নাগরিকত্ব ইস্যুর নেপথ্যে
নাগরিকত্ব ইস্যুর নেপথ্যে - ছবি : সংগ্রহ
এবার নাগরিকত্ব বিল। মানে ভারতের নাগরিকত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে আনা এক সংশোধনী বিল। এর সোজা অর্থ হলো আসামে এখন এবং ভবিষ্যতে অন্য রাজ্যে এনআরসি তালিকা করার পর মুসলমান যারা বাদ পড়বেন, তারা বাদে বাদ পড়া অন্য সব ধর্মের সবাইকে যেন আবার ভারতের নাগরিকত্ব সহজেই দেয়া যায়; এরই এক খোলাখুলি নাগরিক বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা হবে এটা। এই লক্ষ্যে মোদি সরকার আগামী সপ্তাহে ভারতের নাগরিকত্ব আইনের ওপর একটা সংশোধনী বিল আনতে যাচ্ছে, যা ইতোমধ্যেই মোদির মন্ত্রিসভা অনুমোদন দিয়েছে।
বিজেপি-আরএসএসের একেবারে ওপরের নেতারা জানেন, মুসলমানবিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানো এটাই তাদের রাজনীতি। কেন? মুসলমানরা খারাপ আর হিন্দুরা ভালো- না, ঠিক এটা প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠা করা তাদের কাজ বা রাজনীতি নয়। তাদের মূল কাজ হলো পোলারাইজেশন, মানে ভোটার মেরুকরণ। অন্য ভাষায় কাজটা হলো হিন্দুদের আলাদা করা, হিন্দুরা আলাদা, ভালো আর সব কিছু তাদেরই- এটা সব সময় প্রমাণ করে চলা ও এই দাবি তাতিয়ে রাখা। কেন? কারণ এমনটা শুধু প্রমাণ করে রাখা তাদের কাজ নয়। বরং কাজের লক্ষ্য হলো, হিন্দু হিসেবে তারা যেন এরপর দলবেঁধে বিজেপির প্রার্থীকেই ভোট দেয়। মানে বিজেপির বাক্সে সব হিন্দুর ভোট যেন ঢোকে।
এই শেষ বাক্যটাই হলো আসল লক্ষ্য। অর্থাৎ মুসলমানরা খারাপ আর হিন্দুমাত্রই ভালো, এটা প্রমাণ প্রতিষ্ঠার আধা সত্য বা মিথ্যা প্রচার করা হলো। ধর্মীয় পোলারাইজেশন বা হিন্দু মেরুকরণ ঠিকঠাক করা হলো। কিন্তু কোনো কারণে বিজেপির প্রার্থীর বাক্সে সব হিন্দুর ভোট ঢুকল না। তাহলে কিন্তু এটা আর বিজেপি-আরএসএসের রাজনীতি হবে না। বিজেপির প্রার্থীর বাক্সে সব হিন্দুর ভোট এই হিন্দুত্বের জোয়ার তুলে ফেলা- এটাই বিজেপির উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের রাজনীতির চর্চা করার লক্ষ্য।
এদের রাজনীতির বুঝ মূলত তিনটি শব্দের- স্বাধীনতা ও দেশপ্রেম বলে এ দুই শব্দের অর্থহীন কিছু আবেগি সুড়সুড়ি তুলে ফেলা আর তৃতীয়টি হলো জাতীয়তাবাদ : মানে উগ্র-হিন্দু জাতীয়তাবাদ। অর্থাৎ রাষ্ট্র, অধিকার, নাগরিক, রিপাবলিক, কনস্টিটিউশন ইত্যাদি এসবই এদের জন্য একেবারে অপ্রয়োজনীয় সব শব্দ ও ধারণা। রাষ্ট্র বলে কোনো ধারণা এদের কাছে অপ্রয়োজনীয় থাকে, তাই এর কোনো নীতিগত দিক যেমন নাগরিকের কিছু মৌলিক অধিকার থাকবে; যা রক্ষা করতে, সুরক্ষা দিতে রাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে- এটা বিজেপির রাজনীতিতে কোনো বিষয় নয়। অথবা ধরা যাক, রাষ্ট্র নাগরিকদের মধ্যে কোনো অধিকারবৈষম্য করতে পারবে না, আইনের চোখে সবাইকে সমান দেখবে ও আচরণ করবে ইত্যাদি বিষয়গুলো, রাষ্ট্রের এমন পালনীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রাখার ব্যাপারটিও বিজেপি-আরএসএসের রাজনীতিতে কোনো ব্যাপারই নয়। কেবল কেউ বিজেপি কি না, হিন্দুত্বের কি না সেটার দিকে চোখ রেখে চলে বিজেপির বাক্স ভরানোই এই রাজনীতিতে যথেষ্ট।
