সাগরে ডুবল অগ্নি ৩, কী করবে ভারত?
অগ্নি ৩ - ছবি : সংগৃহীত
ভারত ১ ডিসেম্বর উডিশ্যা রাজ্যের উপকূলে তার প্রথম রাত্রিকালীন অগ্নি ৩ ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে। প্রডাকশন সেট থেকে দৈব চয়নের মাধ্যমে সংগ্রহ করা একটি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করা হয়। অবশ্য বলা হচ্ছে, ব্যর্থতার মাধ্যমে পরীক্ষাটি শেষ হয়েছে। স্টেজ সেপারেশনের সময় ক্ষেপণাস্ত্রটি সাগরে পতিত হয়েছে বলে জানা গেছে।
মধ্যবর্তী পাল্লার ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইআরবিএম) ২০১১ সালে বাহিনীতে যুক্ত করা হয়। এটি ভারতের পরমাণু শক্তি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অত্যন্ত উচ্চ পর্যায় থেকে পাওয়া এই খবরটি যদি সত্য হয় তবে তা ভারতের স্ট্র্যাটেজিক ফোর্সেস কমান্ডের জন্যই কেবল চরম উদ্বেগের বিষয় নয়, সেইসাথে ভারতের বিশ্বাসযোগ্য ভীতি সৃষ্টিকর সামর্থ্য অর্জন নিয়েও মিশ্র বার্তা দেবে।
উচ্চ মাত্রায় গতিশীলতা ও টেকসই ক্ষেপণাস্ত্র হিসেবে দুই স্তরের প্রপেল্যান্ড ক্ষেপণাস্ত্র অগ্নি ৩-এর উদ্ভাবন শুরু হয় ২০০১ সালে। ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গ্যানাইজেশন (ডিআরডিও) উদ্ভাবিত এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার কিলোমিটার। এতে দুই টন বোমা নিয়ে চীনেও আঘাত হানতে পারে বলে বলা হচ্ছে।
ভারতের সরকারি পরমাণু মতবাদে বলা হচ্ছে, ভারত ন্যূনতম ভীতি সৃষ্টি করবে এবং প্রথমে ব্যবহার করবে না, তবে পরমাণু প্রথম আঘাতের জবাবে প্রবলভাবে বদলা নেবে। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টির ওপর জোর দেয়া হয়েছে তা হলো বিশ্বাসযোগ্যতা। অর্থাৎ ভারত পরমাণু হামলার জবাব দেবে বলে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। এ ধরনের বিশ্বাসযোগ্যতা অনেকাংশে নির্ভর করতে দেশের সামর্থ্য ও প্রতিশোধমূলক হামলার শক্তি প্রদর্শন করার ওপর। ভারতের মতো দেশের জন্য (যে দেশ প্রথমে ব্যবহার না করার মতবাদ লালন করে) তার অস্ত্র ভাণ্ডারকে অবশ্যই কার্যকর রাখতে হবে, শত্রুর বিরুদ্ধে তা বিশ্বাসযোগ্য মাত্রায় নিতে হবে।
অগ্নি ৩-এর রাত্রিকালীন পরীক্ষা ব্যর্থ হওয়ায় ভারতের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। অগ্নি কেবল ভারতের অস্ত্র ভাণ্ডারে থাকা মধ্যবর্তী পাল্লার প্রধান ক্ষেপণাস্ত্রই নয়, এর আরেকটি সংস্করণ (কে-৪ সাবমেরিন লঞ্চড ব্যালাস্টিক মিসাইল নামে) অরিহন্ত পরমাণু সাবমেরিনে মোতায়েন করা হয়েছে। ফলে এই ক্ষেপণাস্ত্রের ওপর নির্ভরশীলতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ব্যর্থতা পাকিস্তান ও চীনের কাছে সম্ভবত এই বার্তা পাঠাবে যে ভারতের অস্ত্র ভাণ্ডার বিশ্বাসযোগ্য নয়। এতে করে তারা ভারতের প্রতিশোধমূলক হামলার ভয় কাটিয়ে সঙ্কট সৃষ্টিতে উৎসাহিত হতে পারে। এমনকি ভারতের প্রতিশোধের ভয় না থাকলে তারা প্রচলিত অস্ত্র দিয়েই পরিকল্পিতভাবে সঙ্কট ত্বরান্বিত করতে পারে বা পরমাণু হামলা প্রথমে চালাতে উৎসাহিত হতে পারে।
