কেন এই হট্টগোল : আসলে কী হয়েছিল

হাবিবুর রহমান | Dec 06, 2019 05:08 am
কেন এই হট্টগোল : আসলে কী হয়েছিল

কেন এই হট্টগোল : আসলে কী হয়েছিল - ফাইল ছবি

 

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের শুনানিকে কেন্দ্র করে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে প্রধান বিচারপতির এজলাসে ব্যাপক হইচই-হট্টগোলের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস-আমরা ন্যায়বিচার চাই’ সেøাগানে আইনজীবীরা সমস্বরে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। তারা খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের শুনানি চাই বলে সেøাগান দেন। এক আইনজীবী হাতজোড় করে চোখের পানি ফেলে জামিন আবেদনের শুনানির জন্য নিবেদন করেন। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে বেলা সোয়া ১টা পর্যন্ত আপিল বিভাগে অবস্থান করে আইনজীবীরা একসাথে সেøাগান দেন। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনসহ আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতি এ সময় ছিলেন নীরব। আইনজীবীদের সেøাগানের কারণে আপিল বিভাগে এ দিন অন্য কোনো মামলার শুনানি হয়নি। বেলা সোয়া ১টা পর্যন্ত আইনজীবীরা আদালতে অবস্থান করেন। এক পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি ও অন্য বিচারপতিরা এজলাস কক্ষ ত্যাগ করেন। এরপর আইনজীবীরাও আদালত থেকে বেরিয়ে যান।

আদালতে খালেদা জিয়ার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, এ জে মোহাম্মদ আলী, জয়নুল আবেদীন, মাহবুবউদ্দিন খোকন, তৈমূর আলম খন্দকার, বদরুদ্দোজা বাদল, মনির হোসেন, জামিল আখতার এলাহী, আখতারুজ্জামান, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, এ বি এম রফিকুল হক তালুকদার রাজা, গাজী কামরুল ইসলাম সজল, মো: ফারুক হোসেন, সগির হোসেন লিওন, আইয়ুব আলী আশ্রাফী, আনিছুর রহমান খান, সালমা সুলতানা, মাসুদ রানা, গোলাম আক্তার জাকির, মাহবুবুর রহমান দুলালসহ কয়েক শ’ বিএনপি সমর্থক আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। আর দুদকের পক্ষে ছিলেন খুরশীদ আলম খান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
শুনানি : সকালে শুনানির শুরুতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতকে জানান, খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য বিষয়ক রিপোর্ট আসেনি। আমরা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সময় চাই। এ সময় জয়নুল আবেদীন বলেন, খালেদা জিয়া যখন মৃত্যুপথযাত্রী তখন এই মেডিক্যাল বোর্ড হয়েছে। তার শারীরিক অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। তার আগে জামিনের ব্যবস্থা করুন।

এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, আগামী বৃহস্পতিবার রিপোর্ট এলে শুনব। এ সময় বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা হইচই শুরু করেন।
এরপর জয়নুল আবেদীন বলেন, রোববার রাখেন। জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা আদেশ দিয়েছি। এরপর জয়নুল আবেদীন বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেনÑ খালেদা জিয়া রাজার হালে আছে। তাই যদি হয় তা হলে তাকে সশরীরে হাজির করুন। দেখুন তিনি কি অবস্থায় আছেন। এ সময় আইনজীবীরা সমস্বরে শেম শেম বলতে থাকেন। জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেন, কে কী বলেছেন, আমরা তা দেখব না। আমরা কাগজ না দেখে বিচার করব না।

এ পর্যায়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আমি শেষ একটি কথা বলতে চাই। এরপর প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা অর্ডার দিয়ে দিয়েছি। আর কোনো কথা শুনব না।

কথা বলতে না পেরে তিনি আসনে ফিরে গেলে সুপ্রিম কোর্ট বারের সম্পাদক এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন আদালতকে বলেন, হাতজোড় করে বলছি, আগামী রোববার দিন নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিন। প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) শুনব।
এরপর জয়নুল আবেদীন বলেন, আমরা বিনীতভাবে বলছি। আমরা ভীত, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, আগে রিপোর্ট আসুক। ১১ ডিসেম্বর রিপোর্ট আসুক। ১২ ডিসেম্বর শুনব। এ অবস্থায় আপিল বিভাগ মেডিক্যাল রিপোর্ট দাখিলের জন্য ১১ ডিসেম্বর এবং পরবর্তী শুনানির জন্য ১২ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেন।