কিন্তু তাই বলে বিজেপি-আরএসএস বা তাদের কর্মীরা কি কেবল এক হিন্দুত্বের আবেগের মধ্যেই তীব্রভাবে ডুবে থাকে- যেন কেবল এক হিন্দুত্বের ভাবাবেগের সুড়সুড়িই তাদের সব কিছু, ডুবে বুঁদ হয়ে থাকা? না, সম্ভবত তা একেবারেই নয়। যেমন এবার ভারতে পেঁয়াজ-উৎপাদক অঞ্চল বা রাজ্যে বন্যায় তা নষ্ট হওয়াকে কাজে লাগিয়ে পেঁয়াজ সঙ্কট হয়েছে। বাংলাদেশের মতো ভারতেও পেঁয়াজের সঙ্কট চলছে। কিন্তু তুরস্ক ভালো সহনশীল দামে ভারতকে পেঁয়াজ দিতে রাজি হওয়ায় সেই তুরস্ক ভারতের কাশ্মির নীতির কঠোর সমালোচনা করে ধুয়ে দিলেও এ ব্যাপারে মোদির ভারত সরকার চুপচাপ। যেমন ভারতের অনলাইন ‘দ্য প্রিন্ট’ পত্রিকায় একটা খবরের শিরোনাম হলো, ‘মোদি সরকার তুরস্কের কাশ্মির সমালোচনা শুনেও চোখ বুজেছে; কারণ ভারতের এখন তুরস্কের পেঁয়াজ দরকার।’ আবার প্রায় একই রকমভাবে মালয়েশিয়ার মাহাথির গত সেপ্টেম্বরে জাতিসঙ্ঘ অধিবেশনে ভারতকে কাশ্মিরে ‘দখলদার বাহিনী’ বলে অভিযুক্ত করেছেন। তাতে ভারত প্রথমে ছদ্মরাগ দেখিয়েছিল যে, তারা আর মালয়েশিয়ার পামঅয়েল কিনবে না। কিন্তু দামে সস্তা পাওয়ায় ভারত এখন আগের মতোই মালয়েশিয়ার পামঅয়েল কিনতে শুরু করেছে। তাহলে অর্থ দাঁড়াল, উগ্র হিন্দুত্বের তথাকথিত আবেগ নয়, এমনকি মুসলমানবিদ্বেষ বা ঘৃণা ছড়িয়েও নয়; সুখ এখনো তাদের কাছে বিষয়-আশয়ের বস্তুসুখের মধ্যেই, সেখানে হুঁশ জাগ্রত রেখে খাড়া বৈষয়িক লাভালাভেই তাদের সুখ।
কাজেই ভুয়া হলেও বিজেপি-আরএসএসের রাজনীতি হলো এক বাছবিচার হুঁশহীন এক উগ্র হিন্দুত্বই। কিন্তু সম্প্রতি তাদের পরপর দু’টি বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। একটি হলো মোদি সরকারের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির মাপ জিডিপিতে ধস নেমেছে। আসলে বলতে হবে, এবারের ধস আর লুকিয়ে রাখা যায়নি। দুই বছর ধরে যেটা আড়াই শতাংশ করে বাড়িয়ে শুরুতে ৮ শতাংশ বলে আসছিল, সেই বাড়ানো ফিগারটাও এখন কমতে কমতে এবার ৪.৫ শতাংশ হয়ে গেছে। এতে সমাজের সব কোনায় হাহাকার তুলে ফেলেছে। কাজেই এটা ঢাকা দিতে এখন আবার কোনো এক জবরদস্ত মুসলমানবিদ্বেষ-ঘৃণার ইস্যু দরকার। এ ছাড়া তাদের আরেক পরাজয় ঘটেছে আসামের এনআরসি ইস্যুতে। তারা হিন্দুমনকে খুব তাতিয়েছিল যে, লাখ লাখ মুসলমান অপ্রমাণিত-নাগরিক তারা শেষে তালিকায় দেখতে পাবে। কিন্তু হিন্দুদেরই হাহাকার উঠেছে কারণ নাগরিক-প্রমাণে ব্যর্থ হওয়া মোট ১৯ লাখের ৭৫ শতাংশ হলো হিন্দু। এখন উঠতে-বসতে বিজেপিকে বদ দোয়া দেয়া আসামের এই হিন্দুদেরকে সামলানোই কঠিন হয়ে গেছে বিজেপির।
