পাকিস্তান-ভারত : কী হবে আগামী বছর?
পাকিস্তান-ভারত : কী হবে আগামী বছর? - ছবি : সংগ্রহ
২০২০ সাল বৈশ্বিকভাবে খুবই ঘটনাবহুল বছর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে উত্তেজনাকর ঘটনা কেন্দ্রগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হতে পারে দক্ষিণ এশিয়া। দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রধান দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ২০১৯ সালেই উত্তেজনার পারদ চরমে ওঠে। দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত যুদ্ধে পরিণত হওয়ার আশঙ্কাও দেখা দেয়। এর পরে বলা যায়, গত কয়েক দশকের মধ্যে দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্ক সর্ব নিম্ন পর্যায়ে চলে আসে। দু’দেশের নিজস্ব অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাগত সমস্যার কারণে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ বাধেনি। তবে সেই আশঙ্কার ইতি ঘটে গেছে বলে মনে হয় না।
অর্থনীতিতে নিম্নগতি
পাকিস্তানের অর্থনীতির বিকাশে নিম্নগতি বেশ কয়েক বছর আগে থেকে চলে আসছিল। বিশেষত মার্কিন নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কারণে দেশটিতে এক ধরনের অস্থির অবস্থা সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় একদিকে বিদেশী বিনিয়োগে স্থবিরতা নেমে আসে। অন্যদিকে নিরাপত্তা ব্যয় বেড়ে যায় অস্বাভাবিকভাবে। যে যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশনায় পাকিস্তান আফগানিস্তানের সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে সহযোগিতা করে সেই দেশটি তাদের ইচ্ছামতো ভূমিকা পালন করার জন্য নানামুখী চাপ তৈরি করে। আর পাকিস্তান নিজস্ব নিরাপত্তা ইস্যুগুলোতে এ ব্যাপারেই সাড়া না দিলে তাদের ভূমি ব্যবহারের বিপরীতে যে আর্থিক সহায়তা দান করত তা বন্ধ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। অন্য দিকে, একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত সম্পর্ক নির্মাণে ভারতের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং দেশটির সাথে বৃহত্তর প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর প্রভাব পড়ে পাকিস্তানের অর্থনীতিতে। দেশটির প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের আশপাশে সীমিত হয়ে পড়ে।
এ অবস্থায় পাকিস্তানকে চীনের বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হয়। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর প্রকল্পের আওতায় চীন ব্যাপক বিনিয়োগ করলে প্রাথমিক বছরগুলোতে প্রবৃদ্ধি চাঙ্গা হয়ে ওঠে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ফল আসার মতো অবকাঠামো ধরনের প্রকল্পে ক্ষেত্রবিশেষে অধিক সুদে বিনিয়োগ গ্রহণের চাপ পড়ে অর্থনীতির ওপর। ফলে চীন-সৌদি আরবের দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা গ্রহণের পরও শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানকে আইএমএফের দ্বারস্থ হতে হয়। এ ধরনের এক ক্রান্তিকালে বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন অনুসারে ২০১৯ সালে পাকিস্তানের বিকাশ হার হবে ৩.৩ শতাংশ। যা ২০২০ সালে আরো কিছুটা কমে ২.৪ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ৩ শতাংশে দাঁড়াবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে।
ভারতের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক এক প্রকার ছিন্ন করা এবং আকাশসীমা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রভাব সীমিত হলেও পাকিস্তানের অর্থনীতিতে পড়বে। এর সাথে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় হওয়া সিন্ধু পানি চুক্তি থেকে সরে আসার যে হুমকি ভারত দিচ্ছে তা কার্যকর হলে পাকিস্তানি সেচনির্ভর কৃষিতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। এতে অর্থনীতি চাঙ্গা করার জন্য যেসব পদক্ষেপ প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নিচ্ছেন তা ব্যাহত হতে পারে।