এ সময় সুপ্রিম কোর্ট বারের সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল যেভাবে পরামর্শ দিচ্ছেন সেভাবে হচ্ছে। খালেদা জিয়াকে মেরে ফেলা হচ্ছে।

শুনানির এই পর্যায়ে বেলা ৯টা ৫৫ মিনিটে আদালতে হট্টগোল শুরু হলে বিচারপতিরা এজলাস কক্ষ ত্যাগ করেন। এ সময় বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা শেম শেম বলতে থাকেন। এক পর্যায়ে সরকার সমর্থক আইনজীবী ও বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। শুরু হয় দুইপক্ষের বাগি¦তণ্ডা। এরপর আইনজীবীরা বলতে থাকেন খালেদা জিয়ার জামিন না নিয়ে আদালত কক্ষ ত্যাগ করব না। এরপর তারা আদালত কক্ষে অবস্থান নেন।
বেলা ১১টা ৩৫ মিনিটে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের কার্যক্রম আবারো শুরু হলে বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা অন্য মামলার শুনানিতে প্রতিবাদ করতে থাকেন। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনাদের তারিখ হয়ে গেছে। আপনারা চলে যান।

আইনজীবী জয়নুল আবেদীন তখন এগিয়ে এসে বলেন, দয়া করে রোববার শুনানির তারিখ রাখুন। একই সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন অন্তত সোমবার শুনানির তারিখ দেয়ার আবেদন করেন।

এরপর প্রধান বিচারপতি বলেন, বাড়াবাড়ির সীমা থাকা দরকার। এ ধরনের নজির আর আমি দেখিনি, যা ঘটছে তা আপিল বিভাগে আর দেখিনি।
এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, আবদুল মতিন খসরু, ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নুর তাপস আদালতে এলে আদালত পরবর্তী মামলার শুনানি শুরু করতে বলেন। তখন আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি একটি মামলার শুনানি করতে চাইলে বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা বলেন, আগে খালেদা জিয়ার মামলা শুনতে হবে। তাকে জামিন দিতে হবে। আইনজীবীরা সমস্বরে বলতে থাকেন উই ওয়ান্ট জাসটিস। এই সেøাগানের মধ্যে আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি শুনানি করতে না পেরে দাঁড়িয়ে থাকেন। আইনজীবীরা সেøাগান দিতে থাকেন। আর বিচারপতিরা চুপ করে বসে থাকেন। এ সময় সরকার সমর্থক আইনজীবীরাও আদালতে জড়ো হন। মাঝে মধ্যে দুই পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে কথাকাটাকাটি হতে থাকে।

খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়া : সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন আদালত থেকে বেরিয়ে আইনজীবী সমিতি অডিটোরিয়ামে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, আজ যে ঘটনা ঘটেছে তার সব দায় অ্যাটর্নি জেনারেলের। তিনি বলেন, কেন খালেদা জিয়ার জামিনের জন্য মেডিক্যাল রিপোর্ট প্রয়োজন হল। ৫ থেতে ৭ বছরের সাজার শত শত মামলায় জামিন হয়ে যাচ্ছে। আর খালেদা জিয়াকে জামিন দেয়া হচ্ছে না। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তাকে জেলে রাখা হয়েছে। তার প্রমাণ আজকের ঘটনা। এই মামলায় জামিন শুনানিতে মেডিক্যাল রিপোর্ট কল করা হয়েছে। আমি হলে এটা মেনে নিতাম না। সাত বছরের সাজা মামলায় সর্বোচ্চ আদালত জামিন দেবেন না, এর চেয়ে ন্যক্কারজনক কিছু হতে পারে না। তিনি বলেন, আজকের এই ঘটনার জন্য দায় অ্যাটর্নি জেনারেলের। সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে আজ একটি কলঙ্কজনক অধ্যয়। সুপ্রিম কোর্ট হলো ন্যায়বিচারের শেষ আশ্রয় স্থল। এটা নষ্ট হলে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে। এটা আমরা চাই না।