তাই বিজেপি এখন অছিলা খুঁজছে দু’টি- ১. তৈরি হওয়া আসামের এনআরসি তালিকাই বাতিল বলে ঘোষণা করে দিতে আর ২. ভারতের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন।
বিজেপির মূল লক্ষ্য আসলে ‘বিদেশী’ বলে বা ‘মুসলমান’ বলে একটা কল্পিত স্থায়ী শত্রু খাড়া করে ফেলা; যারা সব সময় নাকি ভারতের ‘হিন্দুস্বার্থের বিরোধিতা’ করছে- এভাবে এই গল্প ও ইমেজের একটা স্থায়ী শত্রুরূপ দান করা। বিজেপির ইচ্ছা কল্পিত এমন শত্রুর বিরুদ্ধেই সারাজীবন লড়াই করা। যেন সে এই চেক ভেঙে ভেঙে সব সময় খেয়ে চলতে পারে, পোলারাইজেশন ও ভোটের বাক্স ভরার রাজনীতি করে যেতে পারে। সে কাজে এমন স্থায়ী ইস্যু হতে পারে যেমন ‘ভারত জুড়ে এনআরসি করতে হবে’, বিদেশী খোঁজো- এই স্লোগান। তবে আসলে এটা আর অনুমান হিসেবে নেই, গৃহীত সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। ‘ভারত জুড়ে এনআরসি করতে হবে’, বিদেশী খোঁজো- এই বয়ানেই একমাত্র বিজেপি রাজনীতি করবে ও করতে হবে, এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে মোদি-অমিতের দানবগোষ্ঠী।
অর্থনীতিতে ডুবে গিয়ে এরা এখন এমন অবস্থায় যে ‘ভারত জুড়ে এনআরসি’ আর, বিদেশী খুঁজতে হবে- এটাই তাদের একমাত্র বাঁচার সম্ভাবনার রাজনীতি হয়ে গেছে।
যেমন এখন ঝাড়খণ্ড রাজ্যের নির্বাচন চলছে, সেখানে অমিত শাহ নির্বাচনী জনসভা বক্তৃতা করেছে- ‘ভারত জুড়ে এনআরসি করতে হবে’, এই লাইন নিয়ে। আর প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং- ‘আপনার পাশের লোকটা বিদেশী নয়তো, চেক করেছেন কী’- এমন বিদেশী-ফোবিয়া ছড়ানোর উদ্যোগ-রাস্তা ধরেছে। এটাকে এক মানসিক অসুস্থতা বললেও খুব কমই বলা হবে।
কিন্তু এর আগে ইতোমধ্যে আসামে যে ড্যামেজ ঘটে গেছে, তা হলো মোট ১৯ লাখ বাদ পড়াদের মধ্যে ১৪ লাখই হিন্দু। আসামের সমাজ থেকে এরা বাদ হয়ে যাবে। তাই, এদেরকে বাঁচাতে এক ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে আগামী সপ্তাহে আনা হচ্ছে, ১৯৫৫ সালের পুরনো নাগরিকত্ব বিলের এক সংশোধনী। এটাই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৯। যাতে তাদেরকে আবার নতুন করে নাগরিকত্ব দেয়া যায়। সেই উদ্দেশ্যে এই বিলে বলা হবে, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ বা পাকিস্তান থেকে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি ও খ্রিষ্টানরা (কিন্তু মুসলমানরা বাদ) অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করে থাকলেও তারা ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে বিবেচিত হবে না; বরং উল্টো যেমন বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ হিন্দু অভিবাসী এবং বৈধভাবে আসা অভিবাসী (কিন্তু যাদের ভিসার মেয়াদ পেরিয়ে গেছে), তারা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন।
