লিবিয়া নিয়ে এরদোগানের পরিকল্পনা
লিবিয়া নিয়ে এরদোগানের পরিকল্পনা - ছবি : সংগ্রহ
লিবীয় নেতা মোয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর থেকে লিবিয়াকে নিয়ে পশ্চিমাদের নানা ষড়যন্ত্র ও অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের কারণে দেশটিতে শান্তি যেন সুদূর পরাহত। ২০১১ সালের অক্টোবরে গাদ্দাফির পতনের পর থেকে চলমান গৃহযুদ্ধে আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের হস্তক্ষেপে দেশটির অবস্থা এখন বিপন্নপ্রায়। লিবিয়া এখন কার্যকরভাবে একটি বিভক্ত দেশে পরিণত হয়েছে। দেশটিতে শিগগিরই শান্তি ফিরে আসার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অধিকন্তু দেশটিতে প্রক্সিযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক ও আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে আবার বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি তুরস্ক ও লিবিয়া চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে দু’দেশের সম্পর্কে নতুন অধ্যায় সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছে।
বর্তমানে একদিকে ত্রিপলি সরকার সেটাকে আঙ্কারা সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে রয়েছে জেনারেল হাফতার লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং উপসাগরীয় দেশগুলো জেনারেল হাফতারকে সমর্থন দিচ্ছে। ২০১১ সালে লিবিয়ায় বিশৃঙ্খলা শুরু হলে ফ্রান্স ন্যাটোকে এতে সম্পৃক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্যারিস মনে করেছিল- গাদ্দাফির হাত থেকে লিবিয়ার জনগণকে রক্ষা করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব রয়েছে।
লিবিয়ায় যখন অপারেশন শুরু হয় তখন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রজব তাইয়েব এরদোগানের প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল : ‘লিবিয়ায় ন্যাটোর কাজ কী?’ কিন্তু দেশটিতে গাদ্দাফিবিরোধী গণঅভ্যুত্থান শুরু হলে তুরস্ক মনে করে, তারা সেখানে হস্তক্ষেপ না করলে তুরস্কের কোম্পানিগুলো লিবিয়ায় যে ২৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে সেগুলো ঝুঁকিতে পড়ে যেতে পারে। তাই তুরস্ক ন্যাটোকে সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়। তুরস্ক বিমান হামলায় অংশ না নিলেও অভিযান সহযোগিতা করার লক্ষ্যে পাঁচটি যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছিল। পরবর্তী বছরগুলোতে তুরস্ক লিবীয় সঙ্কটে জড়িত হওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে ছিল। বর্তমানে লিবিয়ায় তিনটি প্রতিদ্বন্দ্বী সরকার বিদ্যমান রয়েছে।
একটি হলো ত্রিপোলিভিত্তিক জাতিসঙ্ঘসমর্থিত ন্যাশনাল একোর্ড (জিএনএ) সরকার। এই সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে লিবিয়ায় ছয় শতাংশ ভূখণ্ড। মুসলিম ব্রাদারহুড সমর্থিত পার্লামেন্ট সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এই সরকার। তুরস্ক, কাতার এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে এই সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে। পার্লামেন্টের অন্য সদস্যরা এই সরকারের বিরোধিতা করে তুবরোকে চলে গেছেন। জেনারেল হাফতার তুবরোক সরকারকে সমর্থন দিচ্ছেন। কয়েক মাস আগে হাফতার ত্রিপোলি দখল করার জন্য তার সৈন্যদের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু ত্রিপোলি সরকার কঠিন প্রতিরোধ সৃষ্টি করার কারণে হাফতার ত্রিপোলি দখল করতে পারেননি।
সৌদি আরব, মিসর, জর্ডান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত এই সরকারকে সামরিকভাবে সমর্থন দিচ্ছে। ফ্রান্স রাজনৈতিক সমর্থন দিলেও আমেরিকা দ্বিধাগ্রস্ত রয়েছে। তুবরোক সরকার লিবিয়া ভূখণ্ডের বিশাল এলাকার নিয়ন্ত্রণ করছে। লিবীয় সঙ্কটে তৃতীয় পক্ষ তুলনামূলকভাবে দুর্বল। আরবের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন গোত্র- চাঁদ, মালি এবং সুদানের সংযোজিত অংশ নিয়ে তৃতীয় পক্ষ গঠিত। তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে লিবিয়ার ১৮ শতাংশ এলাকা। তবে এই অংশটি তেল ও অন্যান্য খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ।
