সিঙ্গাপুরে যেভাবে নির্মিত হয়েছিল মেট্রোরেল
সিঙ্গাপুরে যেভাবে নির্মিত হয়েছিল মেট্রোরেল - ছবি : সংগ্রহ
ঘটনার দিন আমি রোজা ছিলাম এবং অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু বেশি পরিশ্রম করেছিলাম। ফলে ইফতারির পর কেমন যেন খানিকটা অসুস্থ বোধ করছিলাম। কাজেই নির্ধারিত সময়ের আগে অফিস থেকে বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নেয়ার উদ্দেশ্যে সন্ধ্যা ৭টার সময় গাড়িতে চড়ে বসলাম। আমি সাধারণত রাত ৪টায় ঘুম থেকে উঠি এবং বাসা থেকে সোয়া ৮টায় রওনা করে পৌনে ৯টার মধ্যে অফিস পৌঁছি। অন্য দিকে, রাত ৯টায় অফিস থেকে বাসার পথে রওনা হয়ে সাড়ে ৯টা বা পৌনে ১০টার মধ্যে ঘরে ফিরি। গত কয়েক বছর ধরে আমার জীবনটা অনেকটা রোবটের মতো হয়ে গেছে। কথিত উন্নয়নের ভরা কাটালে সৃষ্ট ব্যবসা-বাণিজ্যের মরা কাটাল সামাল দিয়ে সরকারের ইচ্ছায় হস্ত-পদসঞ্চালন ছাড়াও ঠোঁট জিহ্বা চোখের কর্মকাণ্ডে সকাল থেকে রাত অবধি হাজারোবার ব্রেক মারতে গিয়ে আমি রীতিমতো রোবট হয়ে গেছি। বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য সামান্য ব্যাখ্যা-বিবৃতির প্রয়োজন। আশা করি, আপনারা আমার রোবটিক জীবনের বৃত্তান্ত শুনলে শিরোনামের স্বার্থকতা খুঁজে পাবেন।
আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটি বেশ পুরনো। ১৯৯১ সালে আমি যখন ব্যবসা শুরু করেছিলাম, তখন দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের যে গতি ছিল তার কিয়দংশ এখন নেই। ফলে আমার সাথে যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেছিল- সেসব প্রতিদ্বন্দ্বী কিংবা কাস্টমারের বিরাট অংশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমি যাদের কাছে টাকা-পয়সা পাব তারা গাঢাকা দিয়েছে অথবা তাদের মধ্যে কেউ কেউ এমন দুর্বিষহ অর্থনৈতিক সঙ্কট পার করছে যে, মেরে ফেললেও তাদের পক্ষে টাকা ফেরত দেয়া সম্ভব নয়। অন্য দিকে, আমার কাছে যারা পাবেন তারা এমনভাবে আহাজারি শুরু করেছেন, যা আমি আমার ব্যবসায়িক জীবনে কোনোকালে দেখিনি। আমার পাওনাদারদের আহাজারি শুনলে একেকবার মনে হয়, সব কিছু বিক্রি করে তাদের দেনা শোধ করে দেই এবং এর পরও যদি আহাজারি না থামে তবে নিজের রক্ত-কিডনি বিক্রি করে হলেও দীর্ঘ দিনের সহযোদ্ধাদের অভাবগুলো ঘুচিয়ে দিই। কিন্তু সেটা হয়তো সম্ভব হবে না, কারণ বর্তমানের আশ্চর্যজনক সরকারের আজব উন্নয়নের জয়গানে আমার রক্ত-মাংস আগের মতো নেই। কিডনি ফুসফুস হৃৎপিণ্ড প্রতি মুহূর্তে আর্তের মতো বিপদ সিগন্যাল দিয়ে যাচ্ছে। অন্য দিকে, উন্নয়নের জোয়ারে আমার মাথার ঘিলু কিভাবে ভেসে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে সেই পাঁচালিই আজ আমি আপনাদেরকে শোনাব।