ভারতে দ্বিতীয় মেয়াদে মোদি ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই অর্থনীতিতে শ্লথগতি শুরু হয়। উচ্চমূল্যের মুদ্রা নোট আকস্মিকভাবে বাতিল করার মধ্য দিয়ে এর সূচনা। পরে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার পরও অর্থনীতি সেভাবে চাঙ্গা করা সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় মোদি তার প্রথম মেয়াদে সুদিন ফিরিয়ে আনা ও সবার জন্য কর্মসংস্থানের অঙ্গীকার থেকে দৃষ্টি ফেরাতে হিন্দুত্ব ও পাকিস্তানবিরোধী উগ্র জাতীয়তাবাদী ইস্যুগুলো সামনে নিয়ে আসেন। এতে মোদির দল বিজেপির সামনে নির্বাচনী সাফল্য ধরা দিলেও অর্থনীতির আরো অবনতি হতে থাকে। গো-রক্ষা আন্দোলনে আগে থেকে চামড়া ও মাংস রফতানি খাতে অচলাবস্থা দেখা দেয়। নতুন করে বস্ত্র, অটোমোবাইলসহ প্রধান দশটি উৎপাদন খাতের ৮টিতে প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়ে পড়ে। এর ফলে সর্বশেষ প্রান্তিকে ভারতের জিডিপির প্রবৃদ্ধি নেমে আসে সাড়ে ৪ শতাংশে যা পূর্ববর্তী ছয় বছরের মধ্যে একটি রেকর্ড।
স্বাধীনতার পরে দীর্ঘ সময় ভারতের আর্থিক প্রবৃদ্ধির গড় হার ৩.৫ শতাংশের আশপাশে ঘোরাফেরা করেছিল। তাকে ব্যঙ্গ করে ‘হিন্দু রেট অব গ্রোথ’ তকমা দেন অর্থনীতিবিদ রাজ কৃষ্ণ। মোদি সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরেই জুলাইয়ে সংসদে আর্থিক অবস্থা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়ে নতুন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন পাল্টা বলেছিলেন, ‘কংগ্রেস আমলে অর্থনীতি কেন দ্বিগুণ হয়নি? তখন কেন হিন্দু রেট অব গ্রোথ চাপানো হয়েছিল!’ এবার মোদি জমানাতেই বৃদ্ধির হার ৪.৫ শতাংশে নেমে আসায় প্রশ্ন উঠছে, ‘হিন্দু রেট’-এর ঘরেই কি ভারত ফিরে যাচ্ছে?
জেএনইউ-এর অর্থনীতির অধ্যাপিকা জয়তী ঘোষ প্রশ্ন করেছেন, ভারতে এখন কি প্রবৃদ্ধি আদৌ হচ্ছে? নাকি অর্থনীতির সঙ্কোচন হচ্ছে? বেকারত্বের হার, সংসারের খরচ কমে যাওয়া, গাড়ি থেকে নিত্যপ্রয়োজনের জিনিসপত্রের বিক্রি কমা, একের পর এক সংস্থার ব্যবসায় গুটিয়ে ফেলার মতো অর্থনীতির অন্যান্য মাপকাঠি কিন্তু সেটিই সামনে নিয়ে এসেছে। জয়তী বলেছেন, মোদি জমানায় জিডিপি মাপার পদ্ধতি বদলে দেয়া হয়। সেই পদ্ধতি নিয়েই বিতর্ক রয়েছে। মোদি সরকারের সাবেক মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রাহ্মণ্যই বলেছিলেন, নতুন পদ্ধতিতে জিডিপি মাপায় প্রবৃদ্ধি ২ থেকে ২.৫ শতাংশ বেশি হচ্ছে। তার কথা মানলে আদতে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ২ শতাংশের ঘরে নেমে এসেছে।
বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস অনুসারে এই মন্দাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে ভারতের কম করে হলেও দুই বছর সময় লাগবে। এ সময় আরো প্রলম্বিত হতে পারে উৎপাদনমুখী খাতগুলোর অর্থ প্রতিরক্ষা বাজেটে স্থানান্তরের প্রবণতা অব্যাহত থাকলে।
ভারত ও পাকিস্তানের অর্থনীতির এ দুর্বলতা দেশ দু’টির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য দৃশ্যত কাটা হিসেবে দেখা দিলেও কাশ্মির উত্তেজনায় বড় ধরনের যুদ্ধে জড়ানো থেকে নিবৃত্ত করার ক্ষেত্রে এর একটি ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। ২০২০ সালে দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধ পর্যায়ে সম্পর্ক না যাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে এটি।
কাশ্মির উত্তেজনা কতদূর গড়াবে?
