বিরল খনিজ : যেখানে চীনের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের হার
বিরল খনিজ : যেখানে চীনের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের হার - ছবি : সংগ্রহ
ভূ-রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রভাব ঐতিহাসিক কাল থেকেই ছিল। তবে প্রাকৃতিক সম্পদের গুরুত্ব ভেদে একেক সময় একেকটি অঞ্চল বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। মধ্যপ্রাচ্য বিশ্বরাজনীতির প্রভাব বিস্তারের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল জ্বালানি সম্পদের বিশাল মজুদ। জ্বালানিসাশ্রয়ী এবং হাইব্রিট প্রযুক্তি আবিষ্কারের সাথে সাথে এই অঞ্চল আগের গুরুত্ব ধীরে ধীরে হারাচ্ছে আর সেই সাথে রেয়ার আর্থ তথা বিরল মৃত্তিকা ধাতব উপাদানের মজুদ নতুন ভূ-রাজনীতির নিয়ন্ত্রকে পরিণত হচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় অঞ্চলগুলোকে বিশ্বশক্তি তার প্রাধান্য বিস্তারের ক্ষেত্রে পরিণত করছে।
বলা হচ্ছে, নতুন শতাব্দীতে বিশ্বের শক্তিকেন্দ্র এশিয়াতে সরে আসবে। নতুন উত্থানে চীন হবে শক্তিমান প্রতিপক্ষ। নব উত্থানের তিন দশক সময়ে দেশটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। অচিরেই সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে চীন। চীনের এই উত্থানের অন্তর্নিহিত বিষয়টি নিয়ে কমই আলোচনা হয়। চীনের অর্থনৈতিক শক্তি, যার পথ ধরেই হচ্ছে সামরিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, তার পেছনে রয়েছে বিরল মৃত্তিকা ধাতবের বিশাল মজুদ। আর এশিয়ার যেসব গোলযোগপূর্ণ এলাকায় দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত লেগে আছে অথবা নতুন নতুন সঙ্ঘাত সৃষ্টি হচ্ছে, তার পেছনেও রয়েছে এই রেয়ার আর্থের সম্ভাব্য মজুদ এবং সাশ্রয়ী উত্তোলন সম্ভাবনা।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং সীমান্তবর্তী পাহাড়ি অঞ্চল এখন এ ক্ষেত্রে বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করছে বিশ্ব শক্তিগুলোর। ভারতের সাত রাজ্য এবং মিয়ানমারের আরাকান ও শিন অঞ্চলের গুরুত্বও বৃদ্ধি পাচ্ছে একই সাথে। আফগানিস্তানে প্রভুত্ব বিস্তারে যে পরাশক্তিগুলোর প্রতিযোগিতা তার পেছনেও রয়েছে এই বিরল প্রাকৃতিক খনিজ মৃত্তিকা সম্পদের ভূমিকা।
নাম একই, কিন্তু রয়েছে পার্থক্যও
রেয়ার আর্থ বা বিরল মৃত্তিকা ধাতব উপাদানকে প্রায়ই একটি ব্র্যাকেটে রেখে আলোচনা করা হয়। তবে এর উপাদানগুলোর স্বতন্ত্র গুণাবলি রয়েছে। এগুলো ভিন্ন ভিন্ন পণ্য তৈরির জন্য নির্দিষ্টভাবে ব্যবহার হয়। বাতি এবং চশমা থেকে শুরু করে স্থায়ী চুম্বক ও গাইডেন্স সিস্টেম এবং বৈদ্যুতিন সামগ্রীর প্রতিটিতে ব্যবহারের জন্য আলাদা উপাদান বা উপাদানগুলোর পৃথক সমন্বয় প্রয়োজন হয়। অধিকন্তু সব বিরল মৃত্তিকা উপাদান অভিন্ন ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না; এগুলো বিভিন্ন জায়গায় এবং বিভিন্ন ঘনত্বের মধ্যে পাওয়া যায়। এই বিভিন্ন ধরনের খনিজ ধাতব উপাদানকে ওজনের ওপর ভিত্তি করে সাধারণভাবে দু’টি ভাগে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। এই দু’টি হলো, হালকা বিরল মৃত্তিকা উপাদান (এলআরইই) এবং ভারী বিরল মৃত্তিকা উপাদান (এইচআরইই)। চীন মাঝারি বিরল মৃত্তিকা উপাদান নামে (এমআরইই) একটি অতিরিক্ত ভাগ করেছে রেয়ার আর্থের।
দুর্লভ মৃত্তিকার রাজা চীন