আমার ব্যবসা যখন তুঙ্গে, তখন আমার সবচেয়ে প্রধান মূলধন ছিল স্বাধীন চিন্তাভাবনা, অবাধ চলাফেরার সুযোগ এবং রাষ্ট্রকে বিশ্বাস করার মন-মানসিকতা। আমি ইচ্ছেমতো অফিসে আসতাম এবং প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে অফিস থেকে বের হয়ে বিভিন্ন ক্লায়েন্টদের অফিসে যেতাম। যেদিন সাভারে অবস্থিত টেক্সটাইলে অফিস করতাম, সেদিন ভোর ৫টায় বের হয়ে রাত ১২টায় ফিরতাম, কোনো ক্লান্তি অথবা বিষাদ ছাড়া। ব্যাংকগুলো পেছনে পেছনে ঘুরত ঋণ দেয়ার জন্য অথবা আমানত সংগ্রহের জন্য। বড় বড় রাজনীতিবিদ, অভাবী দরিদ্র মানুষ, মসজিদ, মাদরাসা, মন্দিরের লোকজনসহ অন্য সাহায্যপ্রার্থীরা রোজ এসে অফিসে ভিড় জমাত। ফ্যাক্টরিতে হাজার হাজার মানুষÑ হেড অফিসে শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারী, অগণিত কাস্টমার, ক্রেতা-বিক্রেতার কলরবে আমার কর্মক্ষেত্রগুলো মুখরিত ছিল। দু’হাতে টাকা উপার্জন করেছি এবং দু’হাতে সবার জন্য খরচ করেছি। আমার পেশার কিংবা ব্যবসায়িক মহলের সবাই আমার সফলতা-পেশাদারিত্ব ও সুনাম-সুখ্যাতির প্রশংসা করতেন এবং অনেকে আমাকে তাদের আইকন মনে করতেন।
সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর আমার ব্যবসার রমরমা ভাব কমতে থাকে এবং ২০১৫ সালে এসে আমি এক কঠোর বাস্তবতার মুখে পড়ি। দেশের সার্বিক ব্যবসায় মন্দা, ব্যাংকিং সেক্টরের অরাজকতা এবং রাজনৈতিক কারণে আমার বেশির ভাগ ক্লায়েন্ট মারাত্মক অর্থ সঙ্কটে পড়ে। এই অবস্থায় অনেক কোম্পানি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আমার ব্যবসায়ের গতি শ্লথ হতে হতে ২০১৮ সালে এসে রীতিমতো অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে। আমার সাথে যারা শিপিং, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডিং এবং সার্ভে ব্যবসা চালু করেছিলেন তারা প্রায় সবাই ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হন। পুরনোদের মধ্যে যে অল্প কয়জন কোনোমতে টিকে রয়েছেন তাদের মধ্যে মন্দের ভালো হিসেবে আমিই সবচেয়ে ভালো আছি আমার রোবোটিক স্বভাবের কারণে। আপনারা শুনে অবাক হবেন যে, আমি কিন্তু ইচ্ছে করে রোবট হইনি। সদাসয় সরকার বাহাদুরের যুগান্তকারী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ধুলোবালি, ট্রাফিক জ্যাম, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি এবং অনিয়ন্ত্রিত অর্থব্যবস্থার ধকল সামাল দেয়ার জন্যই রোবট হতে বাধ্য হচ্ছি। আর আমি যদি রোবট হয়ে আগে ভাগে অফিসে না আসতাম কিংবা গভীর রাত অবধি অফিসে বসে না থাকতাম, তবে আমাকেও হয়তো অন্যান্যের মতো দেউলিয়া হতে হতো।
আমার বাসা থেকে অফিসে গাড়িতে করে আসতে সাধারণত ১০ মিনিট সময় লাগত আগেকার দিনে। বর্তমানকালে যদি সকাল ৮টায় রওয়ানা দেই তবে আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা লাগে। আর যদি ৯টা বা ১০টার দিকে রওয়ানা দেই তবে সময় লাগে কমপক্ষে দুই থেকে তিন ঘণ্টা। একইভাবে আমার অফিস শেষ হয় ৫টায়। আমি যদি তখন বাসার দিকে যাত্রা করি তবে গন্তব্যে পৌঁছানো রীতিমতো ভাগ্যের বিষয়, যা কিনা তিন-চার ঘণ্টা পর্যন্ত ভোগাতে পারে। এজন্য অফিস শেষ হওয়ার পর প্রায় চার ঘণ্টা একাকী বসে থেকে শরিয়ত-মারফত-হকিকত-তরিকতের দেশ-বিদেশের জ্ঞান অর্জন-চলচ্চিত্র দর্শন এবং জিকির-আসকার-নামাজ-কালাম অথবা লেখালেখি করে কাটিয়ে দেই। সরকারের এই তথাকথিত উন্নয়নের ধুলোবালি এবং ট্রাফিক জ্যামের কারণে যেমন সারা দিনে কোথাও বের হই না তেমনি বিমানবন্দরে হেনস্থা হওয়ার আশঙ্কায় বিদেশে বাণিজ্য খোঁজা তো দূরের কথা, ওমরাহ করতেও যাই না গত তিন বছর ধরে। ফলে ফার্মের মুরগির মতো অফিস-বাসায় অলস সময় কাটিয়ে কাটিয়ে আমার ব্যবসা যত বেহাল হচ্ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে পেটের মেদ চেহারার জৌলুস এমন হয়েছে যে, সবাই মনে করছে আমি এখনো সরকারি দলেই আছি।
