জিন্নাহ তার কবর থেকে হাসবেন
গান্ধী ও জিন্নাহ - ছবি : সংগৃহীত
ভারতের মধ্যে অনেকে এবং বাইরে আরো বেশি লোক এখন দেশটিকে ‘হিন্দু পাকিস্তান’ হিসেবে অভিহিত করতে চায়। তবে এই বর্ণনা ইতোমধ্যেই খুব বেশি ব্যবহার হয়ে গেছে। কিন্তু তবুও আমি এখন প্রথমবারের মতো স্বীকার করছি : ভারত এখন আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেকে পাকিস্তানের ভাবমূর্তিতে নিক্ষেপ করেছ।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার নতুন যে নাগরিকত্ব বিলটি পার্লামেন্টে পেশ করেছে এবং তা পাসও হয়েছে, সেটি ভারতের জাতিত্বের সামগ্রিক ঘোষণাকেই নাকচ করে দিযেছে। এটি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মুসলিম ও হিন্দুদের জন্য আলাদা দেশ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা-সংবলিত দ্বিজাতি তত্ত্বকেই বৈধতা দিচ্ছে। এই আইনের ফলে তিনটি ইসলামি দেশ- পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে ‘নির্যাতিত’ ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ভারতে ছয় বছর বসবাস সাপেক্ষে দ্রুততার সাথে নাগরিকত্ব পেয়ে যাবে। তবে এতে একটি শর্ত আছে। তা হলো, এসব অভিবাসীকে অবশ্যই অমুসলিম হতে হবে। নতুন বিধান অনুযায়ী, যদি এই তিন দেশের কোনো হিন্দু, পার্সি, খ্রিস্টান, শিখ বা বৌদ্ধ বৈধ নথিপত্র ছাড়া ভারতে প্রবেশ করে, তবে তাদেরকে আর জেলে ঢোকানো হবে না বা বহিষ্কার করা হবে না, তারা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবে। এর সমান্তরালে ভারতীয় জনতা পার্টি তথা বিজেপি দেশজুড়ে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) আয়োজন করতে চাচ্ছে। এর মাধ্যমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ভাষ্যে ‘অনুপ্রবেশকারীদের বহিষ্কার’ করা হবে। এর মানে হলো, ভারতের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো নাগরিকত্বের সাথে ধর্মের যোগ হলো।
এটি ভারতীয় সংবিধানের পরিপন্থী। কারণ সংবিধানে ধর্ম-নির্বিশেষে সবার জন্য সমান সুযোগের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এর ফলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার পার্থক্যের অবসান ঘটবে। এত দিন বলা হতো যে পাকিস্তান হলো ধর্মতাত্ত্বিক রাষ্ট্র, আর ভারত হলো বহুত্ববাদ ও বৈচিত্র্যের গর্বিত শিকড়ে থাকা একটি সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র। এখন আর এই দাবি করা যাবে না। অথচ আধুনিক ভারতের স্থপতিরা ধর্মকে জাতিত্বের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেননি। প্রধানমন্ত্রী সংকল্প ব্যক্ত করেছেন যে ভারত ভাগের সময়কার কিছু কিছু অন্যায়ের প্রতিকার করা হচ্ছে এই বিলের মাধ্যমে। তিনি দেশ ভাগের সময় বাধ্যতামূলকভাবে বিচ্ছেদের শিকার হওয়া ‘মা ভারতের সন্তানদের’ দেশে ফিরিয়ে আনার কথা বলেছেন। তবে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের মুসলিমেরা ভারতের সন্তান বিবেচিত হবে না? এর মাধ্যমে আসলে বলা হচ্ছে যে ভারত হলো অমুসলিমদের সহজাত আবাসভূমি। এর মাধ্যমে কি সরকার জাতিত্বের পাকিস্তানি ধারণাই জোরদার করছে না? আর এটি ভারতের ২০ কোটি মুসলিমকে কী বার্তা দিচ্ছে?