চীন পৃথিবীর বিরল মৃত্তিকা উপাদানগুলোর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মজুদের অধিকারী। আর এর সাশ্রয়ী সংগ্রহযোগ্যতার ফলে এই খাতটিতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপকভাবে আধিপত্য বিস্তার করছে দেশটি। ১৯৬০-এর দশকে চীন রেয়ার আর্থের নতুন মজুদ আবিষ্কার করার পরে, ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে এটি বিশ্বের প্রধান বিরল মৃত্তিকা উপাদান উৎপাদনকারী হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যায়। এর পর থেকে দেশটি কেবলই আধিপত্য বিস্তার করেছে। চীনের বিরল মৃত্তিকা উপাদানগুলোর উৎপাদন ভৌগোলিকভাবে উভয় ভাগে বিভক্ত আর মুষ্টিমেয় খনিতে এর মজুদ খুব বেশি পরিমাণে কেন্দ্রীভূত। ইনার মঙ্গোলিয়ায় চীনের হালকা মৃত্তিকা ধাতব উৎপাদনের প্রায় ৭০ শতাংশ একক খনি বাওতউ বায়ান ওবো মাইন থেকে পাওয়া যায়, যা চীনের মোট বিরল মৃত্তিকা ধাতবের ৫০ শতাংশেরও বেশি। ১৯৬০ এর দশকে দক্ষিণ চীনে প্রথম ভারী বিরল মৃত্তিকা ধাতব আবিষ্কৃত হয় আর দেশের বেশির ভাগ এইচআরইই এখান থেকে উৎপাদিত হয়। চিয়াংসি প্রদেশে এককভাবে চীনের প্রায় ৫০ শতাংশ এমআরইই এবং এইচআরইই উৎপাদিত হয়। আর গ্যানজাউ শহরে তার বেশির ভাগই উৎপাদিত হয় বলে নগরটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শিল্পনগরীতে পরিণত হয়।
চীনের পর্যাপ্ত এবং বড় বড় খনি থাকলেও একই সাথে বিরল মৃত্তিকা ধাতব উপাদান সরবরাহের প্রক্রিয়াজাতকরণের পদক্ষেপগুলোর নিয়ন্ত্রণও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অন্যান্য অংশ থেকে উপাদানগুলোকে পৃথক করা হয়। এ ক্ষেত্রে চীন একপ্রকার একচেটিয়াত্ব অর্জন করেছে এর মধ্যে। এই খনি এবং এর আহরণ প্রক্রিয়ায় চীনা একচেটিয়াত্ব বিশ্বব্যাপী রেয়ার আর্থ সরবরাহে ঝুঁকিও নিয়ে আসে। ২০১০ সালে চীন হঠাৎ করে বিরল মৃত্তিকা আকরিক, লবণ এবং ধাতবের বড় ভোক্তা জাপানের কাছে এটি রফতানি বন্ধ করে দেয়। জাপান বিরল মৃত্তিকা উপাদান দিয়ে উৎপাদিত অনেক পণ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করে। এতে চীনা বিধিনিষেধ আমেরিকান বাজারেও প্রভাব ফেলে। নিষেধাজ্ঞাটি সাময়িক হলেও, এটি বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের জন্য একটি সতর্কসঙ্কেত পাঠায়। আর বিভিন্ন দেশ ও প্রস্তুতকারককে বিকল্প বিরল মৃত্তিকা ধাতব উৎসের সন্ধান ও বিকাশে উদ্বুদ্ধ করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিরক্ষা সামগ্রী উৎপাদনে চূড়ান্তভাবে নির্ভর করে চীনের ওপর। এ নির্ভরশীলতার সুযোগে চীনের কোটা আরোপের বিরুদ্ধে ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনে ওয়াশিংটন একটি মামলা করে এবং তাতে জয়ী হয়। এরপর ২০১৫ সালে বেইজিং বিরল মৃত্তিকা উপাদান রফতানির ওপর কোটা প্রত্যাহার করে। তবে জাপানে রফতানি নিষেধাজ্ঞার পরের বছরগুলোতে, চীনের বাইরে বিশ্বের অন্যান্য অংশগুলোতে বিরল ধাতব অনুসন্ধানে অল্প বিস্তর সাফল্য অর্জন হয়। মালয়েশিয়ায় একটি নতুন পরিবেশগতভাবে বিতর্কিত প্রক্রিয়াকরণ সুবিধার সাথে তার হালকা বিরল মৃত্তিকা উপাদান উৎপাদন বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হয় অস্ট্রেলিয়া। