চীন-পাকিস্তান সমীকরণে বদলে যাচ্ছে কারাকোরাম
কারাকোরাম হাইওয়ে - ছবি : সংগৃহীত
কারাকোরাম মহাসড়কে এমনটাই প্রত্যাশা ছিল। উত্তর পাক্সিতানের লম্বা পার্বত্য সারিটি বাঁক নিয়ে পশ্চিম চীনে পৌঁছেছে। উভয় দেশই একটি বাণিজ্য রুটটির সম্ভাবনা দেখে একে নতুন করে গড়ে নিচ্ছি। পাকিস্তান আরেকটি কারণে এ দিকে মনোযোগী হয়েছে। তা হলো ভারতের বিরুদ্ধে বিরোধপূর্ণ ভূমির নিয়ন্ত্রণ সংহত করার একটি উপায় দেখতে চাচ্ছে এর মধ্যে।
তবে ৫০০ মাইলের রুটটি দ্বিমুখী রাস্তার একটি অংশ উপত্যকার ঢালে পাথর কেটে কেটে তৈরী করা হয়েছে। পাথরের পতন, বন্যা আর ভূমিকম্পে এই পথ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০১০ সালে ভূমিধসে একটি নদীর পথ বন্ধ হয়ে গেলে রাস্তাটির প্রায় ১৪ মাইল এলাকা ডুবে গিয়েছিল। ভারী তুষারপাতেও রাস্তাটি বন্ধ হয়ে যায়। এর সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা অংশটি হচ্ছে চীনগামী শেষ অংশটুকু। পাকিস্তানের জাতীয় ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্সেস অ্যান্ড টেকনলজিতে জলবায়ু পরিবর্তনে মহাসড়তে প্রভাব নিয়ে সমীক্ষায় নিয়োজিত ভূতত্ত্ববিদ সরফরাজ আলী বলেন, আমরা রাস্তাটির এই অংশকে ভূ-ভোগান্তির জাদুঘর বলতে পারি।
মুসাফিরদের কাছে কারাকোরাম হাইওয়ে (১৯৫০-এর দশক থেকে ১৯৭০-এর দশকে) নামে পরিচিত এই রাস্তাটির নির্মাণ একটি বড় ধরনের কৃতিত্ব হিসেবে পরিগণিত। এখন পাকিস্তানি নগরী হ্যাভেলিয়ান ও রাইকোটের মধ্যে থাকা পুরনো কারাকোরাম রাস্তাটির স্থলে চীন প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে প্রায় ১৬০ মাইল মহাসড়ক নির্মাণ কর। মার্চে রাস্তাটির শেষ অংশটুকুর কাজ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এই প্রকল্পটি গুরুত্ব বেড়ে যায় ৬০ বিলিয়ন ডলারের চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) নির্মাণের উদ্যোগে। চীনের বৈশ্বিক বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হলো এই প্রকল্প। তবে দুই দেশের কেউ এসব প্রকল্পের স্বচ্ছতা বা কিভাবে এই ঋণ ব্যয় হচ্ছে, তা নিয়ে কথা না বলায় এ নিয়ে বিতর্ক রয়েই গেছে।
জনসাধারণের জন্য কারাকোরাম অনেকটাই উন্মুক্ত। তবে বিদেশী সাংবাদিকদের এর দূর উত্তর অংশে যাওয়ার জন্য পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। এনআরপি সম্প্রতি অনুমতি পেয়েছিল, এর সাংবাদিকেরা এমন এক রাস্তার সাক্ষাত পেয়েছিল, যেটি এর পথজুড়ে থাকা সম্প্রদায়গুলোকে বদলে দিয়েছে। বর্তমান যানবাহনগুলো ইসলামাবাদের উত্তরের নতুন মহাসড়ক ধরে এগিয়ে গিয়ে পুরনো রুট দিয়ে নদী, পুরনো বৌদ্ধ স্থাপনা, ব্যস্ত বাজার পাড়ি দেয়। রাতের বেলায় কোনো কোনো স্থানে ফ্লুরেসেন্ট বাতির আলোতে ট্রাক চালকদের জন্য চা স্টল বসেছে।
জাহাঙ্গির খান হোটেলের মালিক আবদুল জাদরান (২৮) বলেন, তাকে ব্যবসাটি ছেড়ে দিতে হবে। কারণ চীনারা এখানে রাস্তার এই অংশটিকে শহরের বাইরে বহু লেনের মহাসড়ক হিসেবে নতুন করে নির্মাণ করতে চাচ্ছে।
ওয়েটার আবদুল গফুর (৩০) তার কথার সাথে একমত হলেন। তিনি বলেন, আমার মালিক এটি রাখতে পারবেন না। তিনি দিনে ৪ ডলারের এই কাজটি নিয়েও উদ্বিগ্ন। তিনি চা পরিবেশন করছিলেন গুল আহসানকে (৬০)। আর এই ট্রাকচালক নতুন রাস্তায় তার গাড়ি চালানোর অপেক্ষায় আছেন। তিনি বলেন, আমার টায়ার আর ফাটবে না, আমার ট্রাক আর মেরামত করতে হবে না। তার ট্রাকটি দেখা গেল ফুল আর লতাপাতায় সজ্জিত, একটি এফ-১৬ বিমানও আচে তাতে। তার বন্ধু কৌতুক করে বলেন, সে চায় উড়তে। কাছের শহরে স্পোর্টস সুপারভাইজর কাজিলশাক, ৪৫, বলেন, তিনি আশা করছেন যে রাস্তা ভালো হলে পর্যটক আসবে। তিনি ছেলেদের হকি, ক্রিকেট, ফুটবল খেলা তদারকি করেন।