যুক্তি হিসেবে কেউ হয়তো বলতে পারেন যে একটি পরীক্ষা ব্যর্থ হওয়া মানে এ কথা নয় যে ভারতের পরমাণু সামর্থ্য হ্রাস পেয়েছে। এই যুক্তি অবশ্যই ফেলে দেয়ার মতো নয়। তবে একটি ছোট ব্যর্থতাও শত্রুকে এই বার্তা দিতে পারে যে ভারতের অস্ত্র ভাণ্ডার তেমন নির্ভরযোগ্য নয়। অধিকন্তু এটি ডিআরডিওর বিজ্ঞানীদের অবশ্যই উদ্বিগ্ন করে তুলবে। কারণ তারা হয়তো মনে করে নিয়েছে সফটওয়্যার প্যাকেজ বা নক্সায় ত্রুটির কারণে এমনটি ঘটে থাকতে পারে। অথচ এগুলো হলো জাতীয় নিরাপত্তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।
ডিআরডিও ও ভারতীয় নিরাপত্তা এস্টাবলিশমেন্টের সামনে আশু যে উদ্বেগ রয়েছে তা হলো ব্যর্থতার কারণ পূর্ণাঙ্গভাবে খতিয়ে দেখায়। দীর্ঘ মেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যাপক পরীক্ষার ক্ষেত্রেও বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণ একটি ব্যয়বহুল প্রকল্প। এতে অনেক সময়ও দরকার হয়। কিন্তু তবুও এটি প্রয়োজনীয়। কিন্তু তাড়াহুড়া করতে গিয়ে যদি কারিগরি বিষয়গুলো মীমাংসা না হয়, তবে তা আসল উদ্দেশ্যই হাসিল করবে না।
ভারতের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনাকারীদেরকে নতুন অস্ত্রের কারিগরি নির্ভরতার বিষয়টি সতর্কভাবে বিবেচনা করতে হবে, অগ্নি ৫-এর দীর্ঘ দিন সেলফ-লাইফে থাকার বিষয়টিও তাদের মনে রাখতে হবে।
ভারতের পরমাণু অস্ত্রের প্রথমে ব্যবহার না করার নীতিটি বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপনের জন্য তার পরমাণু অস্ত্র ভাণ্ডারকে কার্যকর, নির্ভরযোগ্য ও শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে। তবে এজন্য নেতৃবৃন্দ ও উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বক্তব্য রাখার সময়ও বিশ্বাসযোগ্যতা থাকতে হবে। চলতি বছরের প্রথম দিকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বা তার আগে আরো অনেকে যে ধরনের বক্তব্য দিয়ে ভারতের প্রথমে ব্যবহার না করার নীতি সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টি করেছেন, তা পরিষ্কার না করে ভারতের পরমাণু অবস্থান সম্পর্কে কথা বলা উচিত নয়। ভারতের কেন প্রথমে ব্যবহার করার নীতি থেকে সরে যাওয়া উচিত নয়, সে সম্পর্কে অনেকবার বলা হয়েছে।
সর্বশেষ অগ্নি ৩ পরীক্ষাও আরেকটি কারণ হিসেবে সামনে এসেছে, যার ফলে ভারতের কোনোভাবেই প্রথমে ব্যবহার না করার নীতি পরিত্যাগ করা উচিত হবে না। পরমাণু অস্ত্র প্রথমে ব্যবহার করার হুমকি দেয়া হলে সেজন্য অস্ত্রব্যবস্থায় আরো বেশি প্রস্তুতি এবং কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামোতে উন্নতি প্রয়োজন। দ্রুততার সাথে মোতায়েন করা এসব ব্যবস্থা প্রয়োজনের সময় যথাযথভাবে কাজ নাও করতে পারে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় তা ভালোভাবেই দেখা গেছে। এ কারণেই প্রথমে ব্যবহার না করার নীতিটি ভারতের জন্য অনেক কল্যাণকর। কারণ এতে ব্যর্থতার মারাত্মক শঙ্কায় থাকা জটিল ব্যবস্থাটি রক্ষণাবেক্ষণে স্বস্তি পাওয়া যায়।
দি ডিপ্লোম্যাট