও বর্তমান ভার্চুয়াল বিশ্বে বিনোদনের একটা সহজ উপায় হিসেবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। সন্দেহ নেই, এটির উপকারিতার চেয়ে অপকারিতাই বেশি। ফলে সমাজে এটির ভয়াবহতাও প্রকাশ পাচ্ছে। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের উন্নতির সাথে সাথে বিনোদনের উপকরণগুলো সহজলভ্য হওয়ার কারণে যে কেউ এসব ভিডিও কিংবা অডিও তৈরি করতে যেমন সক্ষম হচ্ছে, তেমনি তা নিজেদের ইউটিউব ফ্রি চ্যানেলে প্রকাশের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনেরও মাধ্যম হচ্ছে। কিন্তু মানব কল্যাণকর অনেক বিষয় সেখানে উপেক্ষিত হচ্ছে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি সহজ হবে।
ইউটিউবে একটি বাংলা প্রাঙ্ক ভিডিওতে দাবি করা হয়েছে যে, ভিডিওটি করার সময় ভিকটিম অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত তাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছিল! বিষয়টি মজার হিসেবে দেখছেন? চিন্তা করুন ওই ব্যক্তির কথা? নিজেকে সেই চরিত্রে কল্পনা করুন তো? কেমন লাগবে? কোনো সচেতন মানুষই চাইবেন না নিজে ওই রকম পরিস্থিতির মধ্যে গিয়ে অন্যের হাসির খোরাক হবেন। অনলাইনে আরো একটি তথ্য পেয়েছিলাম যে, যুক্তরাজ্যের এক নার্স প্রাঙ্ক ফোনকলের শিকার হয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছিলেন। এটি মোটেও অবাস্তব নয়। প্রাঙ্কের বেশির ভাগ ভিডিও দেখলে যে কেউ তা অনুধাবন করতে পারবে।
ইসলাম পরিপূর্ণ জীবন বিধান হিসেবে দৈনন্দিন জীবনে হাসি-তামাশা করাকে বৈধতা দিয়েছে শর্তসাপেক্ষে। রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবদ্দশায় আমরা তার কতিপয় উদাহরণও লক্ষ করি। ফলে, কেউ কেউ পরিমিতভাবে কৌতুক ও হাসি-ঠাট্টা করাকে সুন্নত হিসেবেও আখ্যা দিয়েছেন। আনাস রা: থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে এসে বাহনের জন্য একটি উট চাইলে রাসূল সা: তাকে একটি উটের বাচ্চা দিতে বললেন। ফলে, ওই ব্যক্তি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সা:, আমি কিভাবে উটের বাচ্চার পিঠে চড়ব? প্রতিউত্তরে রাসূল সা: বললেন, ‘প্রত্যেক উটই তো কোনো না কোনো উটনীর বাচ্চা’ (সুনানু আবু দাউদ-৯২)। এভাবে সত্য বলার মধ্য দিয়ে তিনি সা: কখনো কখনো কৌতুক করতেন। উমর বিন খাত্তাব রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আমি কৌতুক করি কিন্তু সত্য বৈ কিছুই বলি না’ (আত-তাবরানি, আল-মুজাম আস-সাগির, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৫৯; আলবানি, সহিহ আল-জামি: ২৪৯৪)। অতএব এভাবে কৌতুক-তামাশা করা বৈধ হলেও যেভাবে বর্তমান সমাজে প্রাঙ্ক করা দেখছি, তার বেশির ভাগই বর্জনীয়। ইসলাম কৌতুক-তামাশার ব্যাপারে যেসব মূলনীতি করে দিয়েছে, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হলো-
মিথ্যা সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য : ‘মিথ্যা বলা কবিরা (বড়) গুনাহ। এটি মুনাফিকদের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য’ (দেখুন : সহিহ মুসলিম-২৬০৯)। রাসূলুল্লাহ সা: এ ব্যাপারে হুঁশিয়ারি করে দিয়ে বলেছেন, তার জন্যে ধ্বংস যে মানুষকে হাসানোর জন্যে মিথ্যা বলে। ধ্বংস তার জন্য, ধ্বংস তার জন্য’ (সুনানু আবু দাউদ-৪১৬৭; তিরমিজি-২২৩৭)।
