সিএবি-এনআরসি : যেখানে কেউ খুশি নয়
সিএবি-এনআরসি : যেখানে কেউ খুশি নয় - ছবি : সংগৃহীত
অরুনাচল প্রদেশের জয়েন্টু কয়েক দিন ধরে গৌহাটিতে আটকা পড়ে আছেন। আসাম আসা-যাওয়ার সব ধরনের স্থল পরিবহন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে। ফলে হাজার হাজার লোক আটকা পড়ে আছে। গৌহাটির রেল স্টেশন, আসামের ডিব্রুগড়, পাশের নাগাল্যান্ডের দিমাপুরেরও হাজার হাজার লোক প্রতীক্ষার প্রহর গুণছে। পুরো সপ্তাহই পরিবহনব্যবস্থা স্থবির থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদিকে কিছু এলাকা মঙ্গলবার কারফিউ তুলে নেয়া হয়েছে, তবে ইন্টারনেট সার্ভিস বিচ্ছিন্নই রয়েছে। জয়েন্টু বলেন, কয়েক দিন ধরে ট্রেন চলাচল বন্ধ। জানি না কিভাবে বাড়ি ফিরব। এই প্রথমবারের মতো আমি এ ধরনের কিছুর অভিজ্ঞতা পেলাম। ঘটনাটি ঘটল হঠাৎ করে।
ভারতীয় পার্লামেন্টে মঙ্গলবার বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস হওয়ার পর আসাম ও উত্তর-পূর্ব দিকের রাজ্যগুলোর রাস্তায় রাস্তায় ছাত্রদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া বিক্ষোভ সামরিক বাহিনী ও পুলিশের কড়া প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়েছে। ইন্টারনেট বন্ধ রয়েছে আসামের পাশাপাশি ত্রিপুরা ও মেঘালয়েও।
সমালোচকেরা বলছেন, ইন্টারনেট বন্ধ থাকাতে বরং পরিস্থিতি আরো জটিল হচ্ছে, রাজ্যের উত্তেজনায় ইন্ধনের সৃষ্টি হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টুইট করেছেন, আমি আসামের আমার ভাই ও বোনদের আশ্বস্ত করতে চাই যে সিএবি পাস হওয়াতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আমি তাদেরকে আশ্বস্ত করতে চাই যে তোমাদের অধিকার, অনন্য পরিচিতি ও সুন্দর সংস্কৃতি কেউ কেড়ে নেবে না। সেগুলো বরং বিকশিত হওয়া অব্যাহত থাকবে।
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস জবাবে বলেছে, মোদিজি আসামের আমাদের ভাই ও বোনেরা আপনার আশ্বাসবাণী পড়তে পারেনি, কারণ সেখানে ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন রয়েছে। চন্ডিগড় থেকে ট্রেনে করে আসা জয়েন্টু এবং আরো হাজার হাজার লোক আসামে পড়ে আছেন বাড়ি ফিরে যাওয়ার কোনো রাস্তা না পেয়ে। যাদের হোটেল ভাড়ার টাকা আছে, তারা সেখানেই আছে। বাকিরা ট্রেন স্টেশন বা অন্যান্য খোলা জায়গায় ঘুমাচ্ছে। আর অনেকে বিমানে এমনকি হেলিকপ্টারে করেও আসাম ছেড়েছে। সিএবি পাস হওয়ার সাথে সাথেই ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ, নয়া দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই ও হায়দরাবাদে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।
হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপির উত্থাপিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে (সিএবি) বলা হয়েছে, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে ধর্মীয় কারণে নির্যাতনের শিকার অমুসলিমদেরকে নাগরিকত্ব প্রদান করা হবেচ। সমালোচকেরা বলছেন, এতে মুসলমানদের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে। আর তা ভারতের সেক্যুলার ঐতিহ্যের প্রতি একটি আঘাত।
আসামের ৩২ মিলিয়ন লোকের এক-তৃতীয়াংশ মুসলিম। ভারতে মুসলিম হারের দিক থেকে কাশ্মিরের পরই আসামের স্থান। ভারতের মুসলিমরা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী এবং বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। কিন্তু তবুও সেখানে মুসলিমবিরোধী বাগাড়ম্বড়তা বাড়ছেই।