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, সরকারের বিভিন্ন ম্যাকানিজমের কারণে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি হয়নি। তার যে মেডিক্যাল রিপোর্ট দাখিল করা হয়েছে তার জন্য যেকোনো আদালত তাকে জামিন দেবেন। একটি অজুহাতে সাত দিন জামিন শুনানি পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সরকারের রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে খালেদা জিয়ার মুক্তি বিলম্বিত হচ্ছে। মানবিক ও স্বাস্থ্যগত কারণে তার জামিন চাওয়া হয়েছে। আজ আইনজীবীরা প্রতিবাদ করেছে। আমরা নিবৃত করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমরা পারিনি। আমি পেশার জীবনে এমন দেখিনি। আবারো আমাদের বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

জয়নুল আবেদীন বলেন, রাজনৈতিক মামলা দিয়ে খালেদা জিয়াকে জেলে আটক রাখা হয়েছে। চিকিৎসার অভাবে জেলখানায় তিনি তিলে তিলে মরতে বসেছেন। আমরা সেখানে যেতে পারছি না। তার হাত পা বাঁকা হয়ে যাচ্ছে। তার চিকিৎসা দেশে সম্ভব নয়। তার উন্নত চিকিৎসা দরকার। ডাক্তার তার যে চারটি মেডিসিন দিয়েছেন তার একটি দেশে পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের শেষ আকুতি চিকিৎসার জন্য তাকে জামিন দেয়া হোক। খালেদা জিয়াকে মৃত্যুর হাত থেকে বের করার জন্য আইনজীবীরা সেøাগান দেন, উই ওয়ান্ট জাস্টিস। আশা করি এ থেকে ভবিষ্যতে সরকার সতর্ক হবে।

সরকার সমর্থক আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়া : এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট বার অডিটোরিয়ামে এক ব্রিফিংয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, আপিল বিভাগে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের আচরণ ছিল অভাবনীয়। আদালতে তারা সেøাগান, হট্টগোল এবং বিচার কাজে বাধা সৃষ্টি দিয়ে ফ্যাসিবাদী আচরণ করেছেন। এটা আদালতের ওপর চাপ সৃষ্টির প্রয়াস। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার, খালেদা জিয়ার সিনিয়র আইনজীবীরা কোর্টে ছিলেন, কিন্তু তারা জুনিয়রদের থামানোর কোনো চেষ্টাই করেননি। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার আপিল শুনানির জন্য প্রস্তুত, কিন্তু তারা আপিলের শুনানি না করে জামিন শুনানি নিয়ে ব্যস্ত। তারা রাজনৈতিক দাবি থেকে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করছেন।

বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, জীবনেও ভাবিনি এ ধরনের ঘটনা হবে। এটা আদালত অবমাননা। যারা হট্টগোল করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার আহ্বান জানাচ্ছি। এটা চলতে থাকলে সমুচিত জবাব দেয়া হবে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন বলেছেন, যারা হট্টগোল করেছেন তারা আমাদের সদস্য নয়। তাদের আমরা চিনি না। বাইরে থেকে এসে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হট্টগোল করেছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানাচ্ছি। ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস বলেন, বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা প্রমাণ করেছেন তিনি অসুস্থ নন। তারা জোর করে আদালত থেকে জামিন নিতে চান। যারা আদালতে বিচারকাজে বাধা দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তিনি।

এর আগে গত ২৮ নভেম্বর বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার বিষয়ে জানতে মেডিক্যাল বোর্ডের রিপোর্ট তলব করেন আপিল বিভাগ। ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে এ প্রতিবেদন আপিল বিভাগে দাখিল করতে বলা হয় এবং একই তারিখে জামিন আবেদনের ওপর শুনানির জন্য দিন রাখা হয়।

গত ১৪ নভেম্বর সাতটি গ্রাউন্ডে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় জামিন চেয়ে আপিল আবেদন করা হয়। গত ৩১ জুলাই বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ করে আদেশ দেন।

গত বছরের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। পাশাপাশি ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এ মামলায় খালেদা জিয়াসহ চার আসামিকে সাত বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়। ২০১০ সালের ৮ আগস্ট খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা করে দুদক।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us