আসলে আগের ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুসারে কোনো অবৈধ অভিবাসী (ভিসা ছাড়াই ঢুকে পড়া বা ভিসার মেয়াদ শেষেও থাকা) বিদেশী ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারে না। সোজা কথায় মোদি নতুন আইনে এই বাধা তুলে দিতে চাইছে; কিন্তু মূলত মুসলমান ছাড়া বাকি সব ধর্মের মানুষের জন্য সুযোগ রেখে দিয়ে- এভাবে আনা হবে এই সংশোধনী। এটাই এর প্রত্যক্ষ মুসলমানবিদ্বেষ এবং মুসলমানবৈষম্য।
এমন এই বিদ্বেষ ও বৈষম্য এটাই হবে বিজেপি-আরএসএসের রাজনৈতিক পুঁজি। স্থায়ী ঘৃণাবিদ্বেষ তৈরি ও ছড়ানোর উৎস; যাতে এটা কেনাবেচা থেকেই স্থায়ীভাবেই পোলারাইজেশনে বিজেপি প্রার্থীর বাক্স ভরার রাজনীতি করে যাওয়া যায়। এক দিকে ‘ভারত জুড়ে এনআরসি করতে হবে’, বিদেশী খোঁজো- এর রাজনীতি চালিয়ে অস্থির ঘৃণাবিদ্বেষ উত্তেজনা তাতিয়ে রাজনীতিতে টিকে থাকা, মুসলমান তাড়িয়ে খাঁটি হিন্দুদের ভারত কায়েম করা- এ এক বিরাট মাইলেজের স্থায়ী ইস্যুর রাজনীতি বিজেপি-আরএসএস নিজের জন্য তৈরি করতে চাইছে। আর এ কাজ করতে গিয়ে কোনো হিন্দু এতে ফেঁসে নাগরিকত্ব খোয়ালে তাকে আবার নাগরিকত্ব দিয়ে আগের মতোই ভারতে রেখে দেয়া যাবে। এই সুবিধা তৈরি করতে চাইছে বিজেপি। অর্থাৎ বিজেপি-আরএসএস-কে তাদের ঘৃণ্য-রাজনীতির ইস্যু সরবরাহের নিয়মিত খোরাক হয়ে থাকতে হবে, আর স্থায়ীভাবে নাগরিকবৈষম্যের শিকার হতে থাকতে হবে ভারতের মুসলমান নাগরিকদের।
কিন্তু বিজেপি-আরএসএসের এই মুসলমান ‘বলি’ দিয়ে দেয়ার রাজনীতিÑ তা আবার ‘ভারত জুড়ে এনআরসি’ বা বিদেশী খোঁজো যে নামেই আসুক তা কি টিকেই যাবে? বিজেপি-আরএসএস এরাই কি একমাত্র সত্য হয়ে যাবে? আগাম কোনো কিছু শতভাগ নিশ্চিত করে বলা যাবে না। কিন্তু ইতোমধ্যেই যেসব অভিযোগ দেখা যাচ্ছে তা নিয়ে কিছু কথা এখানে বলা যায়।
এনআরসি নামে মোদি-অমিতের দানব শয়তানি শুরু ও শেষ হলে পরিণতি কী হয় তা মুসলমান-অমুসলমান নির্বিশেষে আসামের সবার তা দেখার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ইতোমধ্যেই নেয়া হয়ে গেছে। অহমীয়া বা বিজেপি যতই এটা ‘বিদেশী’ বা মুসলমানরাই কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে খুশিতে থেকেছিল বটে, কিন্তু সবশেষে এটা তাদের নিজের জন্যই খানাখন্দ খুঁড়ে রাখার মতো কাজ হয়েছে। এখন হাহাকার উঠেছে। শুধু তাই নয়, পড়শি হিসেবে পশ্চিমবঙ্গেও এ বিষয়ে পক্ষ-বিপক্ষের তর্কে ওই বাংলাও এখন বুঝে গেছে যে, নাগরিকত্বের ডকুমেন্ট সার্টিফিকেট আর কার্ড জোগাড়ের জন্য দৌড়াদৌড়ি কী জিনিস। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের যারা ইতোমধ্যে বিজেপিতে যোগ দিয়ে হিন্দুত্বে সুবিধা খাওয়া আর মুসলমানের রাস্তায় গড়াগড়ি যাওয়া ব্যালকনিতে বসে আরামে দেখা যাবে বলে ভেবেছিল, এরা নিজেই ইতোমধ্যে বুঝে গেছে এনআরসি কী জিনিস। এটা যে হিন্দু-মুসলমান বাছবিচার ছাড়াই নির্বিশেষে যে কাউকে চরমতম হয়রানির শিকার বানিয়ে ফেলতে পারে, সেটা এখন আসামের পরিণতি দেখে সবাই বুঝতে পেরেছে।