চলতি বছরের প্রথম দিকে বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে তারা দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হতে পারলে এই বিলটি পাস করবে। তারা আগস্টের শুরুতে জম্মু ও কাশ্মিরের রাজ্যত্ব বাতিল করে। এছাড়া আসামে এনআরসি বাস্তবায়ন করে। আসামের এনআরসির ফলে ১৯ লাখ লোক নাগরিকত্ব হারিয়েছে। সিএবি অনুযায়ী, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকৈ হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা পারসিরা দ্রুত ভারতীয় নাগরিকত্ব পেতে পারে। উত্তরপূর্বাঞ্চলের, বিশেষ করে আসাম ও ত্রিপুরায়, সাধারণ অনুভূতি হলো এই যে এর ফলে প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক হিন্দু গিয়ে সেখানকার জনসংখ্যার চিত্র পাল্টে দিকে পারে। বর্তমানে উত্তর-পূর্ব এলাকায় ২৩০টির বেশি আদিবাসী গ্রুপের বাস।
অঞ্চলটি বাঙালি ভাষাভাষী অভিবাসদের অভিবাসনের তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে আগেই। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আসামের অধিবাসীরা বিদেশী খেদাও আন্দোলন শুরু করে। ১৯৮৫ সালে আসাম চুক্তির মাধ্যমে ওই আন্দোলন শেষ হওয়ার আগে সেখানে কয়েক হাজার লোক নিহত হয়। ওই চুক্তির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়, ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের পর আসামে প্রবেশকারী অভিবাসীদেরকে বহিষ্কার করা হবে। আসামের বিক্ষোভকারীরা মনে করছে, নতুন আইনের ফলে অবৈধ অভিবাসীদের বিতাড়িত করার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসেছে বিজেপি। আর বাঙালি হিন্দুরা মনে করছে, এনআরসির ফলে তাদেরকে অনাগরিক করে ফেলা হয়েছে। অন্যদিকে মুসলিমরা আইনটিকে তাদেরকে টার্গেট করে করা বলে ধারণা করছে।
এনআরসি বিল
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ক্ষমতাসীন বিজেপি ও হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা সারা দেশে এনআরসি করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। এর ফলে অনেক ভারতীয় মুসলিম তাদের ভবিষ্যত নিয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছে। গত এপ্রিলে অমিত শাহ অবৈধ অভিবাসীদেরকে উইপোকা হিসেবে অভিহিত করেন। জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশনার বলেছেন, ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইন নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। এটি মৌলিকভাবে বৈষম্যমূলক। আমরা আশা করছি, ভারতের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বাধ্যবাধকতার আলোকে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এই আইনটির যথার্থর বিষয়টি সতর্কতার সাথে পরীক্ষা করবে। ইউএস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম সিএবি পাস হলে ভারতের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের আহ্বান জানিয়েছিল। তারা এই আইনকে ভুল দিকে বিপজ্জনক মোড় হিসেবে অভিহিত করে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স তাদের নাগরিকদের ভারত সফর নিয়ন্ত্রিত করার আহ্বান জানিয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন ভারত সফর বাতিল করেছেন। ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে এর পর দিন জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবে তার ভারত সফর বাতিল করার কথা ঘোষণা করেন। তার আসামের গৌহাটিতে মোদির সাথে ১৫-১৭ ডিসেম্বর বৈঠকের কথা ছিল। মোদি এখনো সিএবি আইন চূড়ান্ত করেননি। তবে চলতি সপ্তাহেই তা করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ৫টি রাজ্য প্রকাশ্যেই আইনটির বিরোধিতা করেছে, তারা এটি বাস্তবায়ন করবে না বলে জানিয়েছে। এর মধ্যে আছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। এছাড়া পাঞ্জাব, কেরালা, ছত্তিশগড় ও মধ্য প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীরাও বলেছেন যে তারা এটি বাস্তবায়ন করবেন না। দি ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগ সিএবিকে অসাংবিধানিক হিসেবে অভিহিত করার জন্য ভারতের সুপ্রিম কোর্টের দ্বারাস্থ হয়েছে।
দি ডিপ্লোম্যাট