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মলিকর্প মাইনিং সংস্থা ২০১২ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় মাউন্টেন পাসের খনিটি পুনরায় চালু করে। অবশ্য মাত্র তিন বছর পরে ক্ষেত্রটি বন্ধ হয়ে গেলে কোম্পানিটি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে। চীন এখনো বিশ্বের মোট বিরল মৃত্তিকা উৎপাদনের বিস্তৃত অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। বৈদ্যুতিক যানবাহন এবং বায়ু টারবাইনগুলোতে স্থায়ী চুম্বক তৈরি করার জন্য ডিসপ্রোজিয়াম এবং টার্বিয়ামের মতো প্রয়োজনীয় কিছু মাঝারি ও ভারী বিরল মৃত্তিকা উপাদানের কার্যত সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চীনের হাতে। দেশটি বিশ্বব্যাপী রেয়ার আর্থ সরবরাহের ৯৮ শতাংশেরও বেশি নিয়ন্ত্রণ করে।
সর্বোপরি, বিরল মৃত্তিকা উপাদানের পরিশোধন প্রক্রিয়া পরিবেশগতভাবে ক্ষতিকারক উপজাত তৈরি করে এবং যা নিয়ন্ত্রণ হয় অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এটি পরিবেশ গ্রুপ এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করে। ক্ষয়ক্ষতি রোধ এবং অদক্ষ শিল্পগুলোকে একীভূত করতে চীনের বিস্তৃত ও সফল প্রচেষ্টার ফলে বেইজিং দুর্লভ মৃত্তিকা পরিশোধন খাতের ওপর রাজত্ব জোরদার করতে পেরেছে। দেশটি অবৈধ খনির ওপর অভিযান চালিয়ে তা নিয়ন্ত্রণ করেছে। অ্যাডামাস ইন্টেলিজেন্সের তথ্য অনুসারে, ২০১৩ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত সময়ে ডিসপ্রোজিয়াম অক্সাইডের অবৈধ উৎপাদন ৩৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। আর দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সাথে যুক্ত একীকরণের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে, বেইজিং ২০২০ সালের পরে বিরল মৃত্তিকা উপাদানগুলোর উৎপাদন এক লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন ছাড়াতে চায় না। ২০১৮ সালে এটি ছিল এক লাখ ২০ হাজার টন এবং ২০১৯ এর প্রথমার্ধে উৎপাদন এর চেয়ে কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে।
অবৈধ খনিজ উৎপাদন মোকাবেলায় চীন প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার চূড়ান্ত মুহূর্তটি আসবে যখন বেইজিং সিদ্ধান্ত নেবে যে মিয়ানমার থেকে বিরল মৃত্তিকা উপাদান আমদানির অনুমতি চালু রাখা হবে কিনা। দীর্ঘসময় ধরে সন্দেহ করা হয় যে ডিসপ্রোজিয়াম, টার্বিয়াম এবং গ্যাডোলিনিয়ামের খনিজগুলো অবৈধভাবে চীনের সীমানাবর্তী মিয়ানমারের খনি থেকে উত্তোলন করা হয়েছে।
বাড়ছে চাহিদা
হাইব্রিড প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়ার সাথে সাথে বৈশ্বিক স্তরে বিরল মৃত্তিকা উপাদানগুলোর চাহিদা বাড়ছে। সেরিয়াম এবং ল্যান্থানাম হলো বিরল মৃত্তিকা উপাদান, যা সর্বোচ্চ পরিমাণে ব্যবহার করা হয়। তবে এনডিএফইবি চুম্বক হিসেবে পরিচিত নিউওডিয়ামিয়াম, ডিসপ্রোজিয়াম এবং টেরবিয়াম পূর্ব বর্ণিত স্থায়ী চুম্বকগুলোতে ব্যবহৃত হয় আর এই গ্রুপের উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমে প্রস্তুত বৈদ্যুতিক গাড়ির মোটর এবং বায়ু টারবাইনগুলোর চাহিদা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই চাহিদা বৃদ্ধি ইউরোপ, চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জীবাশ্ম জ্বালানি চালিত যানবাহন বিক্রি নিষিদ্ধ করা এবং পুনঃনবীকরণ জ্বালানি শক্তি কমানোর উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার সমর্থন পাচ্ছে।