অতিরঞ্জিত ও অতিমাত্রায় করা যাবে না : ইমাম নববি র. বলেছেন, ‘ওইসব কৌতুক, হাসি-ঠাট্টা ও তামাশা নিষিদ্ধ যা অতিরিক্ত হাসির কারণ হয় এবং অতিমাত্রার পর্যায়ে পড়ে। এটি হার্টের জন্য ক্ষতিকারকও। শুধু তাই নয়, অতিমাত্রায় হাসি-ঠাট্টা মানুষদের আল্লাহবিমুখ করে। এটি মানুষের আত্মমর্যাদা ও সম্মানবোধেরও অন্তরায়।’ রাসূল সা: বলেছেন, ‘বেশি হেসো না। কারণ, অতিমাত্রার হাসি হৃদয়কে মেরে ফেলে’ (সহিহ বুখারি-৭৩১২)।
অপরিচিত এবং প্রতিবন্ধী কারো সাথে প্রাঙ্ক করা যাবে না : এটি অত্যন্ত মূল্যবান ধারণা। অপরিচিতদের সাথে এসব প্রাঙ্কই ভয়-ভীতি, মানসিক নির্যাতনের প্রধান কারণ হয়ে থাকে। তা ছাড়া, প্রতিবন্ধীদের সাথে হাস্যরসাত্মক এমন কিছু করে তাদের হাসির পাত্র করার কোনো বৈধতা ইসলাম দেয়নি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমাদের কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারীর অপেক্ষা উত্তম হতে পারে...’ (সূরা হুজুরাত-১১)।
অন্যের ক্ষতির এবং ভয়-ভীতির কারণ হবে না : এমন কোনো কিছুই করা বৈধ হবে না- যা কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় কিংবা জাতির জন্য ক্ষতির কারণ হবে। সে ক্ষেত্রে আমরা দেখি বেশির ভাগ প্রাঙ্ক ভিডিও তৈরিতে যাদের ব্যবহার করা হয়, তারা নিশ্চিতভাবে মানসিক ও শারিরীক নির্যাতনের শিকার হয়। একবার এক ভ্রমণের সময়ে একজন সাহাবি ঘুমিয়ে পড়ছিলেন। তখন অন্যরা একটি রশি দিয়ে তাকে বেঁধে ফেলেন। ফলে, ওই সাহাবি ভীষণ ভয় পেয়ে যান। তখন রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘কোনো মুসলিমের জন্য এটি বৈধ নয় যে সে অন্য কোনো মুসলিমের ভয়ের কারণ হবে’ (সুনানু আবু দাউদ)।
শরয়ী কোনো বিষয় নিয়ে প্রাঙ্ক করা যাবে না : এটি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। আল্লাহ, তাঁর রাসূল সা:, সাহাবি, শরিয়তের কোনো বিধি-বিধান কোনো কিছুকেই এমনভাবে উপস্থাপন করা যাবে না যাতে তাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয় কিংবা অন্যদের কাছে বিষয়টির গাম্ভীর্যতা লোপ পায়। আল্লাহ এ ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন : ‘আর যদি তুমি তাদের কাছে জিজ্ঞেস করো, তবে তারা বলবে, আমরা তো কথার কথা বলেছিলাম এবং কৌতুক করছিলাম। আপনি বলুন, তোমরা কি আল্লাহর সাথে তাঁর হুকুম-আহকামের সাথে এবং তাঁর রাসূলের সাথে ঠাট্টা করছিলে? ছলনা করো না, তোমরা যে কাফের হয়ে গেছ ঈমান প্রকাশ করার পর। তোমাদের মধ্যে কোনো কোনো লোককে যদি আমি ক্ষমা করে দেই-ও, তবে অবশ্য কিছু লোককে আজাবও দেবো। কারণ, তারা ছিল গোনাহগার’ (সূরা আত-তওবাহ : ৬৫-৬৬)।
পরিশেষে বলব, ইসলাম কল্যাণের ধর্ম। মানবতার কল্যাণকামিতাই এ ধর্মের অন্যতম লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। সুতরাং এ জীবন ব্যবস্থায় এমন কোনো কিছুর বৈধতা নেই যা সমাজের যেকোনো ব্যক্তির জন্যও ক্ষতির কারণ হবে। আল্লাহ আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করুন!
লেখক : প্রাবন্ধিক