ভারত ভাগের সময় যে কোটি কোটি পরিবার উচ্ছেদের শিকার হয়েছিল, আমার বাবার পরিবার তার একটি ছিল। তিনি মাথা গোজার ঠাঁই ছাড়াই ভারতে চলে এসেছিলেন। দিল্লির উপকণ্ঠে উদ্বাস্তু হিসেবে বেড়ে ওঠার সময় আরো অনেকের মতো আমিও ভারত ভাগের নৃশংস কাহিনী বলতাম। ওই ক্ষত উপশম না করে এখন তা আরো বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে।
আমার প্রশ্ন হলো, ভারতীয়দেরকে এখন অবশ্যই নিজেদেরকে জিজ্ঞাসা করতে হবে : পাকিস্তান থেকে নিজেদের আলাদা করতে আমরা গর্বভরে যেসব কথা বলতাম, তার সবই কি এই বিলের মাধ্যমে শেষ হয়ে যাচ্ছে?
এই বিলের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে যা করতে চাওয়া হচ্ছে তা হলো, মুসলিম দেশগুলোতে নির্যাতিত মুসলিমদেরকে ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করার দরকার নেই। তারা যদি কেউ প্রবেশ করেও থাকে তবে সিএবি ও এনআরসির মাধ্যমে হয় ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হবে বা বহিষ্কার করা হবে। তবে অন্যান্য ধর্মের নির্যাতিতরা এখানে থাকতে পারবে।
তবে অপেক্ষাকৃত দুর্ভাগা মুসলিমরা বিপদে পড়বে। তারা যে ভারতীয় তা তাদেরকে প্রমাণ করতে হবে। দশকের পর দশক এই দেশে বসবাসের পরও তাদেরকে সবকিছু হারাতে হবে।
তবে আদালতের রায়ে আসামে করা এনআরসি প্রকল্পটি বিজেপির রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণ করেনি। ১৯ লাখ লোক এতে বাদ পড়েছে, তাদেরকে এখন আপিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এদের মধ্যে অনেকে হিন্দুও আছে। অনেকে বিশ্বাস করেন, নাগরিকত্ব বিল পাসের ফলে হিন্দুদের নির্যাতিত হিসেবে অভিহিত করে বসবাসের অনুমতি দেয়া হবে, আর মুসলিমদের নিঃসঙ্গ করে ফেলা হবে।
অবশ্য সরকার যেভাবে চাচ্ছে, সেভাবেই সব করতে পারবে তা মনে হয় না। ইতোমধ্যেই ভারতের উত্তর-পূর্ব এলাকার আদিবাসী মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। তাদের আশঙ্কা বাংলাদেশ থেকৈ হিন্দু ও বৌদ্ধরা এসে তাদের এলাকা ভেসে যাবে। তাছাড়া কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন বাতিলের সময়কার এক দেশ এক আইন বলে যে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, সেটিও এসব এলাকার আদিবাসীদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। এর ফলে মনে হচ্ছে, সরকার সবকিছু বুঝে এ কাজে হাত দেয়নি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জোর দিয়ে বলছেন যে নতুন আইনে ভারতীয় মুসলিমদের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। কিন্তু নির্যাতনের শিকার মিয়ানমারের রোহিঙ্গা বা পাকিস্তানের শিয়া, বালুচ ও আহমদিয়াদের বাদ রাখাই বলে দিচ্ছে তার বক্তব্য ঠিক নয়। আর আমরা যদি আমাদের একীভূতকরণ ইতিহাস সমুন্নত করতে চাই, উদার প্রতিবেশী হিসেবে জাহির করতে চাই, তবে কেন এই বিলটি কেবল তিনটি মুসলিম দেশের বেলায় প্রযোজ্য করা হলো? কেন তা শ্রীলঙ্কার তামিল হিন্দুদের প্রতি প্রযোজ্য করা হলো না? তামিল নাড়ুর ক্যাম্পগুলোতে ৬০ হাজার রাষ্ট্রহীন শ্রীলঙ্কান তামিল কষ্টকর অবস্থায় রয়েছে।
বিলটি পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে পাস হলে ভারতের স্বাধীনতা যোদ্ধাদের সাংবিধানিক দর্শন রক্ষা করার দায়িত্ব বর্তাবে সুপ্রিম কোর্টের ওপর। সেখানে তা না আটকালে আমাদের স্বীকার করে নিতেই হবে যে আমরা জাতি হিসেবে মৌলিকভাবে বদলে গেছি।
আর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার কবর থেকে হাসবেন।
ওয়াশিংটন পোস্ট