‘দি লেডি’ : মিথ্যাবাদী সু চি

ফেলিম কিন | Dec 13, 2019 06:16 pm
সু চি

সু চি - ছবি : সংগৃহীত

 

‘রোহিঙ্গা বেসামরিক লোকজন।‘ এই পরিভাষাটি বুধবার আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর আং সান সু চির ৩,৫০০ শব্দের বিবৃতিতে দৃষ্টিগোচরভাবেই অনুপস্থিত ছিল। এই বাদ পড়াটা ঘটনাক্রমে হয়নি।

জাতিসঙ্ঘের ১৯৪৮ সালের মিয়ানমারের জেনোসাইড কনভেনশন লঙ্ঘন (মুসলিম রোহিঙ্গা বেসামরিক লোকজনের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর চরম নির্যাতনের সাথে সম্পর্কিত) নিয়ে গাম্বিয়ার সরকারি অভিযোগের জবাব দিতে সু চির অতিপ্রত্যাশিত উপস্থিত দেখা গেছে। অবশ্য সু চির সাফাইয়ে অত্যন্ত যত্নের সাথে বেসামরিক লোকজনের দুর্ভোগের যেকোনো উল্লেখ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

এর বদলে ১৯৯১ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী সু চি দীর্ঘ দিন ধরে দেশটির সামরিক বাহিনীর ভাষ্যই পুনরাবৃত্তি করে বলেন, বিদ্রোহী একটি গ্রুপের পুলিশ চৌকির ওপর কথিত হামলার জবাবে নিরাপত্তা বাহিনী উত্তর রাখাইনে ‘শুদ্ধি অভিযান’ চালিয়েছে। সু চির ভাষায় যা হয়েছে তা আসলে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির সমন্বিত ও ব্যাপকভিত্তিক হামলার জবাবে মিয়ানমারের প্রতিরক্ষা বাহিনীর দায়িত্ব পালন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সু চির ভাষ্যটি জাতিসঙ্ঘ নিরপেক্ষ তদন্ত মিশন ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার সংগ্রহ করা বিপুল প্রমাণের বিপরীত। ওই সব তদন্তে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট শুরু হওয়া রোহিঙ্গা বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যাপকভিত্তিক, পরিকল্পিত হামলার কথা ওঠে এসেছে। ওইা সময় নিরাপত্তা বাহিনী শত শত রোহিঙ্গা গ্রামে হামলা চালায়, হাজার হাজার অধিবাসীকে হত্যা করে, আরো হাজার হাজার নারীকে ধর্ষণ করে, তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়।

সহিংসতা ও চলমান নির্যাতনে অন্তত ১০ হাজার রোহিঙ্গা বেসামরিক নাগরিক নিহত হলে সাত লাখ ৪০ হাজার রোক তাদের জীবন নিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশের কক্সবাজারে চলে আসতে বাধ্য হয়। তারা এখনো সেখানেই অবস্থান করছে। এখনো রাখাইন রাজ্যে থেকে যাওয়া প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা বেসামরিক নাগরিক নতুন গণহত্যার আশঙ্কায় রয়েছে বলে জাতিসঙ্ঘ তথ্যানুসন্ধান মিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বৈধভাবেই শক্তি প্রয়োগ করেছে বলে সু চি যে দাবি করেছেন, তা রোহিঙ্গা জনসাধারণের ওপর পরিচালিত নৃশংসতা নিয়ে সংগ্রহ করা প্রমাণের পরিপন্থী। বাংলাদেশে অবস্থানরত ৬০৫ জন লোকের সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে পিএইচআর যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্রই প্রকাশিত হয়েছে। বেশির ভাগ লোকই বলেছেন, তাদের ওপর নৃশংসতা চালিয়েছে সামরিক বাহিনী ও সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। তারা ২০১৭ সালের আগস্টে অরক্ষিত রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুদের ওপর হেলিকপ্টার, ট্রাক ও ট্যাঙ্ক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

কিন্তু সু চি পরিস্কার করেছেন যে তিনি দি হেগে এসব প্রমাণের দিকে নজর দিতে চান না। এর বদলে তিনি সাফাই গেয়ে বলেছেন যে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী তাদের অভিযানের সময় ক্ষতি যতটা সম্ভব ন্যূনতম রাখার চেষ্টা করেছে। আরো খারাপ ব্যাপার হলো, তিনি গাম্বিয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন যে আইজিসেতে গণহত্যার যে অভিযোগটি করা হয়েছে তা রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতির সম্পর্কে অসম্পূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছে। তিনি বলেন, রাখাইনের পরিস্থিতি জটিল এবং তা সহজে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়।

কিন্তু সু চি যে কথাটি বলতে ব্যর্থ হয়েছেন তা হলো তার সরকার ২০১৭ সাল থেকে অব্যাহতভাবে ওই এলাকায় আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর প্রবেশ নিষিদ্ধ করে রেখেছে। এমনকি পরিস্থিতি যথার্থভাবে দেখার জন্য জাতিসঙ্ঘ বিশেষ দূত ইয়াঙহি লিকে পর্যন্ত সেখানে যেতে দেয়া হয়নি। অথচ সু চি দি হেগের বিচারকদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন এই বলে যে তার সরকার ও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী উত্তর রাখাইনের ২০১৭ সালের সহিংসতার জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করতে সক্ষম। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে মিয়ানমারের গঠিত তদন্ত কমিটিই বিচার নিশ্চিত করতে সক্ষম। অথচ তিনি গত ডিসেম্বরে যে তদন্ত রিপোর্টে সহিংসতা অস্বীকার করার বিষয়টি চেপে গেছেন।

সু চির নির্লজ্জ মিথ্যা বক্তব্য ও দ্বিমুখী আচরণ হাস্যকরই মনে হবে। ২০১৭ সালের অপরাধের জন্য অর্থপূর্ণ জবাবদিহিতা ছাড়া কোনোভাবেই বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর জন্য নিরাপদ, স্বেচ্ছামূলক ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তন সম্ভব নয়।

সামরিক বাহিনীর যেসব সদস্য নির্যাতন চালিয়েছিল, তারা যদি অবাধে ঘুরে বেড়াতে পারে, তবে ওইসব রোহিঙ্গা ফিরতে পারে না। তাছাড়া মিয়ানমার সরকার এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করা থেকে বিরত থাকায় মনে হচ্ছে, তারা তাদের অবস্থান থেকে সরেনি।

দি হেগে সু চির লজ্জাজনক অবস্থান পরিষ্কার করে দিয়েছে যে তিনি ও ‘তার বাবার সেনাবাহিনী’ নিজেদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় না নিতে বদ্ধপরিকর। এই ব্যর্থতা আইসিজেতে গাম্বিয়ার মামলাটিকেই কেবল জোরালো করে এই যুক্তিতে যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের অপরাধগুলোর জন্য প্রয়োজন প্রবল আন্তর্জাতিক বিচারিক সাড়া, যাতে অতীতের নৃশংসতার জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায় এবং ভবিষ্যতের নির্যাতন থেকে নিবৃত্তিতে তা সহায়ক হয়।

লেখক : পরিচালক, গবেষণা ও তদন্ত শাখা, ফিজিশিয়ান্স ফর হিউম্যান রাইটস এবং সাবেক উপ-পরিচালক, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া শাখা

এশিয়া টাইমস


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us