চীন শুধু বিশ্বের বেশির ভাগ বিরল মৃত্তিকা উপাদান উৎপাদন করে না, সেই সাথে দেশটি বিশ্বের স্থায়ী চুম্বক খাদগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশ উৎপাদন করে। একই সাথে দেশের নিজস্ব বৈদ্যুতিক গাড়ির চাহিদা এবং এর রফতানির কারণে স্থায়ী চুম্বকগুলোর নিজস্ব চীনা উৎপাদন বাড়ছে। চুম্বকের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে চীনা নিজস্ব চাহিদাও বাড়বে। প্রকৃতপক্ষে, তিন দশকের উন্নত বিশ্বের বিরল মৃত্তিকা উপাদানগুলোর সরবরাহকে নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টার কারণে চীন এখন বিশ্বের বৃহত্তম আমদানিকারক দেশেও পরিণত হয়েছে। ২০১৮ সালে, চীন ৫৩ হাজার মেট্রিক টন বিরল মৃত্তিকা উপাদান রফতানি করেছে আর ৪১ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন আমদানি করেছে। মালয়েশিয়ার লিনাস এবং অস্ট্রেলিয়ার মাউন্ট ওয়েল্ড খনিটির পরিকল্পিত সম্প্রসারণ আংশিকভাবে চীনা চাহিদাকে সমর্থন করছে।
বিকল্পের সন্ধান
বিরল মৃত্তিকা উপাদানগুলোর ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক চাহিদা এবং একই সাথে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির দ্বারা চালিত চীনা রফতানি যৌক্তিকভাবে দেশগুলোকে বিকল্প উৎস সন্ধান প্রচেষ্টাকে অগ্রাধিকার দিতে উদ্বুদ্ধ করবে। তবে নতুন বিরল মৃত্তিকা উপাদান উৎপাদন প্রচেষ্টার সাফল্যে বাধাও তৈরি হতে দেখা যায়। কারণ আকরিক থেকে বিরল মৃত্তিকা ধাতবগুলো অপসারণ করার সাথে প্রয়োজনীয় কাস্টিক ও দূষণকারী উপকরণগুলো যুক্ত যার সাথে উচ্চ পরিবেশগত ব্যয় সংশ্লিষ্ট। জাপান, তার উচ্চ-মূল্যের উৎপাদন খাতের দুর্বলতা সম্পর্কে গভীরভাবে সচেতন, কখনো কখনো সমুদ্রতটে বিরল মৃত্তিকার সন্ধান করে। তবে এ ধরনের মজুদ থেকে রেয়ার আর্থ আহরণ অর্থনৈতিকভাবে টেকসই হতে বহু সময় লাগবে।
বিকল্পে সাফল্যের সর্বাধিক সম্ভাবনা রয়েছে এমন কয়েকটি নতুন সম্ভাব্য মাইনিং অপারেশন রয়েছে অস্ট্রেলিয়া এবং গ্রিনল্যান্ডে। তবে কিছু দেশের কঠোর পরিবেশসংক্রান্ত বিধিমালা এবং নিয়ন্ত্রণ পরিবেশগত ব্যয় বাড়িয়ে দেয়।
বিরল মৃত্তিকা উপাদানগুলোর ব্যবহার কমাতে পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার এবং প্রযুক্তিগত সমন্বয় বা সম্পূর্ণ বিকল্প প্রযুক্তিতে সরিয়ে নেয়া হলো অন্য বিকল্প। পরিশোধন প্রক্রিয়া চলাকালীন প্রচুর পরিমাণে উপাদান নষ্ট হয় এবং পরিশোধন বা তৈরির সময় এখন যা নষ্ট হয় তা থেকে বাড়তি উপাদান পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে। এ ছাড়া, ব্যবহৃত বিরল মৃত্তিকা উপাদানগুলো রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করার বিষয়ও বিবেচনায় আনা যেতে পারে।
বিরল মৃত্তিকা উপাদানগুলোর সরবরাহ যদি হুমকির মধ্যে পড়ে অথবা যদি ধাতু বা চুম্বকগুলো খুব ব্যয়বহুল হয় তাহলে বৈদ্যুতিক যানবাহন প্রস্তুতকারীরা অন্যান্য ইঞ্জিনের দিকে নজর দিতে পারে। যদিও বাজারের প্রতিটি বৈদ্যুতিক গাড়ির মডেল স্থায়ী চুম্বক মোটর ব্যবহার করে না, তবে এর একটি বড় অংশ তা করে। পণ্যের লাইন পরিবর্তন করা একটি সময় নিবিড় বিষয় এবং ব্যয়বহুল সিদ্ধান্ত যা সব সংস্থা নিতে ইচ্ছুক হয় না, যার অর্থ স্থায়ী চুম্বক মোটরের বিলুপ্তির সম্ভাবনা শিগগিরই হবে বলে মনে হয় না।