এনআরসিতে নাগরিক প্রমাণের দায় নাগরিকের, রাষ্ট্রের না। অথচ একটা ডকুমেন্ট ব্যক্তিপর্যায়ে রক্ষা সংরক্ষণ যতটা কঠিন রাষ্ট্রের হেফাজতখানা, সেটা রক্ষা উল্টো ততই সহজ। ব্যক্তি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হতে পারে সবচেয়ে সহজে। তাই স্বাভাবিক ছিল, কেউ নাগরিক নয় তা প্রমাণের দায় থাকা রাষ্ট্রের কাঁধে। ইন্দিরার আমলে এক সময় এটা তাই ছিল।
এ ছাড়া এমনিতেই দুনিয়া এখন গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের- এর প্রধান স্বভাব বৈশিষ্ট্য তাই এমন যে পুঁজি আর শ্রমের (মানুষের) মাইগ্রেশন এখানে হবেই, তারা নিরন্তর ঘুরে বেড়াবে। শুধু মানুষ নয়, পুঁজিও এখানে দেশী-বিদেশী পরিচয় নেবে, ঘটবে। তাই ব্যাপক ইকোনমিক মাইগ্রেশন মানে বৈধ-অবৈধ লেবার মাইগ্রেশন সবচেয়ে কমন ঘটনা হবে এখানে। এর ওপর ভারতবর্ষের দেশভাগ- এটা নিজেই সবচেয়ে স্থায়ী এক রাজনৈতিক মাইগ্রেশনের ফেনোমেনা। যা কখনই একেবারে শেষ হয়নি, হবে না। ফলে এখানে একটা নিচু মাত্রার বা কিছু মাত্রার মাইগ্রেশন সব সময় আছে এবং আশা করি আরো অনেক দিন থাকবেই। একমাত্র বদ মতলব থাকলেই কেবল এটাকে কেউ ইস্যু হিসেবে হাজির করতে চাইবে, আর কেবল মুসলমানবিদ্বেষ হিসেবে এটাকে ব্যবহার করতে চাইতে পারে।
‘মাত্র ছয় মাস। তার মধ্যেই ভগ্নমনোরথ দশা কাটিয়ে নিমেষে চাঙ্গা হয়ে উঠল তৃণমূল। তিনটি বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চমকে দেয়া পুনরুত্থান ঘটালেন নিজের দলের। তৃণমূলের ২১ বছরের ইতিহাসে কোনো দিন জয় মেলেনি যে দুই আসনে, সেই কালিয়াগঞ্জ এবং খড়গপুর সদর আসনও ছিনিয়ে নিলো ঘাসফুল। আর লোকসভা নির্বাচনে করিমপুরে যে ব্যবধানে এগিয়ে ছিল তৃণমূল, এবার জিতল তার চেয়ে অনেকটা বেশিতে।’ এটা এ মাসের শুরুর দিনে আনন্দবাজারের এক রিপোর্ট টুকে এনেছি।
গত মে মাসে মোদির আরো বেশি আসন নিয়ে দ্বিতীয়বার বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসার পর ছয় মাসের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে তিনটি প্রাদেশিক আসনে উপনির্বাচনের ফলাফল এসেছে। তাতে এর তিন আসনই পেয়েছে মমতার দল। অথচ এ তিনটির দু’টিতে মমতার দল গত ২১ বছরে কখনো জিততে পারেনি। এই তিনটি আসনই হয় মুসলমান প্রধান অথবা বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া নয়তো বা আসাম লাগোয়া আসন। আর এসব সত্ত্বেও এগুলোর দু’টি ছিল সিপিএম বা কংগ্রেসের দখলে। আর একটি এমন রাজ্য বা বিধানসভা আসনের উপনির্বাচন, যা গত কেন্দ্র নির্বাচনে প্রথম বিজেপি দখলে যাওয়া আসনের অন্তর্গত। তাই এবারের নির্বাচনের শেষে ফলাফল দেখে সব পক্ষই একবাক্য স্বীকার করেছে, পশ্চিমবঙ্গের ভোটাররা সবাই এনআরসি আতঙ্কে দৌড়াচ্ছে, ভুগছে।