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের বড় অংশজুড়েই ছিল কাশ্মির উত্তেজনা। এই ইস্যুটি এতটাই জটিল এবং এতে দৃষ্টিভঙ্গিগত বৈপরীত্য এতটাই বিস্তৃত যে, এর সমাধান বেশ কঠিন। এটিকে আরো দূরতিক্রম করে তুলেছে মোদি সরকারের কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসন সংবলিত সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫/ক অনুচ্ছেদ বাতিলের উদ্যোগে।
জাতিসঙ্ঘে ভারতের প্রতিনিধি এ সঙ্কটের সমাধানের তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রকাশ্যে। বলেছেন, ইসরাইল যে প্রক্রিয়ায় ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান করছে একই কৌশল অবলম্বন করতে হবে ভারতকে। এর সরল অর্থ হলো, কাশ্মির উপত্যকায় ভারত হিন্দু বসতি স্থাপন করে এর জনমিতি পাল্টে দেয়ার কৌশল নেবে। ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করার আগে থেকে সুব্রামনিয়াম স্বামীর মতো উগ্রবাদী বিজেপি নেতা উপত্যকায় মুসলিম অধিবাসীদের উৎখাত করে হিন্দু বসতি স্থাপনের কথা বলেছিলেন। কাশ্মিরের মর্যাদা খর্ব করার মধ্য দিয়ে দিল্লি মূলত সেই কৌশলের দিকে এগোচ্ছে।
এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য ভারতের প্রধান কৌশল হলো সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে উপত্যকার পরিস্থিতি ঠাণ্ডা রাখা। আর ধীরে ধীরে রেজিমেন্টেড পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে কাশ্মিরের মুসলিম অধিবাসীদের বাধ্য করা। এরপর স্থানীয় সরকার পরিষদ অথবা বিধান সভায় নির্বাচন দিয়ে পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করার দিকে নিয়ে যাওয়া। আর অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে এলে ভারতের প্রতি সহানুভূতিশীল সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশকে দিয়ে পর্যটন খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করে কর্মসংস্থানের কিছু সুযোগ সৃষ্টি করা।
কাশ্মিরের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নজিরবিহীন দুরবস্থায় পতিত হলেও উপত্যকাবাসীর ক্ষোভ ও প্রতিরোধ এখনো নিরাপোস এক অবস্থার মধ্যে রয়ে গেছে। ফলে কাশ্মিরের বাইরের ভারতীয়দের সেখানে যাওয়ার জন্য উৎসাহ দেয়া আর এর মাধ্যমে এই অঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা হ্রাস করা এবং ক্ষমতাসীন দলকে শক্তিশালী করার মোদির পরিকল্পনা ও কৌশল কতটা বাস্তবে কার্যকর হবে সেটি বলা মুশকিল।
কাশ্মির পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করা বা নিয়ন্ত্রণে আনার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের ভূমিকা বা দৃষ্টিভঙ্গি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান শুরু থেকে কাশ্মিরের ব্যাপারে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন। জাতিসঙ্ঘে তার এ ব্যাপারে রাখা ভাষণ একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার মতো। কিন্তু জমিয়ত নেতা মওলানা ফজলুর রহমানকে নিয়ে ইমরান খানের পতনের আন্দোলনের নামে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা হলে অনেকখানি ব্যাকফুটে চলে যান ইমরান। মওলানা ফজলু কতটা ভারত ও তার সহানুভূতিশীল রাষ্ট্রগুলোর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কাশ্মির ইস্যুর জন্য এই আত্মঘাতী কাজ করেছেন তা পরিষ্কার নয়। তবে পরিকল্পনাকারীরা ইমরানকে এই মর্মে একটি বার্তা দিতে চেয়েছে বলে মনে হয় যে, কাশ্মির নিয়ে সামরিক কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলে পাকিস্তানের ভেতরে অস্থিরতা সৃষ্টি করা হবে। সে অস্থিরতা পাকিস্তানের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে বেলুচিস্তান বা খাইবার পাখতুন গোয়া কেন্দ্রিকও হতে পারে। এর মধ্যে বেলুচিস্তানে অন্তর্ঘাতী তৎপরতা বেশ খানিকটা চাঙ্গা হয়েছে।