অবিলম্বে কার্যকর কিছু বিকল্প সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী বিরল মৃত্তিকা সরবরাহ শৃঙ্খলা অদূরবর্তী মেয়াদে ঝুঁকির মধ্যে থেকে যাবে আর সম্ভাব্য ভবিষ্যতের সরবরাহ ঘাটতি এখন এই উপাদানগুলোর বৃহত্তম উৎপাদক চীনকেও হুমকির মুখে ফেলছে। এখন চীন তার নিজস্ব আমদানির মাধ্যমে বিরল মৃত্তিকা উপাদান সরবরাহের শৃঙ্খলে আরো ঘনিষ্ঠভাবে আবদ্ধ বলে এটিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নিষেধাজ্ঞায় ব্যবহার করে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি নেবে এমন সম্ভাবনা কম। তবে তার মানে এই নয় যে, এর ওপর একচেটিয়া চীনা নিয়ন্ত্রণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানের মতো দেশগুলোর পক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ নয়।
শেষ পর্যন্ত, বৈশ্বিক জ্বালানি শক্তির অগ্রাধিকারগুলোর স্থানান্তর এর পর্যাপ্ত চাহিদা বাড়াবে বলে মনে হয়। আর বাজারকে অবশ্যই নতুন সংস্থানগুলোর বিকাশে বাস্তব ও সম্মিলিত অগ্রগতি অর্জন করতে হবে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপান উভয়ই ধীরে ধীরে বৈচিত্র্যকরণ প্রক্রিয়া চলাকালীন ভঙ্গুর থাকবে।
ভূ-রাজনীতি ও রেয়ার আর্থ
ইটরিয়াম এবং স্ক্যান্ডিয়ামের একত্রিতভাবে বিরল মৃত্তিকা উপাদান হিসাবে পরিচিত। এগুলো খুব অল্প পরিমাণে ব্যবহৃত হলেও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা খাত এবং উদীয়মান ও সম্ভাব্য প্রযুক্তির কাছে তাদের তাৎপর্য অনেক। বাজারের বেশির ভাগ অংশের ওপর চীনের নিয়ন্ত্রণ দুর্লভ মৃত্তিকা উপাদানগুলোকে ভূ-রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা দিয়েছে।
বিরল মৃত্তিকা উপাদানগুলো ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা খাতের জন্য বেশ জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে বিরল মৃত্তিকা শক্তি এর রূপান্তর ও পরিবহন বিবর্তনকে কেন্দ্র করে অদূরভবিষ্যতে বিশ্বের দুর্লভ খনন, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং ভূ-রাজনৈতিক গতিবেগকে আরো জোরালোভাবে প্রভাবিত করবে। অদূরভবিষ্যতে চীন এর ওপর তার প্রায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ থেকে লাভবান হবে। তবে শেষ পর্যন্ত নিজস্ব ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ চাহিদা খাতটির ওপর নিয়ন্ত্রণের সময়কালকে সীমাবদ্ধ করবে। একই সাথে এর বিকল্প উৎস অনুসন্ধানে বিশ্বশক্তি মনোযোগ দেয়ার কারণে এশিয়া বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য সম্ভাবনাময় অঞ্চলগুলোর গুরুত্ব বাড়বে।
বাংলাদেশে বিরল মৃত্তিকা ধাতব
২০০০ সালে বাংলাদেশের ১২ জন জ্বালানি সাংবাদিক ইউএসএআইডির আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফর করেন। এই সফরের সময় ওয়াশিংটন ডিসিতে ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভের অফিসে আমাদের টিম সদস্যদের সামনে সারা বিশ্বের জ্বালানি ও খনিজসম্পদের মজুদের ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিডিও বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়। এখানে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কয়েকটি দেশের সাথে বাংলাদেশে জ্বালানি ও খনিজসম্পদের সম্ভাব্য মজুতের ওপর আলোকপাত করা হয়। আর এ ক্ষেত্রে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলকে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় এলাকা হিসেবে দেখানো হয়। ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভের তথ্য অনুসারে, প্ল্যাকার, শোরলাইন, আরইই মিনারেল- মোনাজাইট, ইয়ার মিনারেলস- ইলমনাইট গোমেদ-মণি ম্যাগনেটাটের মজুদ রয়েছে বাংলাদেশে। জাতিসঙ্ঘের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন (এসকাপ) এবং অস্ট্রেলিয়ান ব্যুরো অব মিনারেল রিসোর্সেস জিওলজি অ্যান্ড জিওফিজিক্সের ‘মিনারেল কনসেন্ট্রেশনস অ্যান্ড হাইড্রোকার্বন একিউমুলেশন ইন এসকাপ রিজিয়ন’ শীর্ষক এক নিবন্ধের রেফারেন্স দিয়ে এ তথ্যের উল্লেখ করা হয়।