দু’সপ্তাহ আগে তুরস্ক এবং লিবিয়া জিএনএর সাথে দু’টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করার পর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অ্যাজেন্ডায় তুর্কি-লিবিয়া সম্পর্ক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। সমঝোতা স্মারকে এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনস (ইইজেড) এবং নিরাপত্তা ও সামরিক সহযোগিতার বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এরদোগান সম্প্রতি বলেছেন, লিবিয়া সরকারের আনুষ্ঠানিক অনুরোধ পেলে তুরস্ক লিবিয়ায় সৈন্য পাঠাতে পারে। লিবিয়ায় জটিল পরিস্থিতি সত্ত্বেও তুরস্ক-লিবিয়া চুক্তি স্বাক্ষর করায় ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলে উত্তেজনা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত ২৭ নভেম্বর তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান এবং লিবিয়ার ফায়েজ আল সারাজের সরকার একটি সমঝেতা স্মারকে স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির মাধ্যমে দু’দেশের ভূমধ্যবর্তী সাগরে মেরিটাইম বাউন্ডারি প্রতিষ্ঠা করা হবে। আইনগত চুক্তি হিসেবে গত ডিসেম্বর তুর্কি পার্লামেন্টে এটা অনুমোদন লাভ করে। এই চুক্তিটিকে তুর্কি পার্লামেন্টের সব পক্ষ স্বাগত জানিয়েছে।
তবে তুর্কি সরকার ত্রিপলি সরকারকে রক্ষার জন্য সৈন্য মোতায়েন করলে তাতে সিরিয়া ও লিবিয়ার চিত্র এবং তুরস্ক-রাশিয়ার সম্পর্কেও পরিবর্তন আসতে পারে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করে। তবে মনে হয়, আঙ্কারা ও মস্কো তাদের সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে খুবই আন্তরিক ও সতর্ক। লিবিয়া রাশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে নানা কারণে ন্যাটোর সদস্য তুরস্কের সাথে গড়ে ওঠা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখাটাও মস্কোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
লিবিয়া সঙ্ঘাতের কারণে তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি ঘটলে সিরিয়া সঙ্কটে তার প্রভাব পড়তে পারে এবং সিরিয়ায় তুরস্কের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। এরদোগান তার রুশ প্রতিপক্ষ ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে লিবিয়ার সর্বশেষ পরিস্থিতি এবং হাফতারের অবস্থা নিয়ে শিগগির আলোচনা করবেন বলে জানা গেছে। লিবিয়ায় তুরস্কের বিশেষ প্রতিনিধি জানিয়েছেন- পুতিন আগামী ৮ জানুয়ারি তুরস্ক সফর করার কথা রয়েছে। সে সময় দু’পক্ষ লিবিয়া নিয়ে আলোচনা করবে। সম্প্রতি তুরস্ক সাইপ্রাস অভিমুখী একটি ইসরাইলি জাহাজকে ভূমধ্যসাগর ত্যাগ করতে বাধ্য করেছে। ওই জাহাজ ভূমধ্যসাগরে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে এসেছিল বলে জানা গেছে। তুরস্ক ওই অঞ্চলে যে বাইরের হস্তক্ষেপ বরদাশত করবে না ইসরাইলি জাহাজকে ওই এলাকা ত্যাগ করতে বাধ্য করার মাধ্যমে তারই ইঙ্গিত পাওয়া গেল। সুতরাং তুরস্ক লিবিয়ার সাথে যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, সে ব্যাপারে তারা খুব সিরিয়াস বলে মনে হচ্ছে।
তবে তুরস্ককে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাধ্যমে বিষয়টি ঠাণ্ডা মাথায় সমাধানের পথ বেছে নেয়াটা হবে বুদ্ধিমানের কাজ। সিরিয়ায় সঙ্ঘাত ও উত্তেজনার পর লিবিয়াও সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়লে সেটা কারো জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। ওই এলাকাকে সঙ্ঘাতমুক্ত রাখার জন্য ন্যাটোর মিত্র তুরস্ক ও গ্রিসকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।