পাকিস্তানের গ্রামীণ এলাকায় মেয়েরা খেলাধুলা করে না। তারা খুব কমই বাইরে বের হয়। নতুন রাস্তা কি তাদের এই প্রথাতেও পরিবর্তন আনবে? তিনি বলেন, আমাদের সংস্কৃতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। আমাদের এলাকার নারীরা পর্দা করেন। কারাকোরাম চীনের কাছাকাছি হতেই ট্রাকগুলোর গতি কমে এলো। কয়েকটি ইয়াক রাস্তা বন্ধ করে আছে যে! তাদের রাখাল সোহাইল আব্বাস বলেন, তিন বছর আগে চীনা কোম্পানি রাস্তার এই অংশটি নতুন করে গড়ার পর তার ভাগ্য বদলে গেছে। এখন অনেক লোকের হাতেই গোশত খাওয়ার মতো টাকা আছে।
পর্যটন থেকে স্থানীয়রা আয় করছে, তারা আরো বেশি ইয়াক কিনছেন। আব্বাস বলেন, চলতি বছর ৫০০টি দিয়ে শুরু করেছিলাম, ৩২টি ছাড়া সবই বিক্রি হয়ে গেছে। এগুলো ঘাস ছাড়া আর কিছু খায় না বলে লোকজন একে পছন্দ করে। এই রাস্তা হওয়ার আগে বছরে তার বিক্রি হতো মাত্র ১৫টি, আর সে চার আর রুটি খেয়ে বাঁচত। সীমান্তের কাছের শহর সোস্তের কাছে যেতেই লোকজনের বেশ বড় উপস্থিতি নজরে এলো। চীন থেকে আনা পণ্যরাজি নিতে সারা পাকিস্তান থেকে কার্গো ট্রাক হাজির হয়েছে। আবার অনেক লোক দিনে এক ডলারের পারিশ্রমিকে বাক্স নামানো-ওঠানোর কাজ করছে। কাস্টমস কর্মকর্তা ২৯ বছরের মোহাম্মদ ইকবাল বলেন, তার কৈশোরে এখানে ছিল মাত্র একটি দোকান, একটি হোটেল।
তিনি বলেন, আগে বাসই চলত এই পথ দিয়ে, চীন থেকে হাজিদের পাকিস্তান হয়ে মক্কায় নিয়ে যেত। উইঘুর মুসলিম সংখ্যালঘু সদস্যরাই সাধারণত এই পথে হজে যেতেন। তবে এখন আর তারা আসেন না। চীনে ওই সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের ঘটনাকে তার মুখ দিয়েও অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে প্রকাশ পেল। দি চায়না-পাকিস্তান এক্সিস-এর লেখক অ্যান্ড্রু স্মল বলেন, এখন পর্যন্ত এই রাস্তা আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য বাড়ানোর প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। এর বদলে মহাসড়কটি দুই দেশের মধ্যকার কৌশলগত অংশীদারিত্ব জোরদার করার উদ্দেশ পূরণ করছে। তিনি বলেন, এটি সামরিক কাজে ব্যবহারের সম্ভাবনাময়। ভারত থেকে নিজের ভূখণ্ড রক্ষার জন্য আন্তঃসীমান্ত গতিময়তা ও সৈন্য চলাচলের সামর্থ্য বাড়াবে এই রাস্তা। এর উত্তর প্রান্তটি হিমালয়ের কাশ্মির ভূখণ্ডের অংশ হিসেবে চিহ্নিত। তবে এখানকার অধিবাসীরা নিজেদের কাশ্মিরি হিসেবে পরিচিতি দেন না। এখানে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বিরোধ খুব বিরল ঘটনা।
সিপিইসির পাকিস্তানি পরিচালক লিয়াকত আলী শাহ বলেন, চীন জিনজিয়ান অঞ্চলে শিল্পায়ন করায় বাণিজ্য বাড়বে। শিল্পগুলো কারাকোরাম মহাসড়কটি ব্যবহার করতে পারবে। এটি হলো পাকিস্তানি বন্দর গোয়াদরগামী অনেকগুলো রাস্তার প্রথমটি। তিনি বলেন, একবার এই অঞ্চলটি উন্নত হলে এটি বিকল্প বাণিজ্য রুট হিসেবে গড়ে উঠবে। সোস্তে ফিরে যাওয়া যাক। বিবি হালিমা (৪৫, শিক্ষিকা) মনে করেন, সমৃদ্ধির দিন আসছে সামনে। তিনি বলেন, কারাকোরাম হাইওয়ের কারণে এখানে অনেক কিছু হয়েছে। আরো চাকরি হবে। তবে সোস্ত যখন বিচ্ছিন্ন ও গরিব ছিল, তখনকার অনেক কিছুর জন্য তার আফসোস হয়। তিনি বরেন, আমাদের কাছে তখন অনেক সময় থাকত। শিক্ষকতা করে ফেরার পর কেবল বসে থাকতাম।
তিনি জানান, মহাসড়কটি হয়ে যাওয়ার পর সময় অনেক মূল্যবান হয়ে পড়েছে। এখন এক সেকেন্ডও নষ্ট করতে পারি না।
এনপিআর