কাশ্মির ইস্যুটি পাকিস্তানের জন্য দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এক দিকে কাশ্মিরবাসীর অধিকার ও স্বশাসনের ব্যাপারে পাকিস্তান সবসময় যে অঙ্গীকার ব্যক্ত করে এসেছে তা রক্ষা করা। অন্যদিকে, কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন খর্ব করার পর আজাদ কাশ্মির ও বাল্টিস্তান দখলে নেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ প্রকাশ্যেই সংসদে যে বক্তব্য রেখেছেন তার পাল্টা প্রস্তুতি রাখা। এতে পাকিস্তান সরকারকে ইসলামাবাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা কাশ্মিরের নিরাপত্তা জোরদার করার বিষয়েও পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে।
কাশ্মির সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে দুই দেশের সরকারে থাকাকালে অটল বিহারি বাজপেয়ি ও জেনারেল পারভেজ মোশাররফ আলোচনা অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছিলেন। দু’দেশেরই সংবেদনশীল কয়েকটি গ্রুপের বিরোধিতার জন্য সেটি আর বাস্তবায়ন হয়নি। বাজপেয়ি-মোশাররফের এই ফর্মুলা ছিল দু’দেশের মধ্যকার নিয়ন্ত্রণ রেখাকে স্থায়ী সীমান্ত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া। অর্থাৎ আজাদ কাশ্মির ও বাল্টিস্তান পাকিস্তানের অংশ হবে। আর জম্মু-কাশ্মির ও লাদাখের ভারত নিয়ন্ত্রিত অংশ সে দেশের অংশ হয়ে যাবে। চীন লাদাখের যে অংশ নিয়ন্ত্রণ করে সেটি চীনা ভূখণ্ডে যুক্ত হবে। পাকিস্তানের খ্যাতনামা বিশ্লেষক ইকরাম সেহগাল অতি সম্প্রতি এক লেখায় মোশাররফ-বাজপেয়ির এই ফর্মুলার কথা উল্লেখ করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প এবং সাম্প্রতিককালে দিল্লির ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠা এককালীন পাকিস্তান মিত্র সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দু’পক্ষের মধ্যস্থতা করার প্রস্তাবের মধ্যে এ ধরনের একটি ফর্মুলার বিষয় রয়েছে বলে আভাস পাওয়া যায়।
কাশ্মির নিয়ে উত্তেজনার মধ্যেও কাতারপুর করিডোর দিয়ে চুক্তি সমঝোতা দু’দেশের এক ধরনের নমনীয়তার সঙ্কেত বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। তবে কাশ্মির ইস্যুটির সমাধানসূত্র গ্রহণ করার ক্ষেত্রে দু’দেশের রাজনৈতিক সরকারের বাইরে সেনা প্রতিষ্ঠানেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কাশ্মির সঙ্কটের সুরাহায় অগ্রগতি অর্জনের ক্ষেত্রে ২০২০ সাল হতে পারে উল্লেখযোগ্য সাল।
দু’দেশের রাজনৈতিক টানাপড়েন
যেকোনো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি পররাষ্ট্র কৌশল নির্ধারণে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়। আর ভারত ও পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি সব সময় থাকে জটিল। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে রাজনীতিতে সামরিক প্রতিষ্ঠানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে, বিশেষত প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্র কৌশল নিরূপণের ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর মতামত না নিয়ে বড় কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ সরকারের পক্ষে সম্ভব হয় না।
বেনজির ভুট্টো ও আসিফ জারদারির পিপিপি সরকার আর নওয়াজ শরিফের মুসলিম লীগ সরকারের আমলে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে প্রায়ই বিরোধ দেখা দিত। ইমরান খান ক্ষমতায় আসার পর ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও সামরিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য তেমন নেই বলেই মনে হয়। এটি নীতিনির্ধারণে রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করতে পারে। তবে পাকিস্তানের বৃহৎ দু’টি রাজনৈতিক পক্ষ পিপিপি ও নওয়াজ মুসলিম লীগের সাথে মওলানা ফজলুর জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মতো ধর্মভিত্তিক দল এক হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে পরিস্থিতি জটিল হতে পারে। সামরিক বাহিনীর সহায়তা ছাড়া এ ধরনের অবস্থা মোকাবেলা কঠিন।