বিবেচ্য লেখার সাথে উল্লেখ করা বৈশ্বিক রেয়ার আর্থ মজুদের যে কেন্দ্র দেখানো হয়েছে, তাতেও রয়েছে বৃহত্তর চট্টগ্রাম। এতে কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতের ইনানী অঞ্চলকে বিভিন্ন রেয়ার আর্থ উপাদানের ক্ষেত্রে বেশ সমৃদ্ধ হিসেবে দেখানো হয়। এর বাইরেও কক্সবাজারের সৈকতে রেয়ার আর্থের ধাতব উপাদান প্রাপ্তির বিষয় বিভিন্ন গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামেও রেয়ার আর্থের উপাদান মজুদ থাকতে পারে বলে ধারণা ব্যক্ত করা হয়েছে।
সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের যে অঞ্চল থেকে রেয়ার আর্থ আহরণ করে চীনে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে সেটিও বান্দরবান পার্বত্য জেলার কাছাকাছি। পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্তবর্তী উত্তর-পূর্ব ভারতের পার্বত্য এলাকাগুলোও এ ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় বলে উল্লেখ করা হয়। তিন দেশের সংযোগের পার্বত্য ও সন্নিহিত উপকূলীয় যে অঞ্চলটিতে অস্থিরতার উপাদানগুলোকে উসকে দেয়া হচ্ছে তার সাথে অন্য অনেক ফ্যাক্টরের পাশাপাশি রেয়ার আর্থের সম্ভাব্য মজুদও একটি কারণ বলে ধারণা করা হয়।
আফগানিস্তান নিয়ে পরাশক্তিগুলোর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের পেছনে রেয়ার আর্থের গুরুত্বপূর্ণ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে উল্লেখ করেছিলেন পাকিস্তানের একজন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ। পরলোকগত সাংবাদিক সাদেক খানের নেতৃত্বে এক মিডিয়া প্রতিনিধি দলের দেশটি সফরকালে রাওয়ালপিন্ডিতে এক ব্রিফিং অনুষ্ঠানে এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক আফগানিস্তানে কী কী ধরনের মূল্যবান খনিজ ধাতব রয়েছে তার একটি বর্ণনাও দিয়েছিলেন। এ সময় সাদেক খান ছাড়াও হলিডে সম্পাদক সৈয়দ কামাল উদ্দিন, দিনকাল সম্পাদক ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী এবং আমি উপস্থিত ছিলাম। এ সময় এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার অন্য কয়েকটি ক্ষেত্রেও প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার গ্রহণের লড়াইয়ের ওপর আলোকপাত করেছিলেন পাকিস্তানের নৌ বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত শীর্ষ এই কর্মকর্তা।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মধ্যপ্রাচ্যে যে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত তার পেছনে জ্বালানি সম্পদের যে ভূমিকা এক সময় ছিল সেটি দক্ষিণ এশিয়া ও সংলগ্ন অঞ্চলে স্থানান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা এখন অনেকখানি স্পষ্ট। আর তার পেছনে বিরল মৃত্তিকা উপাদান সম্পদের রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। এ ধরনের মূল্যবান সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই বিভিন্ন সময় ভূ-রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে। এই প্রভাব থেকে বাংলাদেশ ও সংশ্লিষ্ট অঞ্চল মুক্ত থাকবে বলে মনে হচ্ছে না।
mrkmmb@gmail.com