আমার অফিস বাংলাদেশ সচিবালয়ের পেছনে। আজ থেকে ২২ বছর আগে বর্তমান অফিসটি যখন কিনেছিলাম, তখন তোপখানা সড়কটি মতিঝিলের চেয়ে বহুগুণ নিরিবিলি ছিল। কিন্তু বর্তমানে মেট্রোরেলের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের যন্ত্রণায় আমাদের এই এলাকাটি রীতিমতো ভুতুড়ে এলাকা অথবা কখনো সখনো পরিত্যক্ত এলাকার মতো ভীতিকর হয়ে উঠেছে। গত দেড় বছর ধরে তোপখানা রোডসহ রাজধানীর অন্য যেসব এলাকায় মেট্রোরেলের কাজ চলছে সেসব এলাকার লোকজনের ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে উঠেছে। ওইসব এলাকার বাসিন্দাদের পারিবারিক জীবনে নানান জটিলতা দেখা দিয়েছে এবং তাদের শরীর-মন-মস্তিষ্কে নানাবিধ রোগবালাই বাসা বেঁধেছে, যার আর্থিক মূল্য নিরূপণ করা যাবে না। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট এলাকা দিয়ে যেসব গাড়ি-ঘোড়া চলছে সেগুলোর আয়ুষ্কালের বারোটা বাজছে। যাত্রী সব এবং পরিবহন শ্রমিকদের কিডনি, ফুসফুস এবং মস্তিষ্ক রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছে জ্যামিতিক হারে। মেট্রোরেলের কারণে মারাত্মক জনদুর্ভোগ এবং জনগণের শরীর, স্বাস্থ্য, মন ও আর্থিক জীবনে যে ক্ষয়ক্ষতি গত দেড় বছরে হয়েছে তা দিয়ে শত শত মেট্রোরেল নির্মাণ করা সম্ভব।
সরকারের যেসব অনভিজ্ঞ লোক মেট্রোরেল, পদ্মা ব্রিজ ইত্যাদি উন্নয়ন প্রকল্পের কথা বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করছেন অথবা বেকুব বানানোর অপচেষ্টা করছেন তারা যেদিন বুঝবেন যে তারা নিজেরা কতবড় শুভঙ্করের ফাঁকির মধ্যে পড়ে বেকুব হয়েছিলেন, তখন আর করার কিছু থাকবে না। আমি পৃথিবীর বহু দেশে চলমান মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্প দেখেছি। পদ্মা সেতু, রূপুর পারমাণবিক প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল অথবা ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ের চেয়ে শতগুণ বড় প্রকল্প দেখেছি ইউরাপ, এশিয়া, আমেরিকা অথবা আফ্রিকার অনেক দেশে। কিন্তু দেড় বছর ধরে বেড়া দিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা একই সাথে খোঁড়াখুঁড়ির নামে কালক্ষেপণ করে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো এবং ফাঁকি দিয়ে সরকারি তহবিল থেকে টাকা বের করে নেয়ার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা দেখিনি। সিঙ্গাপুরে যখন মেট্রোরেল হলো তখন লি কুয়ান ঠিক করে দিলেন, এক কিলোমিটার জায়গা তিনটি ধাপে নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করতে পারলেই পরবর্তী স্থানে কাজ আরম্ভ করার অনুমতি দেয়া হবে। ফলে মাত্র এক মাসের মধ্যে সিঙ্গাপুরের মেট্রোরেলের কিলোমিটার জায়গার নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিল।