তবে পাক রাজনীতির সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণে ইমরানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) সরকার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারবে বলে মনে হয়।
ভারতের রাজনীতিতে বিজেপির উত্থানের নেপথ্যে রয়েছে সংঘ পরিবার। আরএসএস ও সংঘ পরিবারের অন্য সদস্যরা অখণ্ড ভারত ও উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের চাষবাস প্রায় শতাব্দীকাল আগে শুরু করেছিলেন। আর তারই ফল হলো পরপর দু’মেয়াদে মোদির নেতৃত্বে বিজেপির সরকার গঠন। প্রায় ছয় বছর আগে মোদি যখন প্রথম বিজেপি জোট সরকারের জন্য নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছিলেন, তখন তার আগের বারের উল্লেখযোগ্য প্রতিশ্রুতির কোনোটাই বাস্তবায়ন করতে পারেননি। বিশেষত ‘আচ্ছে দিন’ ফেরানো এবং সবার জন্য কর্মসংস্থানমুখী বিকাশের ব্যাপারে তেমন কিছু করতে পারেননি মোদি।
এই ব্যর্থতাকে চাপা দিতে গিয়ে এবারের নির্বাচনে তিনি উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদকে প্রধান প্রচার কৌশলে পরিণত করেন। আর দ্বিতীয়বার সরকার গঠনের পরপরই সে কৌশলের দু’টি বাস্তবায়ন করে ফেলেছেন। এর একটি হলো কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল আর দ্বিতীয়টি হলো বাবরি মসজিদের স্থলে রামমন্দির নির্মাণ করার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের রায়।
দেশী-বিদেশী যে কর্পোরেট পুঁজির সমর্থনের ওপর ভর করে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে তাতে মোদিকে প্রথম পাঁচ বছরের শাসন ধারাই বাকি সময়ে অব্যাহত রাখতে হবে। অর্থাৎ আদানি, রিলায়েন্স, টাটার মতো বৃহৎ শিল্পপতিদের অনুকূল নীতি গ্রহণ করতে হবে। এতে ভারতীয় অর্থনীতির যেটুকু বিকাশ হবে তার সুফল প্রধানত পাবে ধনী পাঁচ শতাংশ। এ কারণে জাতীয়তাবাদের অস্ত্র নিয়েই টিকে থাকতে হবে বিজেপিকে।
মোদি-অমিত শাহ নির্বাচনের পরও বাস্তবে সেই কৌশলই অব্যাহত রেখেছেন। আর এ ক্ষেত্রে সামনে এনেছেন নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি তৈরির ইস্যুটি। এই উদ্যোগ আসামে প্রাথমিকভাবে কিছুটা ফল বয়ে আনলেও পশ্চিমবঙ্গসহ অন্য রাজ্যগুলোতে এর ফল ইতিবাচক নয়। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার তিনটি উপনির্বাচনেই তৃণমূলের কাছে বিজেপি হেরে গেছে। আগের বার তৃণমূল কেবল একটি স্থানে জয় পেয়েছিল। মহারাষ্ট্রে এর মধ্যে অ-বিজেপি দলগুলো জোট সরকার গঠন করেছে।
লোকসভা ও রাজ্য বিধান সভার পরের নির্বাচনগুলোতে বিজেপির জয়ের ধারা উল্টো গতিও নিতে পারে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বেশ ক’টি রাজ্যে বিধান সভার নির্বাচন রয়েছে। সেসব নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো বিজেপিবিরোধী বৃহৎ একটি ফোরাম দাঁড় করাতে পারলে বিজেপি শাসনে ছেদ পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
আর দু’দেশের রাজনীতিতে একচেটিয়া অবস্থার অবসান ঘটলে তা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সঙ্ঘাতমুখর সম্পর্ক অবসানের জন্য ইতিবাচক হতে পারে। দেখার বিষয় হলো সঙ্ঘাত না সহাবস্থান কোন ধারায় অগ্রসর হয় পাক-ভারত সম্পর্ক। অবশ্য বিশ্বের প্রভাবশালী শক্তিগুলো এই দু’দেশের মধ্যে সঙ্ঘাত জিইয়ে থাকার মধ্যেই তাদের স্বার্থের সুরক্ষা দেখতে পায়।
mrkmmb@gmail.com