ইহুদিরা কেন করবিনের প্রতি ক্ষিপ্ত?
ইহুদিরা কেন করবিনের প্রতি ক্ষিপ্ত? - ছবি : সংগ্রহ
ব্রিটেনের নির্বাচনে লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন হেরে যান, এমন প্রত্যাশা ইসরাইলের। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরাইল কাটজ নির্বাচনের মাত্র এক সপ্তাহ আগে করবিনের বিরুদ্ধে ইসরাইলবিদ্বেষী নীতি উসকে দেয়ার অভিযোগ এনেছেন। করবিন জয়ী হলে অনেক ব্রিটিশ-ইহুদি স্বেচ্ছায় দেশত্যাগ করতে পারে এমন আশঙ্কা তার। কিন্তু ইহুদিদের জন্য কতটা হুমকি জেরেমি করবিন? একজন বামপন্থী রাজনীতিক হিসেবে যিনি ৩০ বছর পার্লামেন্টের পেছনের আসনে থেকে গেছেন, বিতর্কিত নানা ইস্যু সমর্থন করেছেন, বিবেকের তাড়নায় হরহামেশা দলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন, সেই জেরেমি করবিন ২০১৫ সালে দলের নেতা নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে বিস্ময় সৃষ্টি করেন।
নেতৃত্বের নির্বাচনে অংশ নিতে লেবার পার্টির বামপন্থী অংশটি করবিনকে রাজি করিয়েছিলেন। তবে ঘুণাক্ষরেও কেউ ভাবেননি, তিনি নির্বাচিত হবেন। বেটিং কোম্পানিগুলো বলেছিল- তার সম্ভাবনা ২০০-এর মধ্যে। কিন্তু স্বল্পভাষী, দাড়িওয়ালা ৬৬ বছরের এই এমপির ব্যক্তিত্বে এমন অজানা কিছু ছিল যা লেবার পার্টির সদস্যদের আকর্ষণ করেছিল। অন্য তিন চৌকস, কমবয়সী, কেরিয়ার রাজনীতিকের বদলে তারা করবিনকে বিপুল ভোটে নেতা নির্বাচিত করে ফেলেন।
টনি ব্লেয়ার এবং গর্ডন ব্রাউনের নেতৃত্বের সময়ে লেবার পার্টির প্রতি নিরাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন যারা তাদেরকে আবার উদ্বেলিত করতে সমর্থ হন জেরেমি করবিন। দলে দলে লেবার পার্টিতে নাম লেখাতে থাকেন হাজার হাজার মানুষ, বিশেষ করে তরুণ যুবকরা। যে বামধারার রাজনীতিকে লেবার পার্টি থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন টনি ব্লেয়ার, জেরেমি করবিনের নির্বাচনে তার পুনরুত্থানের সম্ভাবনা তৈরি হয়।
উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন লেবার পার্টির এমপিদের বেশির ভাগ। তারা বলতে থাকেন- করবিন আবার লেবার পার্টিকে অতীতে নিয়ে যাচ্ছেন এবং তাতে দলের ক্ষমতায় ফিরে আসার সব সম্ভাবনা ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে। ছায়াসরকার থেকে একের পর এক লেবার এমপি পদত্যাগ করেন। খোলাখুলি বিদ্রোহ শুরু করেন নেতার বিরুদ্ধে।
চাপের মধ্যে কয়েক মাসের মধ্যে আবার নেতা নির্বাচন ডাকেন জেরেমি করবিন। আবার বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। নেতৃত্ব নেয়ার দুই বছর না যেতেই সাধারণ নির্বাচনের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। এরপর পেরিয়ে গেছে আরও কিছু সময়। এবারের নির্বাচনের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের এক্সিট বা ব্রেক্সিট নিয়ে অচলাবস্থার প্রেক্ষাপটে আজ অনুষ্ঠিত হবে ব্রিটেনের আগাম নির্বাচন।
সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম জেরেমি বার্নার্ড করবিনের। উইল্টশায়ার কাউন্টির কিংটন সেন্ট মাইকেল নামে ছবির মতো এক গ্রামে ছেলেবেলা কাটে তার। চার ভাইয়ের সবচেয়ে ছোট ছিলেন তিনি। মা ছিলেন শিক্ষক, বাবা ছিলেন প্রকৌশলী। কিন্তু দু’জনেই যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। বাড়িতে রাজনীতি নিয়ে নিয়মিত আলোচনা বিতর্ক হতো। জেরেমি করবিনের বড় ভাই পিয়েরস একজন কড়া বামপন্থী।