আপনারা যারা সাংহাই পুডং বিমানবন্দর দেখেছেন অথবা নতুন সমুদ্রবন্দর দেখেছেন এবং বিমানবন্দর থেকে অথবা সমুদ্রবন্দর থেকে মূল শহরের সাথে সড়ক ও রেলপথটি দেখেছেন তারা যদি এগুলোর নির্মাণ ব্যয় এবং নির্মাণ সময় কত তা জানেন তবে নিজের গালে নিজেই চপেটাঘাত করতে ইচ্ছে করবে। আমাদের দুর্ভাগ্য! আমাদের দেশের শাসকরা জনগণকে বোকা মনে করে। এ দেশের ছাত্রদের তুলনায় শিক্ষকেরা কম মেধাবী এবং কর্মীর তুলনায় নেতাদের শিক্ষাদীক্ষা কম হওয়ার কারণে সর্বত্রই নির্বুদ্ধিতার জয়জয়কারের উদোম নৃত্য চলছে। দক্ষতা-অভিজ্ঞতা-দূরদৃষ্টি এবং দেশপ্রেম না থাকলে অহঙ্কারী স্বৈরাচারের কী অবস্থা হয় তা আমরা দস্যু বাচ্চাই সাক্কো, ইদি আমিন, আইভান দি টেরিবন অথবা সম্রাট কমোডাসের ক্ষেত্রে দেখেছি। সর্বকালের অন্যতম সেরা সম্রাট মার্কাস আর্লেয়িসের উত্তরাধিকারী হিসেবে কুখ্যাত কমোডাস অথবা আরেক কিংবদন্তির সম্রাট ক্লডিয়াসের কুখ্যাত উত্তরাধিকারী সম্রাট নিরোর পাগলামো, অশ্লীলতা এবং পরিণতি দেখেছি। এসব কুখ্যাত লোকও কিন্তু রাজকোষের বারোটা বাজিয়ে অপরিকল্পিত উন্নয়নের নামে একটি বেপরোয়া দুর্বৃত্ত প্রকৃতির দুর্নীতিবাজ শ্রেণী পয়দা করেছিল, যাদের কারণে একসময় রাষ্ট্র এমন দেউলিয়া হয়ে পড়েছিল যে, রাজকর্মচারীদের বেতন দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। ফলে ওইসব দুরাচারের নির্মম পতন এবং রক্তক্ষয়ী সিভিল ওয়ারের মাধ্যমে জনগণকে খেসারত দিতে হয়েছিল।
একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার সবচেয়ে নান্দনিক বিষয় হলো রাষ্ট্রের চেইন অব কামান্ড। অন্য দিকে, রাষ্ট্রের উন্নয়ন হলো একটি তেজি এবং পাগলা বন্য ঘোড়ার মতো। যারা এই ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরতে পারে, বন্যতাকে বশ করে পিঠের ওপর সওয়ার হতে পারে এবং নিজেদের ইচ্ছেমতো সেই ঘোড়ার গতি-প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তারাই উন্নয়নের সুফল জনগণের দুয়ারে পৌঁছে দিতে পারে এবং সেই উন্নয়ন কর্মের জন্য প্রশংসা নিতে পারে। যাদের এই যোগ্যতা নেই তাদের জন্য অপরিকল্পিত এবং বেহিসেবি উন্নয়ন একসময় গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিমতেÑ সরকারের বেশির ভাগ মেগা প্রকল্প কেবল সরকার নয়, পুরো দেশ জাতির জন্য গলার কাঁটা হয়ে দেখা দেবে, যার মধ্যে চলমান মেট্রোরেল প্রকল্পটি অন্যতম দুর্ভাগ্যের মহাকাব্য হিসেবে ইতিমধ্যেই ট্র্যাজেডির সিম্পোনি বাজাতে শুরু করেছে। এই প্রকল্পের ছোট একটি অংশে প্রতিদিন কী ধরনের জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে তা আমি সেদিন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি এবং সেই কাহিনী বলেই আজকের নিবন্ধের ইতি টানব।