এনআরসি তাদের আক্রমণ করে ফেলেছে। তাই সেই আতঙ্কের একমাত্র ত্রাতা হিসেবে মমতা তাদের আশ্রয় হয়ে ধরা দিয়েছে। তাই মমতার বিজয়। আগে তারা ভেবেছিল বিজেপির উত্থানে মুসলমানের কোণঠাসা হওয়া দেখতে তাদের খারাপ লাগবে না হয়তো। কারণ, ‘মমতা নাকি চাপে থাকা মুসলমানদের রশি আলগা করে মাথায় তুলেছিল।’ আর এখন বেলকনিতে বসে মুসলমান-মজা দেখতে চাওয়ারা বুঝে গেছে, ব্যাপারটা এমন মজা-তামাশার নয়। এনআরসি মানে নিজেই নিজের জন্য হয়রানি ডেকে আনা, পকেটের পয়সা খরচ করে দুঃখ কেনা। তারা প্রত্যেকে ছোট চাকরি বা ব্যবসায় স্বল্প আয়-ইনকামে অস্থির থাকতে হয় এমন জীবন যাপন করেন। সেখানে উটকো নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণের টেনশন? এই হয়রানি ডেকে আনা তাদের জীবনের অর্থ কী! কলকাতায় ইতোমধ্যে রেশন কার্ড বা ডকুমেন্ট ইত্যাদি জোগাড়ের নীরব দৌড়াদৌড়ি কেউ কেউ শুরু করে দিয়েছেন। কাজেই কেউ পারলে তাদের সেই ত্রাতা হতে পারেন মমতাÑ এই মেসেজই তারা হাজির করে ফেলেছেন!
ইতোমধ্যে আর একটা বড় ডেভেলপমেন্ট আছে। গত মে মাসে শেষ হওয়া নির্বাচনে এক ব্যাপক কারচুপি হয়েছে আর তা মূলত ডিজিটাল ব্যালট-কেন্দ্রিক ব্যবস্থার সুযোগে। এটা বিজেপি ছাড়া মূলত সব আঞ্চলিক দলগুলো বিশ্বাস করে। যদিও হাতেনাতে দেয়ার প্রমাণ হাজির করা মুশকিল। এ ধারণা আরো জোরদার এ জন্য যে, নির্বাচন কমিশন বা সুপ্রিম কোর্ট গত নির্বাচনে খোদ মোদি বা বিজেপির বিরুদ্ধে নির্বাচনী আইন লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। যায়নি। পাশ কাটিয়ে চলেছে। সেটাও আবার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল যে যদি তা করতে হয়, তবে আগ্রাসী মোদির নির্বাহী ক্ষমতার সাথে সঙ্ঘাতে যাওয়ার রিস্ক তাদের নিতেই হতো। যদিও কনস্টিটিউশনালি সে ক্ষমতা তাদের দেয়াই আছে। কিন্তু কেউই আসলে সঙ্ঘাতে যেতে চায়নি। এমনকি একজন সক্রিয় আপত্তিকারী কমিশনার এখনো মোদির নির্বাহী ক্ষমতার হয়রানির শাস্তি ভোগ ও মোকাবেলা করে চলেছেন।
তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, ইতোমধ্যে তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে সংসদে ১৯টা বিজেপি-বিরোধী এক পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়েছে। ‘নির্বাচনী সংস্কার, ব্যালট ফেরানোর প্রস্তাবকে সামনে রেখে’ রাজ্যসভায় স্বল্পমেয়াদি আলোচনার জন্য যৌথভাবে নোটিশ দিয়েছেন এ দলগুলোর নেতারা। এমন ইস্যুগুলো আস্তে ধীরে বড় ও সফল হয়ে উঠতে পারে, যা বিজেপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে হাজির হতে পারে। আপাতত আগামী সপ্তাহের উত্তেজনা নাগরিকত্ব আইন সংশোধনী বিল নিয়ে।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com