স্কুল ছাড়ার পরপরই পোশাক শ্রমিকদের ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হন জেরেমি করবিন। পরে ইঞ্জিনিয়ারিং ও ইলেকট্রিক্যাল ইউনিয়নে এবং ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব পাবলিক এমপ্লয়িজের সাথে যুক্ত হন। কিন্তু তার আসল উৎসাহ ছিল লেবার পার্টি। ১৯৭৪ সালে লেবার পার্টির পক্ষ থেকে উত্তর লন্ডনের হ্যারিংগে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন তিনি। ওই একই বছর সহকর্মী নারী কাউন্সিলর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জেন চ্যাপম্যানের সাথে তার বিয়ে হয়।
টনি ব্লেয়ারও উত্তর লন্ডনের একই এলাকার বাসিন্দা। একই সময়ে দু’জন পার্লামেন্টে ঢোকেন। কিন্তু রাজনীতি তাদের ব্যবধান বিশাল। টনি ব্লেয়ারের অবাধ বাণিজ্যনীতির ঘোর বিরোধী ছিলেন জেরেমি করবিন। সে জন্য বারবার সরকারের আনা বিভিন্ন প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন তিনি। দলের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। ’৭০ ও ’৮০-এর দশকে লেবার পার্টিতে যখন অন্তর্কলহ চরমে ওঠে, করবিন তখন দলের বামপন্থী অংশের সাথে ছিলেন।
লেবার পার্টির মৃত বাম নেতা টনি বেনের শিষ্য ছিলেন তিনি। টনি বেনের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ধারণায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। দু’জনেই বিশ্বাস করতেন, রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সরকারের হাতে থাকতে হবে। একতরফা পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের সমর্থক ছিলেন তারা। অভিন্ন আয়ারল্যান্ডের সপক্ষে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন।
ফিলিস্তিনিদের স্বশাসনের পক্ষে কথা বলেছেন সবসময়। শান্তি আলোচনায় হামাসকে অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছেন। একসময় আইআরএ’র সাথে মীমাংসা আলোচনার কথা বলেছেন। নির্বাচনী প্রচারণায় প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ এবং দক্ষিণপন্থী মিডিয়া এসব প্রশ্ন তুলে তাকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে। জেরেমি করবিন ভবিষ্যতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে দেশটি থেকে অনেক ইহুদি অন্যত্র চলে যাবেন, এমন মন্তব্য করেছেন সিনিয়র ইউরোপীয় রাব্বি পিনচাস গোল্ডসচিমিট। তিনি বলেছেন, ব্রিটিশ লেবার পার্টি বা ফ্রান্সে ন্যাশনাল ফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করলে এ দু’টি দেশে ইহুদিরা তাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে নিরাপত্তার অভাব বোধ করলে অন্যত্র চলে যেতে পারে। এ ধরনের ইহুদির সংখ্যা সহস্রাধিক হতে পারে বলেও তিনি হুঁশিয়ারি দেন।
ব্রিটিশ লেবার পার্টির মধ্যে যে ইহুদিবিদ্বেষের অভিযোগ রয়েছে, দলটির নেতা জেরেমি করবিন সে ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ নেননি বলে অভিযোগ উঠেছে। ইসরাইল সম্পর্কে তার অতীত বক্তব্য ও ইসরাইলবিরোধীদের সাথে সম্পর্কের কারণেও তাকে বিতর্কিত বলা হচ্ছে। এর আগে ব্রিটিশ-ইহুদি ঔপন্যাসিক হাওয়ার্ড জ্যাকবসন তার এক মন্তব্যে বলেন, তিনি অনেক অদৃশ্য শত্রুর ছায়ায় বসবাস করছেন এমন পরিস্থিতি টের পাচ্ছেন। তারপরও তিনি মনে করেন, এখনো ব্রিটেন ইহুদিদের বাস করার জন্যে এক চমৎকার দেশ।