নিবন্ধের শুরুতে যে দিনটির কথা বলছিলাম, সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠান হয়েছিল। আমি সাধারণত গুলিস্তান-কার্জন হল-শহীদ মিনার-পলাশী হয়ে নীলক্ষেত দিয়ে নিউ মার্কেট পার হয়ে বাসায় ফিরি। সমাবর্তন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ভিড় হতে পারে এই শঙ্কায় মৎস্য ভবন-শাহবাগ-এলিফ্যান্ট রোড হয়ে বাসায় ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিসমিল্লাহ বলে গাড়িতে উঠলাম। আমি যেহেতু রোজা ছিলাম তাই শরীরের পানিশূন্যতা দূর করার জন্য অফিস ত্যাগের আগে দুই গ্লাস পানি পান করে নিলাম। আমার ধারণা ছিল, সর্বোচ্চ এক ঘণ্টার মধ্যে বাসায় ফিরতে পারব। কিন্তু পুরো দুই ঘণ্টা ধরে জ্যামে আটকে থেকে যখন শাহবাগ মোড় পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলাম না, তখন বারবার মনে হচ্ছিল কেনো আমি অফিস থেকে নামার আগে বেকুবের মতো দুই গ্লাস পানি পান করেছিলাম। কারণ, প্রস্রাবের চাপে আমি তখন পাগল হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম।
প্রাকৃতিক প্রয়োজনে পাগলপারা হয়ে আমি গাড়ির মধ্যে বসে কী করা যায় তা নিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবছিলাম। একবার মনে হচ্ছিল অন্যসব যাত্রীর মতো আমিও গাড়ি থেকে নেমে সোহরাওয়ার্দী পার্ক অথবা রমনা পার্কের ওয়াল ভাসিয়ে দিয়ে আসি। পাবলিক বাসের যাত্রীদের মধ্যে যাদের অবস্থা আমার মতো হয়েছিল, তারা অকথ্য ভাষায় বাবা-মা তুলে বিভিন্ন সম্মানিত মানুষজনকে গালাগাল করতে করতে পার্কের ওয়াল ভেজানোর জন্য ভোঁদৌড় দিচ্ছিল। ফুটপাথ দিয়ে চলাচলকারী নারী-পুরুষরা যেই ওয়াল ভেজানোর দৃশ্য দেখে একটুও বিরক্ত না হয়ে বরং উষ্ণ বারি বর্ষণের রিমঝিম শব্দের সাথে তালমিলিয়ে তথাকথিত সম্মানিত লেকাদের অশ্লীল ভাষায় বাবা-মা তুলে গালি দিচ্ছিল। মাঝে মধ্যে যখন গাড়িগুলো একটু এগুনোর চেষ্টা করছিল তখন প্রস্রাবরত লোকেরা তাদের প্রাকৃতিক কর্ম অর্ধসমাপ্ত রেখে প্যান্টের চেইন টানতে টানতে বাসের দিকে দৌড় দিচ্ছিল। কিন্তু বাসগুলো যখন দুই-চার গজ এগোনোর পর আবার থেমে যাচ্ছিল, তখন সেই লোকগুলো পুনরায় প্যান্টের চেইন খুলতে খুলতে দ্বিতীয়পর্বের বারি বর্ষণের মাধ্যমে পার্কের ওয়াল ভেজানোর দায়িত্ব পালনের জন্য দৌড় দিচ্ছিল।
উল্লেখিত দৃশ্য দেখার পর আমার মনের প্রতিক্রিয়া কেমন হয়েছিল, তা এখন আর মনে করতে পারছি না। তবে ক্রমেই ধৈর্য হারিয়ে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছিলাম। চার দিকে ধুলোর ঝড়ে হকারদের হইহুল্লোড়, গাড়ির কালো ধোঁয়া এবং বিভিন্ন গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বের করে নারী-পুরুষ ও শিশুদের অবিরত বমি করার দৃশ্য দেখে সারা শরীর রি রি করছিল। তলপেটের অবস্থা এমন হয়েছিল, তাতে মনে হলো পুরো পৃথিবীর ওজন সেখানে ভর করছে এবং অনেক কাল নাগিণীর বিষে আমি আক্রান্ত হয়েছি। এ অবস্থায় প্রায় দুই ঘণ্টা কাটানোর পর শাহবাগ মোড় পর্যন্ত পৌঁছলাম। গাড়িটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে নিয়ে যেতে বললাম এবং ক্লাবে পৌঁছে উদভ্রান্তের মতো বাথরুমের দিকে এমনভাবে দৌড় দিলাম যে আমাকে দেখে যারা সালাম দিলেন তাদের দিকে তাকানোর ফুরসৎটুকুও পেলাম না।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য